হজ: ইতিহাস ও বর্তমান

প্রতি বছর জিলহজ মাসে সারা বিশ্ব থেকে ২০ লক্ষাধিক ধর্মপ্রাণ মুসলমান হাজির হন মক্কায়। ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হজ পালন করতে ছুটে যান তারা। বংশ, গোত্র, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে এক পোশাকে প্রার্থনা করেন সৃষ্টিকর্তার অনুগ্রহ। তাদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়- লাব্বায়েক আল্লাহুম্মা লাব্বায়েক। লাব্বায়েক লা শারিকা লাকা লাব্বায়েক। ইন্নাল হামদা ওয়ান্নিমাতা লাকা ওয়াল মুলক। লা শারিকা লাক। অর্থাৎ আমি হাজির, হে আল্লাহ আমি হাজির, আমি আপনার দরবারে হাজির। আপনার কোন অংশীদার নেই। আমি হাজির। নিশ্চয়ই সকল প্রশংসা, অনুগ্রহ আর রাজত্ব আপনারই। আপনার কোন শরিক নেই। লাখো মানুষের ‘লাব্বায়েক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয় রাসুলুল্লাহ (সা.) এর পবিত্র ভূমি। অজানা এক চুম্বকের টানে যেন ছুটে আসেন তারা। অবশ্য ইসলামিক ধর্ম বিশ্বাস এবং একতার অন্যতম প্রকাশ। জীবদ্দশায় একবার হজ পালন করা শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম সকল মুসলিমের জন্য হজ পালনীয় কর্তব্য। আর্থিক সক্ষমতার ওপর জোর দেয়ার কারণ এটা নিশ্চিত করা যে একজন মুসলিম সর্বপ্রথম তার পরিবারের ভরণপোষণ ঠিকভাবে করবে। আর শারীরিকভাবে সুস্থ এবং সক্ষম হওয়ার প্রয়োজনীয়তার উদ্দেশ্য হলো, প্রলম্বিত সফরের পরিশ্রম করাটা যাদের জন্য কষ্টসাধ্য তাদের এ বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় দেয়া। একজন মুসলিমের জীবনে হজ পালন করাটা অনন্য এক মুহূর্ত। প্রতিটি মুসলিম জীবদ্দশায় অন্তত একবার হজ পালনের স্বপ্ন দেখেন। চন্দ্রবর্ষের ১২তম মাস জিলহজ মাসের ৯ তারিখ থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ পর্যন্ত ৫ দিন জুড়ে পালন করা হয় পবিত্র হজ।
ফিরে দেখা: পবিত্র কাবা শরিফ ও হজের ইতিহাস অতি সুপ্রসীন। বর্ণিত আছে, মহান আল্লাহপাক হযরত আদম (আ.)কে যখন দুনিয়ার পাঠান তখন এ মর্যাদাবান ঘরখানিও একই সঙ্গে পাঠিয়েছিলেন। কালের আবর্তনে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহীম (আ.)কে কাবাগৃহের মেরামতের দায়িত্ব দেয়া হয়। হযতর ইব্রাহীম (আ.) এ দায়িত্ব পালনের পর আল্লাহপাক তাকে হজ পালনের জন্য দুনিয়ার মানুষকে আহ্বান জানানোর নির্দেশ দেন। এরপর থেকে কালের পরিক্রমায় পালিত হচ্ছে হজ। হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর সময় হজ নতুন মাত্রা লাভ করে। গত শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত মক্কায় সফর করতে পারা মানুষের সংখ্যা ছিল কম। এর কারণ ছিল, কষ্টসাধ্য ও দীর্ঘ সফর এবং খরচ। বিশ্বের দূর-দূরান্তের রাষ্ট্রগুলো থেকে আসা হজযাত্রীদের অনেক সময় ১ বছর বা তার থেকেও বেশি সময় লেগে যেত মক্কায় পৌঁছুতে। দীর্ঘ এ যাত্রার সময় অনেকে পৌঁছানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। অনেকে মারা গেছেন মক্কায়। হজসংক্রান্ত বিষয়বস্তুগুলোর উন্নতি হতে শুরু করে বাদশাহ আবদুল আজিজ ইবনে আবদুল রহমান আল সৌদের সময়ে। আধুনিক সৌদি আরবের প্রতিষ্ঠাতা তিনি। হজযাত্রীদের নিরাপত্তা, সুস্থতা ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। এছাড়া, আবাসন, সাস্থ্যসেবা ও যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়নে বিভিন্ন সেবা চালু করার পদক্ষেপ নেয়া হয়। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সময় থেকে শুরু করে হজ পালনের আচারগুলো অপরিবর্তিত রয়েছে। কিন্তু বর্তমান সময়ে হজযাত্রীদের জন্য হজের যেসব ব্যবস্থা, পরিবেশ এবং সুবিধা রয়েছে তেমনটা অতীতে ছিল না। হজযাত্রীরা তখন জানতেন তাদের অনেক কষ্ট করতে হবে। এ পরিশ্রমকে তারা হজের অংশ হিসেবেই নিয়েছিলেন। তারা জানতেন কষ্টসাধ্য এ সফর করে হজে গিয়ে আবার হয়তো ফিরে নাও আসতে পারেন। একারণেই অনেক মুসলিম হজে যাওয়ার আগে তাদের স্বজন বা পরিবারের বিশ্বস্ত কাউকে তাদের মৃত্যু-পরবর্তী উইল বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে যেতেন। বর্তমানে মুসলিমরা অনেক সহজে ও স্বাচ্ছন্দ্যে হজ সম্পন্ন করে থাকেন। সৌদি আরবে পৌঁছে তারা উষ্ণ অভ্যর্থনা পান। সর্বোচ্চ আধুনিক এবং কার্যকর সেবা তাদের দেয়া হয়। এসব কারণে আজকের দিনের হজযাত্রীদের সুযোগ রয়েছে হজের আধ্যাত্মিক দিকে সম্পূর্ণ মনোনিবেশ করার।
ভ্রাতৃত্বের মিলনমেলা: হজ পালন করাটা একজন মুসলমানের জীবনে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক মুহূর্ত। এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান তার নিজের সঙ্গে সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’আলার সম্পর্ক এবং এ পৃথিবীতে তার অবস্থান নিয়ে স্পষ্টতর উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হন। এর মধ্য দিয়ে একজন মুসলমান শুধু ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ সম্পন্ন করেন তাই নয়; তিনি যে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষের বিরাট মুসলিম উম্মাহর উল্লেখযোগ্য অংশ সেটাও উপলব্ধি করেন। সৌদি আরবে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই এ অনুভূতিটা আসে হজযাত্রীদের। বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তারা ইহরামের পোশাক পরিহিত লাখো মানুষের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করে। নিজের অবস্থান, পরিচয় অভিন্ন হয়ে যায় প্রত্যেকের সঙ্গে। সেলাইবিহীন দু টুকরো সাদা সুতি কাপড়ে আবৃত থাকে সবাই। এখানে একজন ব্যক্তির সামাজিক বা আর্থিক অবস্থান অপরজনের থেকে আলাদা করার কোন সুযোগ নেই। ধনী, মধ্যবিত্ত, দরিদ্র, জাতি, বর্ণ সব বিভেদ এখানে বিলীন হয়ে যায়। এখানে সবার একটাই পরিচয় থাকে। সেটা হলো- একজন মুসলমান। পোশাক আশাকের ভিত্তিতে যাচাই করার তুলনায় প্রত্যেকে শুধু একে অপরের চেহারায় পার্থক্য দেখতে পান। পৃথিবীর বুকে প্রায় সকল জাতি আর জাতীয়তার মানুষকে দেখতে পাওয়া যায় হজের এ মিলনমেলায়। আরব, বাংলাদেশী, ভারতীয়, চীনা, স্প্যানিশ, জাপানিজ, ফরাসি, মার্কিনি, বৃটিশ আরও অনেকে। এমন বিভিন্ন জাতি এবং জাতীয়তার মানুষদের সঙ্গে দিন, রাত, সপ্তাহ পার করেন হজযাত্রীরা। সম্পূর্ণ অপরিচিত ও ভিনদেশী সব মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া আর আস্থার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আর এর পেছনে কারণ একটাই। তা হলো তারা সবাই এক আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে একসঙ্গে হজ পালন করছেন। ভ্রাতৃত্বের অনন্য এক নজির হজের এ মিলনমেলা।
হজের আচারসমূহ: জিলহজ মাসের ৯ তারিখ সুর্যোদয়ের পর ২০ লক্ষাধিক হজ আদায়াকারী আরাফাতের ময়দানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আনুমানিক ৮ মাইল পাড়ি দিয়ে তারা পৌঁছান আরাফাতের ময়দানে। পথে তারা মুজদালিফাহ পার করেন। নিমারা মসজিদে গিয়ে অনেকে জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন। রাসুসুল্লাহ (সা.) এটা করেছিলেন। আরাফাতের উদ্দেশে যাত্রায় মাঝ-সকালের গিয়ে হজযাত্রীরা বিরাট সমতল ভূমির নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন। তাপমাত্রা ৯০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের কাছাকাছি হওয়া সত্ত্বেও মনে হয় পুরো এলাকাটি ঘনকুয়াশায় আবৃত হয়ে আছে। এমন দৃষ্টিভ্রমের কারণ হলো ৫০ ফুট দূরত্বে ৩০ ফুট উচ্চতার পিলারগুলোর ওপরে স্থাপন করা হয় পানি ছেটানোর যন্ত্র। পরিবেশ শীতল রাখার মাধ্যমে হজযাত্রীদের যাত্রা সুবিধাজনক করার জন্য এ ব্যবস্থা। পানি ছিটানোর যন্ত্রগুলো থেকে ছড়ানো পানির কারণে কুয়াশাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। যাত্রা পথে হাজারো রেফ্রিজারেটেড ট্রাক থেকে লাখ লাখ ঠাণ্ডা পানির বোতল সরবরাহ করা হয় হজযাত্রীদের। এসব পূর্বসতর্কতা সত্ত্বেও অনেকে গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমন ক্ষেত্রে সাইরেন দেয়ার ব্যবস্থা রাখা আছে। অসুস্থ ব্যক্তিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে শত শত অ্যাম্বুলেন্স। জরুরি চিকিৎসা সেবা দিতে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ ক্লিনিকগুলোতে। অসুস্থতা অনেক গুরুতর হলে, সেক্ষেত্রে হেলিকপ্টারে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। হজযাত্রীদের সারা দিন আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করতে হয়। এখানে তারা জাবালে রহমত পাহাড় দেখতে যান। কৃত গুণাহ ও অপরাধের জন্য সৃষ্টিকর্তার ক্ষমা ও অনুগ্রহ প্রার্থনা করেন। হজযাত্রীদের খাওয়ার জন্য এখানেও ব্যবস্থা রাখা আছে। এছাড়াও রয়েছে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ব্যবস্থা। সুর্যাস্তের পর বিশাল এ জনসমুদ্র মুজদালিফার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন। পূর্ব দিগন্তে সূর্য ওঠা পর্যন্ত তারা এখানে অবস্থান করেন। এখান থেকে হজযাত্রীরা ৭ টুকরো পাথর সংগ্রহ করেন এবং তা মিনায় নিয়ে যান। মিনা উপত্যকায় পৌছানোর পর তারা ‘জামারত’ নামের পাথরের স্তম্ভের কাছে যান। জামারত শয়তানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। এখানে হজযাত্রীরা সংগৃহীত পাথর টুকরোগুলো আকাবার পাথরের স্তম্ভগুলোতে ছুড়ে মারেন। একইসঙ্গে মহান আল্লাহ তা’আলার প্রশংসা করেন তারা। এটা শয়তানকে প্রত্যাখ্যান করার প্রতীকী একটি আচার। পাথর ছোড়ার পর হজযাত্রীরা মক্কার দিকে অগ্রসর হন। ভিড়ের মধ্যে দিকনির্দেশনা সহজ করার জন্য বিভিন্ন ভাষায় সংকেত দেয়া থাকে। আনুমানিক ৪ মাইল হাঁটার পর হজযাত্রীরা মক্কায় পৌঁছান। মক্কায় গিয়ে তারা পবিত্র ক্বাবা শরীফ তাওয়াফ করেন। ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করেন ক্বাবা। এরপর ‘সাঈ’ সম্পন্ন করেন তারা। সাঈ হলো সাফা ও মারওয়া পাহাড়ের মধ্যে সাতবার দৌঁড়ানো বা হাঁটা। সাফা মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আবদ্ধ স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এরপর পুরুষ হজযাত্রীরা তাদের মাথা মুণ্ডন করেন। অবশ্য মেয়েদের মতো ছেলেরাও চুলের কিছু অংশ কেটে হজের এ অংশ সম্পন্ন করতে পারেন। এরপর হজপালনকারীরা পবিত্র ঈদুল আজহার পশু কোরবানি করেন। আর কোরবানির গোশত দেয়া হয়ে দরিদ্রদের। আধুনিক কসাইখানায় প্রতি বছর ৬ লাখেরও বেশি পশু কোরবানি করা হয়। একই স্থাপনার মধ্যে ঈদের তিন দিন জুড়ে কোরবানির গোশত প্রক্রিয়াজাত করা হয়। কোরবানির গোশত আনুমানিক ৩০টি রাষ্ট্রের দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে সম্পন্ন হয় হজের আচারসমূহ। হজ পালনকারীরা এরপর ইহরামের পোশাক ছেড়ে স্বাভাবিক কাপড় পরিধান করেন। কিন্তু তারা ঈদুল আজহা উদযাপনের জন্য মিনাতে থেকে যান। ঈদুল আজহার মধ্য দিয়ে হজের সম্পন্ন হওয়া নির্দেশ করে। এর পরের দুদিন ধরে হজ পালনকারীরা জামারতের তিনটি স্তম্ভে পাথর ছুড়েন। সব শেষে মক্কা শহর ছাড়ার আগে প্রত্যেকে ‘তাওয়াফ আল বিদা’ সম্পন্ন করেন। বেশিরভাগ হজযাত্রীই এরপর মদিনাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) এর রওজা মোবারক জিয়ারত করতে যান। মসজিদে নববীতে নামাজ আদায় করেন। মসজিদে নববীতে যাওয়া হজের অংশ না হলেও প্রত্যেক মুসলিমই চান একবার হলেও রাসুলুল্লাহ (সা.) এর রওজা মোবারকে যেতে।
আধ্যাত্মিক এক সফর: পৃথিবীর বুকে সবচেয়ে বড় বার্ষিক জনসমাবেশ হজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে আর কোন অভিজ্ঞতার তুলনা হয় না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হজযাত্রীদের মধ্যে এখানে কোন বিরোধ থাকে না। বিন্দুমাত্র কলহ-বিবাদের কোন ছিটেফোটা এখানে নেই। সদাচার আর একে অপরকে সাহায্য করাটাই এখানে স্বাভাবিক চিত্র। পুরো হজের সময়জুড়ে হজযাত্রীদের মধ্যে শুধু শান্তি, ভক্তি ও ভ্রাতৃত্বের পবিত্র অনভূতি বিরাজ করে। হজের শেষে হজযাত্রীরা অনুভব করেন যে তারা জীবন-রূপান্তরকারী এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার স্বাদ নিয়েছেন। আল্লাহর নির্দেশ পালন করতে সক্ষম হওয়ার তৃপ্তি তো আছেই। নিজের ভেতরে বিনম্রতা, প্রশান্তি আর অন্যরকম শক্তির জন্ম নেয়; যার প্রভাব থাকে সারা জীবন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর