কাজ না করেও ২১৯ কোটি টাকা নিচ্ছে ফরাসি প্রতিষ্ঠান

হাওর বার্তা ডেস্কঃ নির্বাচন কমিশন (ইসি) ৯ কোটি স্মার্ট কার্ড তৈরি করতে চুক্তি করে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ওবার্থু’স টেকনোলজিসের সঙ্গে। চুক্তি অনুযায়ী, ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয়। এরপর সময় বাড়ালেও প্রতিষ্ঠানটি কাজ করে দিতে পারেনি।

পরে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে নিজেরা বাকি কাজ শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইসি। চুক্তি বাতিল করলেও ইসির কাছে টাকা দাবি করে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি। তাদের দাবির মুখে টাকা দিতে রাজি হয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে ইসির জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগ।

গতকাল বুধবার ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি-এডিক বোর্ডিনের মধ্যস্থতায় রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত নির্বাচন ভবনে ইসির সঙ্গে ওবার্থু’স টেকনোলজিসের বৈঠক হয়। বৈঠকে ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি ৩৫১ কোটি ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৩১৭ টাকা দাবি করলেও সমঝোতার ভিত্তিতে ২১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা দিতে রাজি হয় কমিশন।

ফ্রান্সের এই প্রতিষ্ঠানটির ব্যর্থতার কারণে বাংলাদেশের সব ভোটাররা এখন পর্যন্ত স্মার্ট কার্ড পাননি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা না নিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতা করে টাকা দিতে যাচ্ছে ইসি। প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা না নেওয়াসহ যাবতীয় বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।

বৃহস্পতিবার দুপুরে নির্বাচন ভবনে সাইদুল ইসলাম তার নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সামনে বিষয়টির ব্যাখ্যা তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠান ওবার্থু’স টেকনোলজিসের সঙ্গে আমাদের চুক্তি ছিল ৯০ মিলিয়ন (৯ কোটি) স্মার্ট কার্ড তারা তৈরি করে দেবে। ফ্রান্স বা চায়না থেকে মানসম্পন্ন কার্ড তারা সরবরাহ করবে। সেই কার্ড এখানে আসবে এবং আমাদের কেন্দ্রে পারসোনালাইজেশন হবে। কার্ডগুলো আমাদের উপজেলা/থানা নির্বাচন কার্যালয়ের কাছে হস্তান্তর করব। এই উপজেলা/থানা নির্বাচন কার্যালয় পর্যন্ত হস্তান্তরের দায়িত্ব ছিল ওবার্থু’স টেকনোলজিসের।

এই দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের সঙ্গে আমাদের একটা চুক্তি হয়। সেই চুক্তির অংশ হিসেবে পুরো দায়িত্ব বুঝে নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। এই কার্যক্রমের জন্য তাদের সঙ্গে ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের (৮৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকা) চুক্তি ছিল। তাদের ১৮ মাসের চুক্তির সময়ের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয় তারা। এই চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যে তারা ১১.৩ মিলিয়ন স্মার্ট কার্ড দিতে পেরেছিল। পারসোনালাইজেশন ও ডেলিভারি সবই ১০ মিলিয়নের (১ কোটির) নিচে ছিল। সামগ্রিকভাবে তাদের ব্যর্থতা ছিল ৯০ ভাগ।

যেহেতু বিদেশি কোম্পানি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন তাদেরকে আরেকবার সুযোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে এক বছরের চুক্তি বৃদ্ধি করা হয়। ২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। এই মেয়াদে শেষে স্মার্ট কার্ড আনার ক্ষেত্রে তাদের সফলতা ভালো ছিল। ৭৭.৩ মিলিয়ন কার্ড আমাদের সরবরাহ করে তারা। কিন্তু তারা স্মার্ট কার্ড পারসোনালাইজেশন করতে পারছে মাত্র ১২.৮ শতাংশ। এ ক্ষেত্রেও তারা কাজটি শেষ করতে সক্ষম হয়নি। এখানেও তাদের ব্যর্থতা প্রায় ৮৭ শতাংশ। আর উপজেলা পর্যন্ত তারা ১০ দশমিক ২ শতাংশ স্মার্ট কার্ড সরবরাহ করে।

এই পুরো কার্যক্রম, বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এদের সঙ্গে আর চুক্তি না বাড়ানোর। ২০১৭ সালের ২৩ জুলাইয়ের দিকে সিদ্ধান্ত হয়, তাদের সঙ্গে আমরা আর কোনো কাজ করব না। প্রকল্প বন্ধ না করে আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করি, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের যে টেকনিক্যাল টিম, এক্সপার্ট, আইটি এক্সপার্ট এবং প্রকল্পের যে জনবল আছে, এগুলোকে সম্পৃক্ত করে এই প্রকল্প কীভাবে এগিয়ে নেওয়া যায়। এই হিসাবে আমরা একটা চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করি। যথেষ্ট সফলতার সঙ্গে বাংলাদেশের সন্তানদের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হই।

ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি ৩০ মাসে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ কার্ড পারসোনালাইজেশন করতে পেরেছিল। অর্থাৎ প্রতি মাসে তারা কার্ড পারসোনালাইজেশন করত গড়ে ৪ থেকে ৫ লাখ। কিন্তু আমাদের নিজস্ব তত্ত্বাবধানে করাতে প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ কার্ড পারসোনালাইজেশন করতে সক্ষম হই। আউটসোর্সিং না কিংবা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, নির্বাচন কমিশন নিজেরা করতে সক্ষম হয়েছে এই কাজ।

চুক্তি অনুযায়ী ওবার্থু’স টেকনোলজি ৭৭ দশমিক ৩ মিলিয়ন কার্ড আমাদের সরবরাহ করেছে। এই প্রকল্পের প্রায় ৫৯ শতাংশই কার্ডের মূল্য। কার্ডের মূল্যটাই বেশি। স্মার্ট কার্ডের সঙ্গে আনুষঙ্গিক যেসব যন্ত্রপাতি, মেশিন অন্যান্য যেসব জিনিস দিয়েছিল, সেসব দেনা-পাওনা নিয়ে আমাদের আলোচনা। দফায় দফায় সভা করে আমরা চেষ্টা করি, এই লিগ্যাল ইস্যু, আর্থিক ইস্যুগুলো আমরা কীভাবে সমাধান করতে পারি।

এই সমস্যার সমাধান যদি না করতে পারে, প্রথম পদক্ষেপ ছিল সমঝোতা। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো অ্যাডজুডিকেশন এবং তার পরের ধাপ আরবিট্রেশন। এই আরবিট্রেশন হবে আন্তর্জাতিক আদালতে। আরবিট্রেশন করলে আমাদের জন্য ব্যয়সাপেক্ষ। আমরা চেষ্টা করেছি অ্যাডজুডিকেশন ও সমঝোতার মাধ্যমে যদি সমাধান করা সম্ভব হয়, তাহলে আমরা সেটার মাধ্যমে চেষ্টা করব। যদি ব্যর্থ হই, সর্বশেষ আমরা আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনের জন্য যেতাম।

এরই অংশ হিসেবে আমরা তাদের সঙ্গে সমঝোতা করতে বিভিন্ন সময় সভা করি। আমাদের সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ ছিল গ্যারান্টির সব টাকা আমরা কৌশলে, বৈধভাবে নিজেদের আওতায় নিয়ে এসেছি।

সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে স্মার্ট কার্ডের যে টাকাগুলো ছিল, সেগুলো আমি দিইনি। তাদেরকে বলেছি, কার্ড দেন, টাকা দেব। যখন দেখতে পাচ্ছি, তাদের সঙ্গে আমরা আরবিট্রেশনে যেতে পারি, তারপরও তাদের কার্ডের টাকাটা ধরে রেখেছি। ওই টাকা আমি পরিশোধ করে দেব।

৯০ মিলিয়নের মধ্যে বাকি থাকা কার্ডগুলোও আমাদেরকে দিতে হবে প্রতিষ্ঠানটির। সেই স্মার্ট কার্ড ইতোমধ্যে প্রস্তুত। কিন্তু সেগুলো যদি আমরা না আনি, তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হব। দ্বিতীয়ত, সেগুলো না আনতে পারলে আমাদের নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। আমরা তাদেরকে বলেছি, আমরা এই টাকা পরিশোধ করব। কিন্তু তাদের কাছে বাকি থাকা কার্ডগুলোও ফেরত দিতে হবে, যাতে করে কোনো কার্ড যেন বাইরে না যায়। কার্ডের মান নিশ্চিত করে আমাদের হাতে দিতে হবে। তারপর আমরা চিন্তা করব, তাদের দাবি থেকে আমরা কত টাকা দেব। তা না হলে আমরা আন্তর্জাতিক আরবিট্রেশনে যাব।

৫৬ মিলিয়ন থেকে কমিয়ে ২৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে গ্রহণ করতে বাধ্য করি। এই ২৬ মিলিয়ন ইউএস ডলার দিয়ে আমাদের সব দেনা-পাওনা মেটাতে সক্ষম হয়েছি। আমরা মনে করি, এটা বাংলাদেশের বিজয়। কার্ড ও অন্যান্য যেসব জিনিস আমরা প্রতিষ্ঠানটির কাছে পাব, সেগুলো বুঝে পেলে আমরা আগামী ২০ ডিসেম্বরের মধ্যে টাকাগুলো তাদেরকে ফেরত দিব।’

ফ্রান্সের প্রতিষ্ঠানটি সময় নষ্ট করেছে, যথাসময়ে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয়েছে– এমন এক প্রশ্নের জবাবে সাইদুল ইসলাম জানান, সে জন্যই প্রতিষ্ঠানটিকে দাবি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হয়নি।

ইসি সূত্রে জানা যায়, ৯ কোটি স্মার্ট কার্ড তৈরির চুক্তি হয় ফ্রান্সের ওবার্থু’স টেকনোলজিসের সঙ্গে। চুক্তির মূল্য ছিল ৮৬১ কোটি ৯০ লাখ টাকা (১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।

চুক্তির শুরুতে ওবার্থু’স টেকনোলজিসকে ২৯৫ কোটি ৭৫ লাখ (৩৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) টাকা দেওয়া হয়। এরপর প্রতিষ্ঠানটি ৩৫১ কোটি ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৩১৭ টাকা দাবি করলে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন ২১৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা (২৬ মিলিয়ন ডলার) দিতে রাজি হয়।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর