হাওর বার্তা ডেস্কঃ তারিখটি ঠিক মনে আছে, ৮ অক্টোবর ১৯৮৯ সাল। বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর একজন নবীন চিকিৎসক হিসেবে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুর উপজেলার ভাগলপুর গ্রামে জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কমপ্লেক্সে ‘মেডিকেল অফিসার’ হিসেবে যোগ দেই।
এ প্রতিষ্ঠানে আসার আগে আমার মধ্যে দ্বিধা ছিল, সংশয় ছিল- উপজেলা পর্যায়ে বহু আগেই প্রতিষ্ঠিত একটি সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এমন আরেকটি প্রতিষ্ঠান টিকবে তো? তখনও হাসপাতাল ভবন নির্মিত হয়নি।
ভাগলপুর গ্রামে জহুরুল ইসলাম সাহেবের পৈতৃক বাসভবনে চিকিৎসা সেবার কাজ শুরু। এখানে আসার আগেই অবশ্য অনেকের কাছে কমবেশি একটা ধারণা পেয়েছিলাম। তবে আমার বিশ্বাস ছিল এমন একজন মানুষ এ হাসপাতালটি নির্মাণের কাজে হাত দিয়েছেন যার একটি সফল অতীত আছে। তিনি কখনও কোনো কাজে ব্যর্থ হয়েছেন এমনটি শোনা যায়নি।
কাজে যোগ দেয়ার অল্পদিনের মধ্যেই আলহাজ জহুরুল ইসলাম বাড়িতে এলেন। প্রস্তুত ছিলাম, দেখা করে নিজের পরিচয় দেব। সালাম দিতে পারলাম না, আগেই তিনি হাত তুলে সম্ভাষণ জানালেন। আমি বাকরুদ্ধ ও অভিভূত হয়ে পড়লাম।
শুনেছি তিনি অতিশয় সাধারণ জীবন নির্বাহ করেন; কিন্তু কত সাধারণ হতে পারে এমন বিশাল মাপের একজন মানুষের জীবনযাত্রা, তা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। এখানে কাজে যোগ দেয়ার পর দশ/বারো বার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাড়ি এলেই ব্লাড প্রেসার ও ব্লাড সুগার পরীক্ষার জন্য আমাকে ডেকে পাঠাতেন। ছোটবেলা থেকেই শুনেছি, গাছ যত বড় হয় তার সুশীতল ছায়ায় তত বেশি মানুষ আশ্রয় পায়।
এসব কথা যে নিতান্তই কথার কথা নয় তা আমি আলহাজ জহুরুল ইসলামকে দেখে উপলব্ধি করেছি। এত বড় মাপের একজন মানুষ যিনি, কর্মজীবনে শুধু সাফল্যেরই মালাই গেঁথেছেন, তাকে দেখেছি বাড়ি এলেই গ্রামের সাধারণ মানুষের মাঝে হারিয়ে যেতে।
জহুরুল ইসলাম না ফেরার দেশে চলে গেছেন অনেকটা অপরিণত বয়সে। এই চলে যাওয়াটা যে গোটা দেশের জন্য কত বড় ক্ষতি তা বুঝতে হলে তারই নিপুণ হাতে গড়া ‘জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল’ ঘুরে যেতে হবে। শিল্প, ব্যবসা, সমাজসেবার পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং শিক্ষা বিস্তারে তার সম্পৃক্ততা এবং নীরব ভূমিকার কথা এতদিনে নানাভাবে জানার সৌভাগ্য হয়েছে আমার।
তিনি তার কর্মময় জীবনে অসম্ভবকে যেমন সম্ভব করেছেন তেমনি কর্মবিমুখ বাঙালিকে করেছেন কর্মমুখী। দেশে শিল্পের বিকাশে যেমন নির্মাণ করেছেন কলকারখানা, তেমনি মাটির বুক চিড়ে সুপেয় পানি তুলে সবুজে সবুজে ছেয়ে দিয়েছেন গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে। এদেশে পরিকল্পিত আবাসন ও অ্যাপার্টমেন্ট ব্যবসার পথিকৃৎ তিনি। আত্মবিশ্বাস ও প্রাণশক্তির প্রাচুর্য দিয়ে তিনি গড়ে তুলেছেন নানা প্রতিষ্ঠান, যার অন্যতম জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জহুরুল ইসলাম নার্সিং কলেজ।
চিকিৎসাসেবা পেতে কোনো মানুষই যেন বঞ্চিত না হয় এমন স্বপ্ন ও বিশ্বাস নিয়েই গড়ে তোলা হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। শুনেছি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ তৈরির সময় থেকেই তিনি বলতেন, সারা দেশ থেকে মানুষ এখানে আসবে চিকিৎসা নিতে, উপমহাদেশের নানা প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা আসবে এই কলেজে পড়তে। তার এই বিশ্বাস আর স্বপ্ন আজ আর কল্পনা নয়, আক্ষরিক অর্থেই বাস্তব।
আজ জহুরুল ইসলামের ২৪তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা এবং পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন জান্নাতবাসী হন।
অধ্যাপক ডা. বাহার উদ্দিন ভুঁইয়া : পরিচালক, জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল