ঢাকা ১০:৩৮ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পলাতক খুনিরা আজও অধরা

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:০২:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ অগাস্ট ২০১৯
  • ২৩১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য ছয় খুনিকে ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, কানাডায় পালিয়ে থাকা খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইনি লড়াই শুরু করেছে বাংলাদেশ। তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে পালিয়ে থাকা খুনিদের ফিরিয়ে আনতেও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বিশেষ টাস্কফোর্সের প্রধান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা অব্যাহত আছে।

খুনিরা যে দেশেই থাকুক তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায়, নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাকি খুনিদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে। তাদেরও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এরপর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে পরবর্তী সরকার। শুধু তাই নয় খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। সামরিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনিরা রাজনৈতিক দল গঠন করে অনেক অপকর্ম করে। কোনো কোনো খুনি সংসদ সদস্যও হন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে করা ইমডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া।

দীর্ঘ আইনি-প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে ১২ খুনির মধ্যে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হল-কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ, মেজর (অব.) একে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)। বাকি সাতজনের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।

জানা যায়, কানাডার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্য রাষ্ট্র জার্মানি ও স্পেনে এক সময় মৃত্যুদণ্ড থাকলেও এখন আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই এ দুই দেশও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনতে ২০১৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। সংস্থাটি এ বিষয়ে মর্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ২০১৬ সালে মার্কিন আইন দফতরে চিঠি পাঠান।

স্কাডেন এলএলপি ২০১৭ সালে জানায়, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের অনুরোধে রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি একেএম মহিউদ্দিনকে ফেরত দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

এখনও অধরা ৬ খুনি : বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাকিস্তান, লিবিয়াসহ আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারবার অবস্থান বদল করেছে খুনিরা।

রাজনৈতিক আশ্রয় : রাশেদ চৌধুরী এখন অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া এ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বারবার কূটনৈতিক কথা চালাচালি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আশ্বাসও মিলেছে। কিন্তু আলোচনায় গতি আসেনি।

মৃত্যুদণ্ডই বাধা : নূর চৌধুরী অবস্থান করছে কানাডায়। সে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ ব্যাপারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র–ডোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া কোনো আসামিকে হস্তান্তর করা কানাডার আইন অনুযায়ী বৈধ নয়।

সে কারণে আইনি জটিলতায় এখনও আটকে আছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা। ২০০৪ সালে খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন কানাডার আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে ওই আদেশ ঝুলে থাকায় নূর চৌধুরী কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।

ঘাতকেরা কে কোথায় : বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের আরেকজন মোসলেম উদ্দিনও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে বলে তথ্য রয়েছে। এর আগে তার ভারত ও জার্মানিতে অবস্থানের তথ্যও ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। মোসলেমও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে। তবে তা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর সে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তার সঠিক অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।

নিশ্চিত নয় অবস্থান : বাকি তিন খুনি শরিফুল হক ডালিম, আবদুর রশিদ ও আবদুল মাজেদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে-লিবিয়া, সেনেগালসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করলেও তারা স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাস করছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

বিচার সুগম পথে হয়নি : এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাধায় থমকে যায় বিচার প্রক্রিয়া। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ৬ বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।

দীর্ঘ ৬ বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় ২ বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়।

২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলে দায়মুক্ত হয় বাংলাদেশ।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয় সংবাদ

পলাতক খুনিরা আজও অধরা

আপডেট টাইম : ১০:০২:৫৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৫ অগাস্ট ২০১৯

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গবন্ধুর পাঁচ খুনির ফাঁসির রায় কার্যকর হলেও বিদেশে পালিয়ে থাকা অন্য ছয় খুনিকে ফিরিয়ে আনা এখনও সম্ভব হয়নি। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব আইন পলাতকদের ফেরানোর ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সূত্র জানায়, কানাডায় পালিয়ে থাকা খুনি নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইনি লড়াই শুরু করেছে বাংলাদেশ। তাকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদী সরকার। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশে পালিয়ে থাকা খুনিদের ফিরিয়ে আনতেও কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনা সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় বিশেষ টাস্কফোর্সের প্রধান ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানিয়েছেন, খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা অব্যাহত আছে।

খুনিরা যে দেশেই থাকুক তাদের ফিরিয়ে আনা হবে। এর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ায় এক জনসভায় তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরী আমেরিকায়, নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করছে। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। বাকি খুনিদের অবস্থান সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। আমাদের কাছে অনেক তথ্য আছে। তাদেরও ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।’

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একদল বিপথগামী সেনা সদস্যের হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হন। এরপর খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে পরবর্তী সরকার। শুধু তাই নয় খুনিদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দেয়া হয়। সামরিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে খুনিরা রাজনৈতিক দল গঠন করে অনেক অপকর্ম করে। কোনো কোনো খুনি সংসদ সদস্যও হন।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধে করা ইমডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর মধ্য দিয়ে শুরু হয় খুনিদের বিচার প্রক্রিয়া।

দীর্ঘ আইনি-প্রক্রিয়া শেষে ২০১০ সালে ১২ খুনির মধ্যে পাঁচ খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। তারা হল-কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ, মেজর (অব.) একে বজলুল হুদা এবং মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (আর্টিলারি)। বাকি সাতজনের মধ্যে আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুয়েতে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে।

জানা যায়, কানাডার মতো ইউরোপীয় ইউনিয়নের দুই সদস্য রাষ্ট্র জার্মানি ও স্পেনে এক সময় মৃত্যুদণ্ড থাকলেও এখন আর মৃত্যুদণ্ডের বিধান নেই। তাই এ দুই দেশও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে।

যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ না থাকায় রাশেদ চৌধুরীকে দেশে ফেরত আনতে ২০১৫ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি পরামর্শক সংস্থা স্কাডেন এলএলপিকে যুক্ত করে বাংলাদেশ সরকার। সংস্থাটি এ বিষয়ে মর্কিন সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরতের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী ২০১৬ সালে মার্কিন আইন দফতরে চিঠি পাঠান।

স্কাডেন এলএলপি ২০১৭ সালে জানায়, রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র ফেরত দিতে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত আনার বিষয়ে বাংলাদেশ আশাবাদী। কারণ বাংলাদেশের অনুরোধে রাজনৈতিক আশ্রয় না পাওয়া বঙ্গবন্ধুর খুনি একেএম মহিউদ্দিনকে ফেরত দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র।

এখনও অধরা ৬ খুনি : বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আবদুর রশিদ, মেজর (বরখাস্ত) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এএম রাশেদ চৌধুরী, মেজর (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেম উদ্দিন খান। গ্রেফতার বা প্রত্যর্পণ ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পাকিস্তান, লিবিয়াসহ আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বারবার অবস্থান বদল করেছে খুনিরা।

রাজনৈতিক আশ্রয় : রাশেদ চৌধুরী এখন অবস্থান করছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া এ খুনিকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে কোনো অগ্রগতি হয়নি। বারবার কূটনৈতিক কথা চালাচালি হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আশ্বাসও মিলেছে। কিন্তু আলোচনায় গতি আসেনি।

মৃত্যুদণ্ডই বাধা : নূর চৌধুরী অবস্থান করছে কানাডায়। সে দেশটিতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছিল। কিন্তু তা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। এ ব্যাপারে দেশটির প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্র–ডোর সঙ্গে কথা বলেছেন স্বয়ং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া কোনো আসামিকে হস্তান্তর করা কানাডার আইন অনুযায়ী বৈধ নয়।

সে কারণে আইনি জটিলতায় এখনও আটকে আছে নূর চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা। ২০০৪ সালে খুনি নূর চৌধুরীকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দিয়েছিলেন কানাডার আদালত। তবে আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে নূর চৌধুরীর অন্য এক আবেদনে ওই আদেশ ঝুলে থাকায় নূর চৌধুরী কানাডায় বসবাসের সুযোগ পাচ্ছে।

ঘাতকেরা কে কোথায় : বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনিদের আরেকজন মোসলেম উদ্দিনও যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে বলে তথ্য রয়েছে। এর আগে তার ভারত ও জার্মানিতে অবস্থানের তথ্যও ছিল গোয়েন্দাদের কাছে। মোসলেমও যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করে। তবে তা খারিজ হয়ে যাওয়ার পর সে যুক্তরাষ্ট্রে থাকার আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। তার সঠিক অবস্থান নিশ্চিত হতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার।

নিশ্চিত নয় অবস্থান : বাকি তিন খুনি শরিফুল হক ডালিম, আবদুর রশিদ ও আবদুল মাজেদের অবস্থানের ব্যাপারে সরকারের কাছে কোনো নিশ্চিত তথ্য নেই। তবে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে-লিবিয়া, সেনেগালসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করলেও তারা স্থায়ীভাবে পাকিস্তানে বসবাস করছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে পাকিস্তানের কাছে জানতে চাওয়া হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

বিচার সুগম পথে হয়নি : এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম ছিল না। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বাধায় থমকে যায় বিচার প্রক্রিয়া। ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর দায়মুক্তি আইন বাতিল করে আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছরের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দিয়ে রায় দেন। নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট দ্বিধাবিভক্ত রায় দেন।

২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চ ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে তিনজনকে খালাস দেন। এরপর ১২ আসামির মধ্যে প্রথমে চারজন ও পরে এক আসামি আপিল করেন। কিন্তু এরপর ৬ বছর আপিল শুনানি না হওয়ায় আটকে যায় বিচার-প্রক্রিয়া।

দীর্ঘ ৬ বছর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারপতি নিয়োগ দেয়ার পর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাটি আবার গতি পায়। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন বিচারপতির বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামির লিভ টু আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। আপিলের অনুমতির প্রায় ২ বছর পর ২০০৯ সালের অক্টোবরে শুনানি শুরু হয়।

২০০৯ সালের ১৯ নভেম্বর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করেন। ফলে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার দায়ে হাইকোর্টের দেয়া ১২ খুনির মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল থাকে। এর মধ্য দিয়ে ১৩ বছর ধরে চলা এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হলে দায়মুক্ত হয় বাংলাদেশ।