হাওর বার্তা ডেস্কঃ মেঘ আর বৃষ্টি নামলেই এখন আতঙ্ক ঘিরে ধরে হবিগঞ্জের মানুষদের। আকাশ থেকে কখন কোথায় নেমে আসে বিজলি দানব বজ্রপাত। প্রতিদিনই জেলার কোথাও না কোথাও ঘটছে প্রাণহানি। গত কয়েক দিনের বজ্রপাতে জেলায় নারী শিশুসহ অন্তত ১৬ জন মারা গেছে। আহত হয়েছে আরো ১০ জন। জানা গেছে, হতাহতের বেশির ভাগই শ্রমিক, যারা মাঠে কাজ করছিলেন। বজ্রপাতে এভাবে প্রাণহানির ঘটনায় মাঠে কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করছেন শ্রমিকরা। ফলে ধান কাটাসহ বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে।
সরকার ঘোষিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বজ্রপাত গত কয় দিনে হবিগঞ্জে মূর্তিমান আতঙ্কে পরিণত হয়েছে।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, উষ্ণায়নের ফলে মেঘ তৈরির তীব্রতা বেড়েছে। পরিবেশ আগের তুলনায় উত্তপ্ত অবস্থা থেকে শীতল অবস্থানে আসতে পারছে না। আর আসতে পারলেও সময় নিচ্ছে অনেক। এতে বাষ্পায়ন ছড়াচ্ছে বেশি। বাড়ছে মেঘ তৈরির তীব্রতাও। পরিণতিতে বাড়ছে বজ্রপাতের। বাতাসে ঊর্ধ্বমুখী প্রবাহ যত দ্রুততর হয় বজ্রপাত তত বেশি মাত্রায় হয় বলে জানান তারা।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, হবিগঞ্জে গত ৩-৪ বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাড়ছে।
মেঘের পজেটিভ ও নেগেটিভ আয়ন থেকে বিদ্যুৎ সঞ্চালনকালে বজ্রের সৃষ্টি হয়। তখন মেঘের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের সম্প্রসারণ ঘটে। এতে প্রচুর ঝলকানি দিয়ে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ে বজ্র।
বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে খোলা প্রান্তর ও বজ্র নিরোধক গাছগাছালির অভাব। বিশেষ করে তালগাছ। এ জন্যই গ্রামাঞ্চলে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে।
বজ্রপাতে গত কয় দিনে হবিগঞ্জে যে ১৬ জনের প্রাণহানি ঘটেছে তার বেশির ভাগই ঘটেছে খোলা মাঠে। হাওরাঞ্চল খ্যাত বানিয়াচং উপজেলায়।
গত ১৫ দিনের পরিসংখ্যান
মঙ্গলবার (৮ মে) বেলা ১১টায় হবিগঞ্জ ফায়ার স্টেশনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় দেওয়ান মহিবুর রহমান নামে এক ব্যক্তির বাসায় বজ্রপাতে গ্যাসের মিটার পুড়ে যায়। হবিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মোঃ মনিরুজ্জামান জানান, মঙ্গলবার সকালে বিকট শব্দে বজ্রপাত হলে ওই বাসার গ্যাসের মিটারে আগুন ধরে যায়। একপর্যায়ে আগুন গ্যাস মিটার থেকে বিদ্যুৎ সংযোগে ছড়িয়ে পড়ে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেন।
এদিন সকালে চুনারুঘাট উপজেলার জুয়ালডাঙ্গা গ্রামের মনাই মুন্ডার ছেলে সুজন মুন্ডা (৩০) বানিয়াচংয়ের নোয়াখাল গ্রামের হাওরে ধান কাটতে গিয়েছিলেন। দুপুরে বৃষ্টির মধ্যে ধান কাটা অবস্থায় তার ওপর বজ্রপাত হলে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। এ সময় আহত হন তার সঙ্গে থাকা আরো দুই শ্রমিক। তারা হলেন, চুনারুঘাটের জুয়ারডাঙ্গা গ্রামের শিব প্রসাদের ছেলে গোপেশ প্রসাদ (৩০), বানিয়াচঙ্গের নোয়াখাল গ্রামের কৃষক নুরুল আমীন (৪৫)।
একই দিন দুপুরে আজমিরীগঞ্জ উপজেলার বিরাট গ্রামে জমিতে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে আহত হন বিরাট গ্রামের রাজা মিয়ার ছেলে সুরুজ আলী (৫৫)। তাদের উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আধুনিক সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
সকালে বানিয়াচং উপজেলার মুরাদপুর ইউনিয়নের হাওড়ে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে জুবাইল মিয়া (২৫) নামের এক কৃষকের মৃত্যু হয়। একই দিন হোসেনপুর গ্রামের ফিরোজা বেগম নামের এক গৃহবধূ বাড়ির আঙিনায় কাজ করার সময় বজ্রপাতে আহত হন। নিহত জুবাইল মিয়া মর্দনপুর গ্রামের মোতাহিল মিয়ার ছেলে। আহত গৃহবধূ ফিরোজা বেগম নীল হোসেনপুর গ্রামের আলতাব হোসেনের স্ত্রী। তাকে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
গত সোমবার (৭ মে) সকাল ১১টায় বানিয়াচং উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের বৃন্দা চিত্তা হাওরে ধান কাটতে গিয়ে বজ্রপাতে দুই শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ সময় আহত হন অপর এক শ্রমিক।
নিহত শ্রমিকরা হলেন, উপজেলার কবিরপুর গ্রামের মৃত নাদু বৈষ্ণবের ছেলে অধীর বৈষ্ণব (২৭) ও তেলঘরি গ্রামের বীরেশ্বর বৈষ্ণবের ছেলে বসু বৈষ্ণব (৩২)। এ ঘটনায় আহত শ্রমিক হলেন, তেলঘরি গ্রামের হরিচরণ বৈষ্ণবের ছেলে কৃষ্ণধন বৈষ্ণব (৩২)।
বৃন্দাচিত্তা হাওরে ধান কাটার সময় বজ্রপাতের শিকার হন তিন শ্রমিক। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যান অধীর বৈষ্ণব। গুরুতর আহত অবস্থায় বসু বৈষ্ণবকে নবীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। আহত কৃষ্ণধন বৈষ্ণবকে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
শুক্রবার (৪ মে) দুপুরে চুনারুঘাট উপজেলার উবাহাটা ইউনিয়নের তাউসী গ্রামে বজ্রপাতে হেনা বেগম (৩৪) নামে এক গৃহবধূর মৃত্যু হয়। তিনি ওই গ্রামের কাতার প্রবাসী সোহেল মিয়ার স্ত্রী।
একই দিন দুপুরে বানিয়াচং উপজেলার মুড়ারআব্দা গ্রামে বজ্রপাতে রনধীর চন্দ্র দাস (৪৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। মুড়ারআব্দা গ্রামের মৃত যতীন্দ্র চন্দ্র দাশের ছেলে রনধীর দুপুরে বৃষ্টির মধ্যে মুড়ারআব্দা হাওর থেকে ধান নিয়ে ফিরছিলেন।
শুক্রবার (৪ মে) দুপুরে বাহুবলে উপজেলার গুঙ্গিয়াজুড়ি হাওরে বজ্রপাতে মো. আবুল কালাম (৩৫) নামে এক কৃষক নিহত হন। এ ঘটনায় আহত হন আরো দুজন। নিহত কালাম গুঙ্গিয়াজুড়ি ইউনিয়নের উত্তর ভবানী গ্রামের সঞ্জব উল্লার ছেলে। আহতরা হলেন-একই গ্রামের কুটি মিয়ার ছেলে ছাদ মিয়া ও আফতাব মিয়ার ছেলে ওয়াজিদ উল্লা।
গত বুধবার (২ মে) সকাল ১০টার দিকে বানিয়াচং উপজেলার পৃথক স্থানে বজ্রপাতে দুই কৃষক নিহত হন। এ ঘটনায় আরো একজন আহত হয়। নিহতরা হলেন- উপজেলা সদরের বাসিয়াপাড়া এলাকার তৈয়ম উল্লার ছেলে করিম উল্লা (৬৫) ও বড়ইউড়ি গ্রামের তাহির মিয়ার ছেলে শাহীন মিয়া (২৫)। আহত জাহেদ মিয়া (৩০) বড়ইউড়ি গ্রামের নুর হোসেনের ছেলে।
গত ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বানিয়াচং উপজেলার দক্ষিণ তেলকুমার হাওরে বজ্রপাতে শামসুল হক (৪০) নামে এক ধান কাটা শ্রমিকের মৃত্যু হয়। শামসুল হক উপজেলার জাতুকর্ণপাড়ার গাজী আবদুর রহমানের ছেলে। শামসুল সকালে বৃষ্টির মধ্যে ছাতা মাথায় দিয়ে দক্ষিণ তেলকুমার হাওরে ধান কাটছিলেন। এ সময় বজ্রপাত হলে তার ছাতা ও মাথায় আগুন ধরে যায়। এ অবস্থায় স্থানীয়রা শামসুলকে উদ্ধার করে বানিয়াচং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
২৬ এপ্রিল বাহুবল উপজেলার সোয়াইয়া গ্রামের হারুণ মিয়ার ছেলে রাজু আহমেদ (১০) বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে গেলে বজ্রপাতে আহত হয়। তাকে উদ্ধার করে বাহুবল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
গত ২২ এপ্রিল বিকেলে লাখাই উপজেলার সজনগ্রামে বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির পার্শ্ববর্তী হাওরে ধান কাটছিলেন নুফুল ও আপন নামে দুই কৃষক। এ সময় বজ্রপাত হলে গুরুতর আহত হন তারা। পরে পাশের জমিতে কর্মরত শ্রমিকরা তাদের উদ্ধার করে লাখাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিলে দায়িত্বরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহতরা হলেন- সজনগ্রামের কাদির মিয়ার ছেলে নুফুল মিয়া (৪৫) ও ওই গ্রামের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে আপন মিয়া (৩৫)।
একই দিন বানিয়াচং উপজেলার হিয়ালা আগলা বাড়ি গ্রামের ফুল মিয়ার ছেলে মঈন (১২) বৃষ্টির মধ্যে বাড়ির পাশের মাঠে খেলা করছিল। এ সময় বজ্রপাতের আঘাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু।
গত ১৭ এপ্রিল সকাল ১১টায় বানিয়াচং উপজেলার পৈলারকান্দি গ্রামের আমীর আলী নামে এক কৃষকের মৃত্যু হয়। ওই দিন সকালে আমীর আলী ধান উঠানোর কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় বজ্রপাত হলে গুরুতর আহত হন তিনি। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ আধুনিক জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে এলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
বাপা হবিগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে বেশি করে উঁচু জাতের গাছ লাগাতে হবে। বজ্রপাতের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে জলবায়ূর পরিবর্তন। অবাধে বৃক্ষ নিধন, সীমানা পিলারগুলো উঠিয়ে নেয়া। মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলোর নেটওয়ার্কের জন্য ব্যবহৃত টাওয়ারগুলোও অন্যতম একটি কারণ বলে মনে করেন তিনি।
পরিসংখ্যান উদ্ধৃত করে তোফাজ্জুল সোহেল বলেন, কয়েক বছর আগেও এ রকম বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনা খুব একটা ছিল না। বিশেষ করে গত ৩-৪ বছর ধরে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বেড়েছে। তাই দ্রুত বজ্রপাত নিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।