ভয়ঙ্কর রূপ নিচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত

হাওর বার্তা ডেস্কঃ এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন খোলা কাগজ-এর সহ-সম্পাদক খায়রুল বাশার আশিক (২৮)। রাজধানীর সেন্ট্রাল হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আশিককে গত পরশু রাতে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার অবস্থা সংকটাপন্ন। ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গেছে।

এতে আশিকের কিডনি, ফুসফুস ও লিভার আক্রান্ত হয়েছে। শুধু আশিক নন, তার মতো ডেঙ্গু ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করা মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। ডেঙ্গু তাদের জীবনকে নিয়ে চলছে মৃত্যুর কাছাকাছি। সময় যত যাচ্ছে ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে ডেঙ্গু ভাইরাস। স্বল্প সময়ে ডেঙ্গুর এমন ভয়ঙ্কর রূপে অবাক হচ্ছেন অনেকে। বছরের শুরু থেকেই রাজধানীতে ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছিল। তবে বর্ষা মৌসুমের আগেই এর প্রকোপ বেড়ে গেছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে গত ১৯ জুন পর্যন্ত ৬৬২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৪২ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন। এখনো বিভিন্ন হাসপাতালে ১১৮ জন চিকিৎসাধীন। প্রাণ হারিয়েছেন দুজন। এর মধ্যে রাজধানীর বিআরবি হাসপাতালে ৫৩ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ২৯ এপ্রিল মারা যান। আর আজগর আলী হাসপাতালে গত ২৯ এপ্রিল মারা যান ৩২ বছর বয়সী এক যুবক।

ন্যাশনাল হেলথ ক্রাইসিস সেন্টারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম সাধারণত শুরু হয় জুন থেকে। চলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। বর্ষার শুরুতে এ মৌসুম শুরু হয়। কেননা, ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশা সাধারণত শহরাঞ্চলের পরিবেশে জমাট পরিষ্কার পানিতে জন্মায়। বর্ষাকালে থেমে থেমে বৃষ্টি হওয়ায় পানি জমে থাকে বিভিন্ন জায়গায়। বৃষ্টিতে জমা টবের পানি, ছাদে জমা পানি, ডাবের খোসা বা এরকম অন্য জিনিসে জমা পানি; সর্বোপরি গৃহস্থালির আশপাশে মোটামুটি পরিষ্কার স্থানে জমে থাকা পানিতে জন্ম নেয় এডিস মশা। এ কারণে এই সময়কালকে ডেঙ্গুর মৌসুম বলা হয়। সে জন্য এসব পানি জমতে না দেওয়া বা সাবধানতা অবলম্বন করে বেঁচে থাকাটা এ মৌসুমে জরুরি।

এ বিষয়ে ম্যালেরিয়া নির্মূল কর্মসূচির বিশেষজ্ঞ মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে মশার প্রকৃতি সম্পর্কে জানতে হয়। এটা নিরীক্ষণ করতে হয়, মশাটা আসলে কোনো প্রজাতির বা তার স্বভাব কী ধরনের। এ জন্য আলাদা লোক থাকেন, যারা সারা শরীর ঢেকে হাঁটুর নিচের অংশ খোলা রেখে মশাকে বসতে দেন। এরপর মশা আটকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। তিনি জানান, মোটামুটি দেখা যাচ্ছে জুনের প্রথম সপ্তাহ থেকে এ মশার প্রকোপ বেড়েছে।

ডেঙ্গুর লক্ষণ সম্পর্কে গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. রাশেদুল হাসান বলেন, কখন সন্দেহ করবেন আপনার ডেঙ্গু হয়েছে? যখন দেখবেন প্রথম দিন থেকেই তীব্র জ্বর। (সাধারণত ১০২ ডিগ্রি বা এর ওপরে)। জ্বরের সঙ্গে তীব্র শরীর, মাংসপেশি, গিরায় গিরায়, কোমর ও চোখের পেছনে ব্যথা। জ্বরের ২-৩ দিনের মধ্যে শরীরে লাল র‌্যাশ ওঠা, যা চুলকাতে পারে। দাঁতের মাড়ি, নাক দিয়ে রক্ত পড়া, চামড়ার নিচে রক্তের দাগ দেখা দেওয়া, বমি-পায়খানার সঙ্গে রক্তপাত বা মেয়েদের মাসিকের সঙ্গে বেশি রক্তপাত।

তিনি বলেন, ডেঙ্গু হয়েছে সন্দেহ হলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। প্রচুর পানি, তরল খাবার (স্যালাইন, ডাবের পানি, তাজা ফলের রস) খেতে থাকুন। জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামলের বাইরে অন্য কোনো ব্যথার ওষুধ অথবা স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ খাবেন না।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা বলেন, ঢাকার বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে ইতোমধ্যে ডেঙ্গু শনাক্তকরণের বিশেষ সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়েছে। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এডিস মশা শনাক্তকরণে জরিপ কার্যক্রম এবং লার্ভিসাইড ও এডালটিসাইড ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। চলতি বছরের এপ্রিল থেকেই সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে পরিচালক বরাবর ন্যাশনাল ডেঙ্গু গাইডলাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দেওয়া ও নিয়মিত প্রতিবেদন পাঠানোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া করা হয়েছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যাপারে সব সরকারি মেডিকেল হাসপাতাল এবং প্রধান বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জটিল রোগীর ব্যবস্থাপনা যেন ডেঙ্গু ন্যাশনাল গাইডলাইন অনুযায়ী হয়, সে ব্যাপারে আইসিইউ প্রধানদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে। ডাক্তার-নার্সদের ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার ব্যবস্থাপনাবিষয়ক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

এদিকে প্রাণঘাতী এডিস মশার কামড়ে আহাজারি চললেও মশক নিধনের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা মশক নিবারণী দফতরের কোনো তৎপরতা নেই। সরজমিনে পুরান ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টোপাশে প্রতিষ্ঠানটির অফিসে গিয়ে কোনো তৎপরতা চোখে পড়েনি। অফিসের দু-একটি কক্ষ খোলা থাকলেও অধিকাংশ তালাবদ্ধ। দোতলা ভবনের আশপাশে অনেক খালি ড্রাম পড়ে থাকতে দেখা যায়। এসব ড্রামে মশা মারার ওষুধ থাকে বলে জানান প্রতিষ্ঠানের এক কর্মচারী।

দফতরের হিসাবরক্ষক জামাল উদ্দিন বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মশা মারার জন্য যে ওষুধ কেনে, সেগুলো এখানে মজুদ রাখা হয়। ব্যবহার শেষে ড্রামগুলো এখানে রাখা হয়। তারাই পরে খালি ড্রামগুলো সরিয়ে নেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মশা নিয়ে এ প্রতিষ্ঠানটির তেমন কোনো কর্মসূচি বা গবেষণা কার্যক্রম নেই। দফতরের কাঠামো অনুসারে ৩৯৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার কথা। কিন্তু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন ২৭৭ জন। বর্তমানে প্রায় ১১৯টি পদ শূন্য। কর্মীদের মধ্যে ক্রু, সুপারভাইজার, কয়েকজন ইনসেক্ট কালেক্টর (আইসি) রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই দফতরের অধীনে কাজ করেন না, দুই সিটি করপোরেশনের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন। তবে সিটি করপোরেশনের অধীনে কাজ করলেও কর্মীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে এ দফতর।

বর্তমানে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব অ. ন. ম ফয়জুল হক দফতরের সহকারী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। অফিসে খোঁজ নিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে টেলিফোনে তিনি বলেন, দফতরের প্রশাসনিক কার্যক্রম, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা দেওয়া ছাড়া কর্মসূচি সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। দফতরের কাজ নিয়ে বলতে পারবেন দুই সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তবে একাধিকবার কল করেও দুই প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর