মিঠামইন কামালপুরের হিজল-তমাল ছায়া থেকে আবারও বঙ্গভবনে আবদুল হামিদ

দ্বীন ইসলাম মিঠামইন থেকেঃ ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে আবদুল হামিদ বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আবারও নির্বাচিত হয়েছেন। গত বুধবার নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করেন। এ খবরে পুরা কিশোরগঞ্জবাসী তথা ১৩টি উপজেলার মধ্যে বইছে আনন্দের বন্যা। মিষ্টি মুখ করে তারা মিছিল ও আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন সকল গ্রামগঞ্জে । ২০১৩ সালের ২২ এপ্রিল দেশের ২০তম আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর প্রিয়ভাজন মিঠামইন উপজেলার কামালপুর গ্রামের সন্তান আবদুল হামিদ ১৯৭০ সালে প্রথম তৎকালীন ময়মনসিংহ-১৮ আসনে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর পরিবেষ্টিত জনপদ যেখানে কাদামাটি সবুজ ফসলে ঘেরা হাওরের পর হাওর এমন এক জায়গা মিঠামইন উপজেলার সদর ইউনিয়নের একটি গ্রামের নাম কামালপুর। হাওর বেষ্টিত হিজল-তমাল ছায়াঘেরা কামালপুর গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারী জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মরহুম হাজী মোঃ তায়েব উদ্দিন ও মাতার নাম মরহুমা তমিজা বেগম। আবদুল হামিদের তিন পুত্র ও এক কন্যা সন্তানের জনক। তার জ্যেষ্ঠপুত্র প্রকৌশলী রেজওয়ান আহমেদ তৌফিক এমপি তার নির্বাচনী এলাকা থেকে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

নিকলী উপজেলার তৎকালীন ইউনিয়ন মিঠামইনে কোনো উচ্চ বিদ্যালয় ছিল না। ঘোড়াউত্রা নদীঘেঁষা কামালপুর গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে আবদুল হামিদ নিকলী জিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। নিকলী জিসি উচ্চ বিদ্যালয়ে থেকে এসএসসি পাশ করে তিনি কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল কলেজে ভর্তি হন। গুরুদয়াল কলেজ ছাত্র সংসদে প্রথমে জিএস ও পরে ভিপি নির্বাচিত হন। ১৯৬১ সালে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে তিনি কারাবরণ হয়েছেন। গুরুদয়াল কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে তিনি ঢাকার সেন্ট্রাল ‘ল’ কলেজে এলএলবি পড়াশোনা শেষ করেন। রাজনীতির পাশাপাশি খ্যাতির সঙ্গে তিনি আইন পেশা চালিয়ে যান। তিনি পাঁচবার কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর তিনি কারারুদ্ধ ও নির্যাতনের শিকার হন।

১৯৫৯ সালে ছাত্রলীগে যোগ দেয়ার মধ্য দিয়ে আবদুল হামিদের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৭৮ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত তিনি কিশোরগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সাতবার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার অসামান্য গৌরব অর্জন করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে তিনি বিরোধী দলের উপনেতা, ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার হিসেবে দায়িত্বপালন করে আসছেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় তিনি স্বাধীনতা পদক পান। জানা গেছে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী আফতাব উদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার মতো আওয়ামী লীগের কোনো শক্ত প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। মিজবাহ উদ্দিন নামে অবসরপ্রাপ্ত এক জেলা জজ ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখালেও মনোনয়নপত্র দাখিলের কিছুদিন আগে তার মৃত্যু হয়। ১৯৭০ সালে এলএলবিতে ভর্তি হওয়ার জন্য ঢাকায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন আবদুল হামিদ। ওই সময় জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের যোগ্যপ্রার্থী সংকটে বঙ্গবন্ধু সেই সময় ২৫ বছর বয়সী হামিদকেই যোগ্য প্রার্থী হিসেবে মনোনীত করেন। বঙ্গবন্ধু তাকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে তৎকালীন ময়মনসিংহ-১৮ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম-নিকলী-তাড়াইল) আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে তিনি মাঠে নেমে পড়েন। সাহসী ভূমিকার জন্য ভাটির শার্দুল উপাধি দিয়ে তাকে নিয়ে এলাকাবাসী নির্বাচনী প্রচারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭০ সালে কামালপুর গ্রামের অদূরে মিঠামইন পুলিশ ফাঁড়ির সামনে নির্বাচনপূর্ব শেষ জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার পক্ষে ভোট চান। মুসলিম লীগের প্রভাবশালী প্রার্থী আফতাব উদ্দিনকে ধরাশায়ী করে দেশের সর্বকনিষ্ঠ জাতীয় পরিষদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিতহন আবদুল হামিদ। এরপর তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

কামালপুর গ্রামের কাদামাটি-জলে বেড়ে ওঠা আবদুল হামিদ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে কিশোরগঞ্জের প্রতিটি থানা, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও গ্রাম-গঞ্জ ঘুরে বেড়িয়েছেন। তার নেতৃত্বে এ অঞ্চল গড়ে ওঠে আওয়ামী লীগের দুর্ভেদ্য দুর্গ হিসেবে। এখানকার মা-মাটি ও মানুষের সঙ্গে গড়ে ওঠে তার প্রাণের সম্পর্ক। নির্মোহ রাজনীতির পথ বেয়ে কামালপুরের হিজল-তমাল ছায়া থেকে বঙ্গভবনে প্রবেশ করেন তিনি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর