হাওর বার্তা ডেস্কঃ চারিদিকে তখন ভয়ের বন্যা বয়ে চলছে এক ভয়ংকর ভাইরাস সম্পর্কে; যার নাম এইচআইভি। এইচআইভি ভাইরাস থেকেই শুধুমাত্র মানুষ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়। এটি কোন ছোঁয়াচে রোগ নয়। একই বাতাসে নিশ্বাস নিলে, হাত মেলালে, জড়িয়ে ধরলে, চুমু খেলে, একই পাত্রে খাবার খেলে, পানি পান করলে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত ব্যক্তিগত সামগ্রী ব্যবহার করলে, তার ব্যবহৃত টয়লেট ব্যবহার করলে কেউ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয় না।
আক্রান্ত নারী বা পুরুষের সঙ্গে কনডম ছাড়া যৌন সম্পর্ক হলে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত বা ব্যবহৃত একই সিরিঞ্জ অন্যের শরীরে প্রবেশ করালে এই জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে।
সর্বনাশ পুরো ইউরোপের নতুন প্রজন্ম থেকে শুরু করে বয়স্করাও ভয়ে অস্থির। কী হবে, কী হয়েছে বা কি হতে পারে! সুইডেনের সমস্ত হাসপাতালে জরুরি ভিত্তিতে এইচআইভি টেস্টের জন্য সবাইকে কর্তৃপক্ষ অনুরোধ করছে। কিন্তু কেউ ভয়ে টেস্ট করাতে রাজি নয়। কারণ ভালোবাসার সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সঙ্গে দৈহিক মিলন থেকে শুরু করে ইন্টিমেট সম্পর্ক হয়েছে অনেকেরই।
আবার ছুটিতে অনেকেই দেশের বাইরে অপরিচিত মানুষের সঙ্গেও হয়তবা ঘটনা ঘটিয়েছে। এখন টেস্ট করালেই যদি এইডস ধরা পড়ে! সমাজে লজ্জা, স্বামী-স্ত্রী-পুত্র-কন্যারাও দূরে সরে যাবে। যে ব্যক্তি কোনোদিন অবৈধ সম্পর্কে লিপ্ত হয়নি তারও ভয়। বাতাস বা পানির মাধ্যমেও তো এ জীবাণু তার শরীরে ঢুকতে পারে। অহেতুক ভয় আর ভয়। অনিশ্চয়তার মাঝে জীবনযাপন করছে অনেকেই তবুও সাহস করে অপ্রিয় সত্যকথা জানতে কেউ প্রস্তুত নয়।
বহু বছর পর আজ মনে পড়ছে সেদিনের একটি ঘটনা। হঠাৎ আমার জীবনে অন্ধকার নেমে এলো। সকালে ঘুম থেকে উঠে দাঁত ব্রাশ করার সময় আয়নায় তাকিয়ে দেখি আমার জিহ্বা এবং ঠোঁট কালো। কী ব্যাপার আমার কী হয়েছে? আমি তো কারো সঙ্গে দৈহিক সম্পর্কে জড়িত হইনি, তাহলে কীভাবে আমার এমনটি হলো?
চারিদিকে এইডস নিয়ে কথা চলছে তখন। সন্দেহ ঢুকেছে মনে তাহলে ছোঁয়াচে রোগ নিশ্চয়ই। আমার কি তাহলে এইডস হয়েছে? বন্ধু বান্ধবকে বিষয়টি বলতে বেশ উদগ্রীব এবং বিষণ্ণ মনে হলো তাদেরকে! আমার ভাব ভঙ্গী দেখে কেউ কেউ এমন ভাব দেখিয়েছিল তাতে বেশ মিল পেয়েছিলাম জঙ্গলে পিপড়া এবং হাতির একটি গল্পের সঙ্গে।
কোন এক সময় হাতি পরিবারের কনিষ্ঠা মেয়েহাতি গর্ভবতী হয়েছে। সেই একই জঙ্গলে বসবাস করছে পিপড়া পরিবার। পিপড়া পরিবারের ছোট্ট ছেলে পিপড়াটি বেশ নব যৌবনে উত্তেজিত। সে ভীষণভাবে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে জঙ্গলের মধ্যে। বনের রাজা সিংহের সঙ্গে তার হঠাৎ দেখা।
সিংহরাজা জিজ্ঞেস করল ‘কী ব্যাপার পিপড়া তুমি এত অস্থির হয়ে ছুটাছুটি করছ কেন, কী হয়েছে তোমার?’ পিপড়া বললো ‘সিংহরাজা ঘটনা ঘটে গেছে।’ ‘কী ঘটনা ঘটে গেছে? প্রশ্ন করল সিংহরাজা।’ পিপড়া বললো ‘বড় হাতির ছোট মেয়ে গর্ভবতী হয়েছে।’ সিংহরাজা বললো ‘তাতে তুমি চিন্তিত কেন?’ পিপড়া উত্তরে বললো ‘সবাই আমাকে সন্দেহ করছে!’
যারা সত্যি সত্যিই অবৈধ যৌন সম্পর্কে জড়িত তারা চিন্তিত নয়, মাঝখানে আমি তখন ভীষণভাবে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। এই ছোট্ট পিপড়ার মত তাই গল্পটা মনে পড়ে গেল। যাইহোক আমি তৎক্ষণাৎ হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার দেখালাম। ডাক্তার চেকআপ পর্ব শুরু করলেন, রক্ত পরীক্ষা করা থেকে শুরু করে সব বিষয় জানতে চাইলেন যেমন নারী ঘটিত সম্পর্ক বা তেমন কিছু খেয়েছি কিনা যা জিহ্বা কালো হবার কারণ হতে পারে।
ডাক্তার বললেন তিন দিন পরে ফলাফল জানা যাবে। ওই তিন দিন আমার মনের ওপর দিয়ে যে ঝড় বয়ে গিয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার নয়। এইডসের ভয়ে মরে বেঁচে আছি। দিনগুলো কাটছে বিষণ্ণতায় মধ্যদিয়ে। তিনদিন পর জানা গেলো শরীরে মার্কারি (Hg) ঢুকেছে খাবারের সঙ্গে।
বাল্টিক হেরিং ফিস যা দেখতে চাপিলা মাছের মত এর পেটের মধ্যে মার্কারি নামে তরল পদার্থ মাঝে মধ্যে থাকে। ঠিক মত মাছের পেটের মধ্যের সব পরিষ্কার না করা হলে মার্কারি থেকে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আমার ক্ষেত্রে এমনটি হয়েছিল। মার্কারি শরীরে ঢুকলে এবং ভাগ্য খারাপ হলে শরীরে ক্যানসার হবার সম্ভাবনা থাকে।
সেই বাল্টিক হেরিং ফিস রান্না করেছিলাম বেগুন দিয়ে। একে তো বেগুন তার পর লোহার কড়াইয়ে রান্নার কারণে (আয়রনের কারণে) তরকারির রং হয়েছে কালো। হেরিং মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়েছি তাই আমার জিহ্বা কালো হয়েছিল। যাইহোক ডাক্তার সব বলার পরে স্বস্থি ফিরে পেয়েছিলাম সেদিন।
এইডস সম্পর্কে এখন যেভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হলো এমনটি সম্ভব ছিল না আজ থেকে ৩৩ বছর আগে। কেউই তখন সঠিকভাবে জানত না কী কারণে বা কী করলে মানুষ এইচআইভি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়।
প্রিয় পাঠক ৩৩ বছর আগের ঘটনাগুলো তুলে ধরার পেছনে উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশে নানা কারণে জটিল রোগের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ নিয়ে আমি আগেও একাধিক লেখায় উল্লেখ করেছি। আজ যেটা বলতে চাই তা হলো, আমরা অনেক সময় অহেতুক নানা রোগের ভয়ে ভীত হয়ে পড়ি। এখন প্রত্যেকটা শহরে বড় বড় হাসপাতাল, বড় বড় ডিগ্রিধারী ডাক্তার, অসংখ্য ওষুধ কোম্পানি বিদ্যমান।
টেস্টের ফলাফল ভুল হোক আর নির্ভুল হোক, যে কোনো শহরে প্রায় সব টেস্ট করা সম্ভব। কিন্তু তবুও মানুষ নানান ভয়ে টেস্ট করতে চায় না। যদি ডায়াবেটিস ধরা পড়ে, যদি হাই ব্লাড প্রেশার ধরা পড়ে, যদি কিডনিতে রোগ ধরা পড়ে, যদি ক্যান্সার হয়ে যায় তখন কী হবে? একই ধরনের লক্ষণ বিভিন্ন রোগের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে।
একটি সাধারণ রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেলেই মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়ছে। ভাবছে নিশ্চয়ই তার জটিল রোগ হয়েছে। শুরু হয় দুশ্চিন্তা। দুশ্চিন্তা থেকে ভয়। ভয় থেকে নানান জটিলতা। কিন্তু টেস্ট করলে দেখা গেল তার আসলে জটিল কিছুই হয়নি।
যেহেতু আমরা প্রতিনিয়ত ভেজাল খাবার খাচ্ছি তাই আমরা কেউ জানিনা কোন ধরনের রোগ আমাদের শরীরে বাসা বেঁধেছে। কিন্তু শরীরে রোগ বাসা বাধুক আর নাই বাধুক আমাদের মনে ভয়ানক ভয় বাসা বেধেছে। আর সে ভয়ই হয়ে দাঁড়াচ্ছে সব মানসিক রোগের কারণ।
এডিস মশার কারণে অনেকেই ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এই দুর্ঘটনার কারণে অনেকেই সাধারণ মশার কামড়ে ভীত হয়ে পড়ছে। আবার সাধারণ জ্বর হলেও ডেঙ্গু আতঙ্কে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে। এ ধরনের ঘটনা তখনই ঘটে যখন মানবজাতি জানে না সমস্যার সমাধান কোথায়।
কোন একদিন এডিস মশার ওষুধ আবিষ্কার হবে বা এইডসের মত ভয়াবহ রোগের ওষুধ পাওয়া যাবে। আবার হয়তো নতুন রোগেরও উদয় হবে। এরপরেও সতর্ক থাকতে হবে আমাদের। জানতে হবে অজানাকে। জয় করতে হবে ভয়কে, জয় করতে হবে পরাজয়কে।