বিদেশ ভ্রমণেই ব্যয় প্রকল্পের শত কোটি টাকা

হাওর বার্তা ডেস্কঃ দক্ষতা অর্জনের নামে কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের মহোৎসব! কেউ ১১ বার, কেউবা ১০ বার বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নির্মল বায়ু ও টেকসই পরিবেশ (কেইস) প্রকল্পের টাকা খরচের ক্ষেত্রে এমন কাণ্ড ঘটিয়েছেন কর্মকর্তারা।

গত ১০ বছরে যারা দক্ষতা অর্জনের জন্য বিদেশ ভ্রমণ করেছেন তাদের অধিকাংশই আবার অবসরে গেছেন। যে ‍দুই-একজন প্রশিক্ষণ নিয়ে এসেছেন তারাও অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে গেছেন। ফলে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। সরকারেরও কোন কাজে আসেনি।

অথচ প্রকল্পের পুরো ২৮৪ কোটি ৭৮ লাখ ৯৮ হাজার কোটি টাকার মধ্যে ব্যয় হয়ে গেছে ২২১ কোটি ৪৭ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের মেয়াদও শেষ হয়েছে কিন্তু দৃশ্যমান কিছুই দেখাতে পারেনি। প্রকল্পের ১৮২ কোটি টাকাই দেখানো হয়েছে কর্মচারীদের বেতন ভাতা বাবদ। আর মিডিয়া ক্যাম্পেইনে গেছে ৩৩ কোটি টাকা, কর্মকর্তাদের কাপড় ধুতে গেছে ১ লাখ টাকা। বিদেশ ভ্রমণে বাদ যাননি কেউই। মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন থেকে শুরু করে কাউন্সিলর, পুলিশের টিআই; সবাই মিলে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

এ নিয়ে সংসদীয় কমিটিতে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকল্পটি পুনঃযাচাইয়ের জন্য আইএমইডিতে পাঠানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

সংসদীয় কমিটির কার্যপত্র পর্যালোচনা করে এসব তথ্য পাওয়া যায়।

দেখা গেছে প্রকল্পের মেয়াদ ১০ বছর পার না হলেও এরইমধ্যে ৯টি গাড়ি বিকল হয়ে গেছে। আর প্রকল্প পরিচালক মুঞ্জুরুল হান্নান একাই ব্যবহার করেন তিনটি গাড়ি। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও গাড়ি ফেরত দেননি ওই প্রকল্প পরিচালক। পুনরায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অজুহাত দিয়ে তিনি গাড়ি দখলে রেখেছেন।

প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুনে শেষ হলেও নতুন করে মেয়াদ বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। এর আগে একদফা মেয়াদ বাড়ানো হয়। অর্থাৎ এ প্রকল্পের মেয়াদ শুরু হয় ২০০৯ সালে। শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৪ সালের জুনে। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৯ সালের জুন পর্যন্ত নির্ধারণ হয়।

দক্ষতা অর্জনের জন্য গেছেন সাবেক মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, তার পিএস ও এপিএস। কিন্ত মন্ত্রী, পিএস এর নাম বাদ রেখেই তালিকা দিয়েছে মন্ত্রণালয়। কার্যপত্রে দেখা গেছে পুলিশের টিআই, স্যাম্পল কালেক্টরসহ অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। ট্রাভেল বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ৩৩ কোটি টাকা, আর মিডিয়া ক্যাম্পেইনে খরচ ৩৪ কোটি টাকা, মেলা বাবদ খরচ ১০ লাখ টাকা, কালাচারাল প্রোগ্রামে গেছে ৯ লাখ, কানসালটেন্সিতে গেছে ৩৩ কোটি, কর্মকর্তাদের কাপড় ধোয়াতে গেছে ১ লাখ।

বিগত প্রায় ১০ বছরে বিদেশ ভ্রমণে পাঠানো ব্যক্তির সংখ্যা ২৯৩ জন। প্রকল্পের বড় কর্তারা আমেরিকা, নরওয়ের মতো দেশে গেলেও ছোট কর্মকর্তাদের ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ পাশ্ববর্তী দেশগুলোতে পাঠানো হয়েছে। লক্ষ্য একটাই মিলেমিশে অর্থ লুটপাট করা!

প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগে যেমন অনিয়ম করা হয়েছে, একইভাবে এর অধীনে নেওয়া প্রশিক্ষকদের বেশির ভাগ প্রকল্প শেষ হওয়ার আগেই চলে যান অবসরে। এমনকি, প্রকল্পের নীতি-নির্ধারকেরা নিজেদের অনিয়মকে হালাল করতে নমুনা সংগ্রহের কাজে যুক্তদের অবৈধভাবে পাঠিয়েছেন বিদেশ ভ্রমণে।

এছাড়া একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে প্রশিক্ষণের নামে গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। কোন কোন কর্মকর্তা প্রায় এক ডজন বার গেছেন বিদেশ ভ্রমণে। এই প্রকল্পে কর্মকর্তাদের পাহারায় থাকা পুলিশ কর্মকর্তাও বাদ যাননি বিদেশ ভ্রমণ থেকে। আর পুরো প্রকল্পের অর্ধেক টাকা ব্যয় করা হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতার পেছনে। যার পরিমাণ ১৮২ কোটি টাকা।

কেইস প্রকল্পের এই অনিয়ম দেখে রীতিমত বিস্ময় প্রকাশ করেছে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। ক্ষোভ জানিয়ে বলেছে, এভাবে প্রকল্প নিলে সরকারের যে মহৎ উদ্দেশ্য রয়েছে তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী সাংবাদিককে বলেন, প্রশিক্ষণের নামে ঢালাওভাবে লোকজন পাঠানো হয়েছে। প্রশিক্ষণের সুফলটা আমাদের পাওয়া দরকার সেটা তো আমরা পাচ্ছি না। আসলে এর কোন নীতিমালা ছিল না। আমরা তাই নীতিমালার ওপর জোর দিয়েছি। নীতিমালা থাকলে কারো পছন্দ অপছন্দের বিষয় থাকবে না। যারা যোগ্য তারাই প্রশিক্ষণে যাবে। তাছাড়া যারা ১০-১৫ বছর সার্ভিস দিতে পারবে তারাই যাবে।

তিনি বলেন, যাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশির ভাগই অবসরে গেছেন। যারা ছিলেন তারা অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে গেছেন। ফলে প্রশিক্ষণের সুফল পাচ্ছে না মন্ত্রণালয়। দেখা গেছে একই পরামর্শককে একাধিকার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পরার্শকরা কেউ কাজ শেষ করতে পারেননি। কেউ ১০ শতাংশ কেউ ২০ শতাংশ কাজ করেছেন। তাহলে এ ধরনের পরামর্শক কেন নিয়োগ দেওয়া হলো?

সাবের হোসেন চৌধুরী আরও বলেন, এ প্রকল্পে যারা পরিবেশ সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখেন না তাদেরও যুক্ত করা হয়েছে। এগুলো প্রকারান্তরে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে প্রশয় দেওয়ার সামিল। তাই প্রকল্পের প্রকৃত কাজের মূল্যায়ন হয়েছে কিনা তা পুনঃমূল্যায়নের জন্য পুনরায় আইএমইডিকে দিয়ে যাচাই করার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ জানানো হয়েছে।

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রশিক্ষণের নামে একই ব্যক্তি ঘুরে ফিরে গেছেন বিদেশে। প্রকল্পের উপ-পরিচালক শাহ রেজোয়ান হায়াত সর্বাধিক ১১ বার বিদেশ গেছেন। পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি বছরই প্রশিক্ষণের নামে তিনি বিদেশ ভ্রমণে যান। কম যাননি প্রকল্প পরিচালক নাসিরুদ্দিনও। তিনিও প্রশিক্ষণের নামে একাধিকবার বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছেন। এছাড়া শামসুর রহমান খানও ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কয়েকবার গেছেন বিদেশে। তাদের সঙ্গে প্রতিবারই ভ্রমণের সুবিধা নিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মঞ্জুরুল হান্নান। একই সঙ্গে পিডি হিসেবে তিনি প্রকল্পের তিনটি গাড়ি একাই ব্যবহার করেছেন। এছাড়া কাজী মনিরুল ইসলাম, মিজানুর রহমান, শাহানাজ রহমান, নীল রতন সরকারসহ ২৯৩ জন ব্যক্তি অবৈধভাবে বিদেশ ভ্রমণ করেছেন।

এতে সরকারের যতটা লাভ হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তার চেয়ে বেশি পকেট ভারী হয়েছে বলে মনে করছে সংসদীয় কমিটি। এর মধ্যে সিটি মেয়র, কাউন্সিলর, সিটির কর্মকর্তা-কর্মচারী, ঢাকা মেট্টোপলিটন পুলিশের ওসি, স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা এ তালিকায় রয়েছেন।

এদিকে প্রকল্পের অধীন ৩১টির সব গাড়ি নতুন কেনা হলেও বেশির ভাগ মেয়াদের আগেই অচল দেখানো হয়েছে। অথচ ১০ বছরে ৯টি গাড়ি বিকল হয়েছে। এতে সরকারের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে কয়েক কোটি টাকা। এসব গাড়ির মধ্যে মাইক্রোবাস, পিক আপ, মোবাইল মনিটরিং ভ্যান ও জিপ রয়েছে। আবার সচল গাড়ির অবস্থাও শোচনীয়।

এদিকে, প্রকল্পের সঙ্গে যুক্তদের মধ্যে বেশির ভাগ কর্মকর্তা মেয়াদ উত্তীর্ণের আগেই অবসরে গেছেন। এমন কর্মকর্তাদের মধ্যে মো. আনছার আলী খান, ব্রি. জে. মো. আবদুল কাদির, ব্রি. জে. মো. আহসানুল হক মিয়া, মো. নুরুল্লাহ, মো. আবদুস সালাম, মো. সেহাব উল্লাহ, মো. মফিজুল ইসলাম প্রমুখ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর