হাওর বার্তা ডেস্কঃ টানা বৃষ্টি ও উজানের ঢলে বাংলাদেশের নিম্নাঞ্চলে আঘাত হানা বন্যায় বানভাসির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। গত ১০ দিনে প্লাবিত হয়েছে একুশ জেলা। গাইবান্ধা. বগুড়া, বান্দরবান, টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, জামালপুর, নেত্রকোনা ও শেরপুর জেলায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে বন্যাদুর্গতদের সংখ্যা।
গত ২৪ ঘণ্টায় যমুনা নদীর পানি ২৩ সেন্টিমিটার বেড়ে সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯১ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম জানিয়েছেন। এতে সিরাজগঞ্জের ৯০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে, টাঙ্গাইল জেলার পাঁচ উপজেলায় ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এ জেলায় বন্ধ রয়েছে ৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। গাইবান্ধায় পানিবন্দি রয়েছে পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ। অন্যদিকে, বন্যার পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো সংবা—
গাইবান্ধা : গাইবান্ধায় বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকালও বন্যার পানিতে একের পর এক ব্রিজ, কালভার্ট ও পাকা রাস্তা ভাঙছে। গত কয়েক দিনে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের সবগুলো বাঁধ ভেঙে প্লাবিত হয়েছে জেলার সাত উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম।
জেলা প্রশাসক ও জেলা দায়রা জজের বাসভবনের সামনেও হাঁটু পানি। গাইবান্ধা পৌরসভার প্রায় সবগুলো ওয়ার্ড দুই থেকে তিন ফুট বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ট্রেন চলাচলও বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন জেলার পানিবন্দি পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুরে ফুলছড়ির ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ১৫০ সেন্টিমিটার, ঘাঘট নদীর পানি শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৯৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
তবে সুন্দরগঞ্জ উপজেলার হরিপুর পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি কমে বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সরেজমিন জানা যায়, জেলার বন্যাকবলিত সাত উপজেলার ৪০০টি গ্রামের প্রায় পাঁচ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
বন্যাকবলিত এলাকার মানুষজন সব থেকে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন গবাদিপশু নিয়ে। গবাদিপশুর থাকা এবং খাবার চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সংকট সৃষ্টি হয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির।
সুনামগঞ্জ : সুনামঞ্জে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নেয়া মানুষেরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বন্যায় জেলার এক লাখ ২০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। পৌর শহরের বড়পাড়া এলাকায় একটি আশ্রয়কেন্দ্রে মানবেতর জীবনযাপন করছে ১৮টি পরিবার।
পাচ্ছেন না কোনো রকমের সহযোগিতা, খাবার সংকটে রয়েছেন তারা। তা ছাড়া বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে পানিবাহিত রোগে ভুগছেন তারা। অন্যদিকে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা।
তারা জানান, আমরা আটদিন হলো আশ্রয়কেন্দ্রে এসেছি। এখন পর্যন্ত একটা মানুষও আমাদের আইসা দেখে যায়নি। না কোনো মেয়র, না কাউন্সিলর। আমরা খুব কষ্টে জীবনযাপন করছি।
বগুড়া : বগুড়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ। জেলার ধুনটে যমুনার প্রবল চাপে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের একাধিক পয়েন্ট দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ছে। এখন সেই পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। ইঁদুরের গর্ত এবং দুর্বল অংশ দিয়ে পানি চুইয়ে পড়ায় বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে।
লোকালয় অংশের চেয়ে নদীমুখ অংশের পানি প্রায় আট ফুট উচ্চতায় প্রবল বেগে প্রবাহিত হওয়ায় যেকোনো মুহূর্তে দুর্বল বাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
গতকাল দুপুর ১২টায় যযুনার পানি বেড়ে বিপদসীমার ১২৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। গত শনিবার দুপুরে চলতি মৌসুমে বগুড়ায় প্রথম বিপদসীমা অতিক্রম করে যমুনা নদীর পানি।
বান্দরবান : টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে হওয়া বন্যায় বান্দরবান-রুমা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে পাহাড়ের মাটি ধসে পড়ায় গত কয়েক দিন ধরে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে।
গতকাল সকালে এই তথ্য জানিয়েছেন রুমা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ শামসুল আলম। ফের কবে নাগাদ সড়ক যোগাযোগ চালু হতে পারে তা জানাতে পারেননি তিনি।
টাঙ্গাইল : টাঙ্গাইলেও বন্যার অবনতি হচ্ছে। দিন দিন পানি বাড়ছে। ফলে দুর্ভোগে পাঁচ উপজেলার মানুষ। টাঙ্গাইলের প্রায় সবকয়টি নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে।
গতকাল সকাল থেকে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার, ধলেশ্বরী নদীর পানি ১২ সেন্টিমিটার এবং ঝিনাই নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
এই পানি বৃদ্ধির কারণে জেলার পাঁচটি উপজেলার নদী তীরবর্তী ২২টি ইউনিয়নের প্রায় ১০৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এ ছাড়া এসব গ্রামের রাস্তা এবং ফসলি জমি তলিয়ে গেছে। বন্ধ রয়েছে ৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও।
রাজবাড়ী : দেশের ২১ জেলার প্রবেশদ্বার দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে তীব্র স্রোত, ফেরি সংকট ও ঘাট সমস্যায় ফেরি চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। এতে দৌলতদিয়া প্রান্তের সড়কে প্রায় সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে।
ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন ঢাকামুখী যানবাহনের চালক ও যাত্রীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দৌলতদিয়া-খুলনা মহাসড়কের গোয়ালন্দ জামতলা বাজার পর্যন্ত সড়কে যানবাহনের এ দীর্ঘ সিরিয়াল দেখা গেছে।
পরবর্তীতে বেলা বাড়ার সাথে সাথে যানজটও বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিআইডব্লিউটিসি দৌলতদিয়া ঘাট শাখা ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) আবু আব্দুল্লাহ বলেন, দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌরুটে বর্তমানে ১৫টি ফেরির মধ্যে ১২টি ছোট-বড় ফেরি চলাচল করছে।
নদীর তীব্র স্রোতের কারণে ফেরিগুলোর নদী পারাপার হতে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে দ্বিগুণ সময় ব্যয় হচ্ছে। এ ছাড়া মাওয়া রুটের যানবাহনের চাপ রয়েছে। ফলে যানবাহনের এ সিরিয়ালের সৃষ্টি হয়েছে।
জামালপুর : যমুনার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জামালপুরের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। বাঁধ ভেঙে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি ট্রেন চলাচলও বন্ধ রাখা হয়েছে কিছু জায়গায়।
পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন লাখ লাখ মানুষ। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার চৌধুরী জানান, মাদারগঞ্জের নাদাগাড়িতে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের ১৬০ মিটার ভেঙে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে আরও ৩০টি গ্রাম।
সবমিলিয়ে জেলার ৬৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৫৯টি ইউনিয়নই এখন বন্যা কবলিত। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন সাড়ে চার লাখের বেশি মানুষ। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থাও।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাজিব কুমার সরকার জানান, বন্যায় ৭৩২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচ হাজার ৭২০ জন মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। তলিয়ে গেছে অন্তত ১৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল। দুর্গত এলাকায় বিশুদ্ধ পানি, খাবার ও গোখাদ্যের সংকট তীব্র হয়ে উঠেছে।
নেত্রকোনা : এদিকে নেত্রকোনায় বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। টানা ১০ দিন বৃষ্টি থাকার পর গত মঙ্গলবার রাত ৮টার পর থেকে জেলার কোথাও বৃষ্টি হয়নি। গত বুধবার সকাল থেকে রোদের দেখা মিলেছে। এতে নদ-নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করেছে।
তবে কংস নদের জারিয়া পয়েন্টে এখনো ১৪২ সেন্টিমিটার বিপদসীমার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
এদিকে জেলা প্রশাসন থেকে ত্রাণ বিতরণ চললেও পানিবন্দি মানুষের মাঝে বাড়ছে ত্রাণের চাহিদা। জেলা প্রশাসনের তথ্যমতে, পুরো জেলায় ৮৬টি ইউনিয়নের মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩২টি ইউনিয়নের প্রায় ২০০ গ্রাম।
এর মধ্যে ১৮ হাজার ৫২৭টি পরিবারের ৯৩ হাজার ১০৫ জন মানুষ এখনো পানিবন্দি রয়েছেন। পানি প্রবেশ করায় ৪৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৮৮টি ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৫টি রয়েছে।
শেরপুর : এদিকে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদে পানি বৃদ্ধির ফলে শেরপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের পুরাতন ভাঙন অংশ দিয়ে বন্যার পানি দ্রুতবেগে প্রবেশ করে চরাঞ্চলের নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল সকাল ৬টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্র নদের পানি শেরপুর ফেরিঘাট পয়েন্টে এক মিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমা ছুই ছুই করছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা।
এতে শেরপুর-জামালপুর মহাসড়কের পোড়ার দোকান কজওয়ের (ডাইভারশন) ওপর দিয়ে হাঁটু সমান বন্যার পানি দ্রুতবেগে প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলায় বন্যার পানিতে ডুবে আরও দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এতে গত পাঁচ দিনে বন্যার পানিতে ডুবে ছয়জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
জেলা ত্রাণ অফিসের তথ্য মতে, বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও উজান থেকে নেমে আসা পানিতে সৃষ্ট বন্যায় শেরপুরের পাঁচ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নের ১৭২টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে অন্তত ৬৩ হাজার লোক পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছেন। জেলায় ৫২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পানি ওঠায় ছয়দিন ধরে পাঠদান বন্ধ রয়েছে।