জাকির হোসাইন ঃ কিশোরগঞ্জ জেলার একটি বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে যে, এর একটি বিশাল এলাকা বছরের প্রায় ৬ মাস পানিতে ডুবে থাকে। কিশোরগঞ্জের ১৩ টি উপজেলার মধ্যে মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, ইটনা ও নিকলী অধিক বন্যাপ্রবন হাওর অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। তাছাড়া বাজিতপুর কুলিয়ারচর ও করিমগঞ্জের অংশবিশেষও হাওর এলাকার অন্তর্ভুক্ত। কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর এলাকা গেইটওয়ে নামে খ্যাত। সীমানা দক্ষিণে অষ্টগ্রাম থানা, উত্তরে মিঠামইন, উত্তর-পূর্ব কোণে ইটনা, উত্তর-পশ্চিমে কটিয়াদী, পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা। নিকলী হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরও অনেক হাওর রয়েছে। যেমন হুমাইপুর হাওর (বাজিতপুর), সোমাই হাওর (অষ্টগ্রাম), বাড়ির হাওর (মিঠামইন), তল্লার হাওর (বাজিতপুর-নিকলী-অষ্টগ্রাম), মাহমুদুর হাওর (নিকলী), সুরমা বাউলার হাওর ইত্যাদি। কিশোরগঞ্জ এলাকার বিশাল হাওর একদিকে যেমন মিঠা পানির বিশাল ভান্ডার তেমনি প্রচুর মৎস সম্পদে ভরপুর। হাজারো জীববৈচিত্রের পাখি জলজ উদ্ভিদ এবং মুক্তাসহ ঝিনুক রয়েছে হাওরের সর্বত্র। হাওর এলাকায় রিজার্ভার নির্মাণসহ পানি বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশাল সুযোগ রয়েছে।
প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য :
হাওর-বাওর ও সমতলভূমির বৈচিত্র্যময় ভূ-প্রকৃতির একটি বিস্তীর্ণ জনপদ কিশোরগঞ্জ। এজন্য একে বলা হয় ভাটির দেশ। জেলার সর্বত্র যেন সবুজ শ্যামলিমায় আচ্ছন্ন। প্রকৃতির এক অপরুপ মিলন ঘটেছে হাওর অঞ্চলে। শীতকালে যে এলাকা শুকনো কিংবা বালুচর,বর্ষাকালে সেখানে এমন জলধারা যে দিগন্ত বিস্তৃত চারদিক জলে থৈ থৈ করে। শুধু জল প্রবাহই নয় প্রচন্ড ঢেউ আছড়ে পড়ে দ্বীপ সদৃশ্য ভূ-খন্ডে। জলরাশিতে দ্বীপের মত গুচ্ছ গ্রামগুলো ভাসতে থাকে । শুনলাম, বর্ষাকালে যে হাওড়ের পাগল করা ঢেউয়ের দোলায় হাওরের এমন শুষ্ক প্রান্তরগুলোও উত্তাল হয়ে উঠে যেখানে শুকনো মৌসুমে পানি থাকেনা একফোটাও। তখন যতদুর চোখ যায় শুধু বোরো ধানের শীষ বা সোনা রাঙা ধানের সুবিপুল প্রয়ানময় উদ্বেলিত করে। কোন বছর অকাল বন্যা হলে কৃষককূল বোরো ফসল হারিয়ে কপালে হাত দিয়ে বসে আর্তনাদ করে। শীতকালে হাওর অঞ্চলে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখিদের আগমন হাওর অঞ্চলে নতুন ভাবে প্রাণ সঞ্চার করে।
অব্যাহত নদী ভাঙ্গন :
শুনলাম যে, কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত ব্রহ্মপুত্রের অব্যাহত ভাঙ্গনে নয়টি গ্রামের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। ভাঙ্গনকবলিত গ্রামগুলো হচ্ছে- দক্ষিণ চরটেকী, চরআলগী, চরপাড়াতলা, মুনিয়ারীকান্দা, নয়াপাড়া, চরকাওনা, চরকুর্ষা, মির্জাপুর ও বাহাদিয়া। গত এক বছরে উল্লেখিত গ্রামগুলোর ছয় শতাধিক ঘরবাড়ি ও দুই হাজার একর ফসলি জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নিঃস্ব হয়েছে অন্তত চার শতাধিক পরিবার। সর্বস্ব হারিয়ে অনেকেই আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকেরই চোখে-মুখে হতাশার হাতছানি। দুবেলা দুমুঠো খাবার পাওয়া ও ঘরের নিচে রাত্রি যাপন করা একমাত্র চাওয়া। বছর জুড়েই ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ভাঙ্গনের এই খেলা চলে। বর্ষাকালে তা ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। বর্তমানে নদীর পানি হ্রাস পাওয়ার কারণে উল্লেখিত গ্রামগুলোতে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। প্রতিদিনই ঘরবাড়ি, ফসলি জমি ও গাছপালা ভাঙ্গছে। এখনও হুমকির মুখে রয়েছে কয়েক হাজার ঘরবাড়ি, শিক্ষা, ব্যবসা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। গ্রামবাসিদের আতঙ্কে দিন কাটছে।
প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মান :
হাওর উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব মতে, হাওরবাসি তাদের আয়ের ১/১৬ অংশ ব্যয় করেন এ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মানে। এ প্রতিরক্ষা দেয়াল ঢেউ এর আঘাতে লন্ড-ভন্ড হয়ে, কাঠ কুঠুরির মতো সব হাস মুরগি গরু বাছুর ভেসে যায়। অনেক বাড়িতে ঘরের চাল দাঁড়িয়ে আছে, ভিটে মাটি, ঘরে বেড়া নেই। ঘরের চাল ছুয়ে পানি পরে। ঘরে বাইরে মানুষ পানিতে নাকানি চুবানি খায়। আবার কোন কোন বাড়ি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। প্রতি বছরই এরূপ ভাঙ্গনে গ্রাম গুলোর অস্তিত্ব বিলীনের পথে। ইতিমধ্যেই অনেক গ্রাম ভেঙ্গে বিলীন হয়েছে, কমছে গ্রামগুলোর আয়তন। হাওর এলাকার ভীটের জায়গা বড়ই মহা-মূল্যবান, দামী। হাওরের ঢেউ এর আঘাত উপেক্ষা করে নতুন বাড়ি তৈরী, বাড়ানো ও টিকিয়ে রাখা বড়ই কষ্টসাধ্য কাজ। একটু খোলা মাঠ বড়ই দুর্লভ। ভীটের মাটি বন্যায় সরে গিয়ে, বেড়া বিহীন ঘরের ভাঙ্গা খুটি দাঁত বেড় করে উপহাস করায় বড়ই মানবেতর জীবন যাপন করতে বাধ্য হয় হাওরবাসি। কারণ, বর্ষাকালে হাওর-ভাটি বাংলায় বাঁশ-কাঠ, চাইল্যা, দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়ে। দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ বেড়ে যায় দাম, দুর্লভও বটে। ফলে গরিব ও খেটে খাওয়া মানুষদের বাড়িতে প্রতিরক্ষা দেয়াল দেয়া সম্ভব হয় না। অপ্রতিরোধ্য ভাঙনে চোখের সামনেই তাদের বাড়িঘর ভেঙে ভেসে যায়। এ ভীটে ঘর ভরাট ও পুন:নির্মাণ অনেক সময় সম্ভব হয়ে উঠে না। হলেও ঋণ কর্জে জর্জরিত নিষ্পেষিত হতে হয়।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া :
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, ঘন ঘোর অমানিশা, মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ঝড়, অবিরাম বৃষ্টি, ধমকা হাওয়া, ঝির-ঝির বৃষ্টির সাথে প্রচন্ড বেগে প্রবাহমান বাতাস। ফলে হাওরের জলরাশিতে সৃষ্টি হয় উথাল চাঁন কপাইল্যা ঢেউ। এ পরিস্থিতিকে গাদলা দিন বলে। বাদলা দিন হতেই হয়ত ঘাদলা দিন এর উদ্ভব হয়েছে। সৃষ্ট বড় বড় এ ঢেউকে আফাল বলে। যা আছরে পরে দ্বীপসম গ্রামে, আঘাত করে একের পর এক। স্রেুাতের অনুকুলে উত্তর দিকের বাতাস বড়ই ভয়াবহ। এতে ঢেউ এর ভাঙ্গণের গতি. ক্ষমতা ও তীব্রতা অনেক বেশী থাকে। আফাল শব্দটি বিশ্লেষণ করলেই এর ভয়াবহতা, ধ্বংস ক্ষমতা বুঝা যায়। আ মানে আপদ, ফা মানে ফাঁড়া এবং ল মানে লন্ডভন্ড। আফাল এর তাফালিং বিপদ ঢেকে আনে, সব কিছু লন্ড-ভন্ড করে দেয়।
দুর্ভোগে হাওরবাসি :
অসংগঠিত হাওরবাসি ন্যায় সংগত অধিকার হতে বঞ্চিত; বহুমূখী সমস্যা, ভোগান্তি ও প্রতারণা তাঁদের নিত্য সঙ্গী । শুধু ধান, মৎস্য ও পাথর সম্পদ দিয়ে হাওর জাতীয় অর্থনীতিতে যে যোগান দেয় তার কিয়দাংশ হাওর উন্নয়নে ব্যবহার করলে এতো দিনে কোন সমস্যা থাকার কথা নয়। অথচ বাঁধ ভেঙ্গে কৃষকদের ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও ধানক্ষেত ডুবে আছে পানির নিচে। পানির তোড়ে ধসে গেছে বিভিন্ন স্থানে তৈরি বেড়িবাঁধ। ক্ষেত্রবিশেষে কৃষকের স্বেচ্ছাশ্রমে তৈরি বাঁধেও শেষ রক্ষা হয়নি। বানের ঘোলাজল আর চোখের নোনাজল মিলেমিশে একাকার।অনেকে দাদন নেয়া টাকা কীভাবে শোধ করবেন তা নিয়ে গভীর হতাশায় ভোগেন।
হাওর অঞ্চলের শিক্ষা :
বৈরী আবহওয়া ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রায়ই শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকে। ফলে অনেক শিক্ষার্থী শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পরে। শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা না থাকায় অধিকাংশ শিক্ষার্থী বিদ্যালয় থেকে ক্ষুধার তাড়নায় পলিয়ে যায়। অনেক বিদ্যালয় প্রঙ্গণে খেলার মাঠ না থাকায় শিক্ষার্থীরা নিরুৎসাহিত হয়।এ এলাকার মানুষ দরিদ্র থাকায় শিশুদেরকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে চায়না। অনেক পিতা- মাতা সন্তানদেরকে গৃহস্থালি কিংবা সংসারের অন্যান্য কাজে লাগিয়ে দেয়। এমন কি ফসলের মৌসুমে ছাত্র-ছাত্রী পুরোপুরই ফসল তোলার কাজে জড়িয়ে পরে। এই অনিয়মিত অবস্থায় ছাত্র-ছাত্রীরা শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পরে এবং ঝরে পরে অনেকেই। শিক্ষক ও শ্রেণী কক্ষের স্বল্পতার কারণে উন্নত পরিবেশে শিক্ষাদান সম্ভব হয়না। শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য ও উপবৃত্তির পরিমান বৃদ্ধি করতে হবে এবং বিভিন্ন কর্মসূচীর মাধ্যমে দারিদ্রতা হৃাস করেত হবে এবং পিতা-মাতাকে সচেতন করতে হবে। নতুন বিদ্যালয় ও শিক্ষক নিয়োগ এবং শ্রেণী কক্ষসহ প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা বর্ধিত করতে হবে। বর্ষা এলেই অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রামে লিপ্ত হয় কর্ম চাঞ্চল্যহীন হাওরবাসি মানুষ। বর্ষাকালে হাওর এলাকার প্রতিটি বাড়ি জলবন্দি হয়ে পড়ে। কিন্তু আফাল তাদের ঘর বন্ধি করে রাখে। আফালের ফলে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে স্বাভাবিক চলাচল বন্ধ হয়ে পরে। অঘোষিতভাবে স্কুল, হাট বাজার, যোগাযোগ বন্দ্ব থাকে। এমনিতেই হাওরের স্কুলগুলো বর্ষায় শিক্ষার্থী/ শিক্ষকের অভাবে প্রায়ই বন্ধ থাকে।হাওর এলাকার এটি কমন চিত্র হলেও বাঁধের কারণে নিকলী সদর অনেকটাই নিরাপদ।
কিশোরগঞ্জ মিঠামইনে পর্যটন শিল্প গড়ার সম্ভাবনা :
কিশোরগঞ্জ ইতিহাস ঐতিহ্যে ভরপুর একটি জেলা। কিশোরগঞ্জ মিঠামইন থানা পর্যটন শিল্প বিকাশের ক্ষেত্রে উজ্জল সম্ভাবনা রয়েছে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অনেক লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হওয়া সম্ভব। কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় এগারসিন্দুর ঈশাখাঁর বাস জঙ্গল বাড়ি, ধর্ম প্রচারক পীর আউলিয়া ওবিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাসস্থান হিসেবে সুনাম রয়েছে। এখানে আছে দীঘি, মাজার সাদী মসজিদ, শাহ মাহমুদের মসজিদ, বেবুদ রাজার দীঘি, ভেলুয়া সন্দুরীর দীঘি ইত্যাদি। এছাড়াও রয়েছে বাংলার বার ভূইঁইয়ার অন্যতম মসনদে আলা ঈশাখাঁর বাড়ি, পরিখা মসজিদ। বর্ষার হাওরের গ্রামগুলো পানিতে টলমল করতে থাকে, অগাধ জলরাশির অনুপম সৌন্দর্য দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষন করতে পারে। মানুষ হাওরেও ঢেউ দেখার জন্য হাওরে ছুটে আসবে। কিশোরগঞ্জ হাওরেও সৌন্দর্যকে ব্যবহার করে দর্শনীয় স্থান গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
তাছাড়া কিশোরগঞ্জের পাবলিক লাইব্রেরী বত্রিশের পরামানিকের দীঘি, ঐতিহাসিক পাগলা মসজিদ, সেকান্দার নগর সাহেব বাড়ি, কিশোরগঞ্জ হর্টিকালচার সেন্টার। কিশোরগঞ্জ শহরের নীলগঞ্জে বাংলার প্রথম মহিলা কবি চন্দ্রাবতির বাড়ি, হয়বতনগর দেওয়ান বাড়ী, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া মাঠ, সদরেও যশোদলের রাজা গোবন ও কালকা বাড়ি, হোসেনপুরের গোবিন্দপুরে অবস্থিত গাঙ্গাটিয়ার জমিদার বাড়ি, সদরের বৌলাই সাহেব বাড়ি, তাড়াইলের জাওয়ার সাহেব বাড়ী, শাহ সেকান্দারের মাজার,অষ্টগ্রামের দেওয়ান বাড়ি, ইটনার দেওয়ান বাড়ী,মিঠামইনের দিল্লীর আখড়া, নিকলীর প্রাচীন গুরুই মসজিদ ইত্যাদি এখনো মানুষের দৃষ্টি কাড়ে।
বাজিতপুরে ভাগলপুরে অবস্থিত দেশের শ্রেষ্ঠ ধনী জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ভাগলপুর দেওয়ান বাড়ী, সরারচরে লেংটা সাধুর আশ্রম, এছাড়াও রয়েছে ভৈরবে অবস্থিত সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেতু, হোসেনপুরে খুরশীদ মহল সেতু অত্যন্ত আকর্ষণীয়, পাকুন্দিয়ার হযরত পীরে কামেল আব্দুল হেলিম রঃ, কুলিয়ারচরের হযরত মাওলানা আকতার উদ্দিন শাহ, কটিয়াদীর হযরত শামসুদ্দিন রঃ মাজার।
নিকলীকে ঘিরেও পর্যটনের সম্ভাবনা রয়েছে। কিশোরগঞ্জে ১২২টিহাওর রয়েছে।নিকলীতে আছে মাহমুদপুর হাওর, নিকলী, সুরমা বাউলার হাওর।হাওর-বাঁওড়সমৃদ্ধ কিশোরগঞ্জ জেলার একেবারে কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত নিকলী উপজেলা। জেলা সদর থেকে ২৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই নিকলীতে রয়েছে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা। নিকলীর হাওরের অপরূপ সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহকে ঘিরে এখানে গড়ে উঠতে পারে একটি পর্যটন কেন্দ্র।
নিকলী উপজেলা সদরকে রক্ষার জন্য রয়েছে পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ বেড়িবাঁধ। বর্ষাকালে এই বাঁধে চারিদিক থেকে সমুদ্রের মতো ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে। এই বেড়িবাঁধেই দাঁড়িয়ে হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। বাঁধজুড়ে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা। সারাক্ষণ পাখিদের কিচির-মিচির শব্দ। শীতকালে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে অতিথি পাখির আগমন ঘটে। সাঁঝের বেলায় মুক্তোর মালার মতো সেসব বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখির নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার সময় মুখরিত কলকাকলির কান ফাটানো শব্দ একমাত্র হাওর এলাকাতেই শোনা সম্ভব। এছাড়া এ উপজেলায় রয়েছে অনেক পুরাকীর্তি।
বেড়িবাঁধের পাশে বসার জন্য কিছু সংখ্যক বেঞ্চ ইতিমধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। বর্ষাবিলাস নামে একটি অবসর কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবছরই বর্ষা শুরু হলে প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য নিকলী উপজেলা সদরে আসে। বর্ষায় সমুদ্র উপকূল উত্তপ্ত এবং সাগর উত্তাল থাকায় পর্যটকরা বর্ষা মৌসুমে বেড়ানোর জন্য বিকল্প স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারেন নিকলী উপজেলা সদরকে।
ভূ-প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক এতিহ্য:
হাওড় অঞ্চলের ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্র এবং আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক এতিহ্য রয়েছে । প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হাওরঞ্চল নদী সমতল ভূমি ও উঁচু ঢিবি সদৃশ জনপদ নিয়ে গঠিত। নিকলী,মিঠামইন,ইটনা ও অষ্টগ্রাম অঞ্চলের বড় হাওর নামে পরিচিত যা দক্ষিন অষ্টগ্রাম, উত্তর মিঠামইন,উত্তর পুর্বকোনে ইটনা,পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা পর্যন্ত বিস্তৃত। দক্ষিনে অষ্টগ্রামের ৭ টি ইউনিয়ন, ইটনার ৮ টি ইউনিয়ন,মিঠামইন থানার ৮ টি ইউনিয়ন এবং নিকলী থানার ৮ টি ইউনিয়ন নিয়ে বড় হাওড়ের অবস্থান। বর্ষাকালে বড় হাওরে নৌকা ভাসালে মনে হয় অকুল দরিয়া পার হতে যাচ্ছে। কুল নাই কিনার নাই শুধু অশান্ত ঊর্মিমালা উঠানামা করছে বিরামহীন ভাবে। সকালে যখন রক্তলাল সূর্যের উদয় ঘটে তখন মনে হয় ঢেউয়ের ছন্দ দোলায় রক্তিম সূর্য একবার পানির নিচে ডুবছে আবার ভেসে উঠছে। অতি প্রত্যুষে দিগন্ত বিস্তৃত নিস্তব্ধ জলরাশি ভেদ করে চারিদিকে অয়াবীর ছড়িয়ে সূর্য যখন স্বেচ্ছায় তার তেজ সংবরন করে পুর্বদিক থেকে একটি বড় লাল গোলাকৃতি বলের মত লাফিয়ে লাফিয়ে উঠতে থাকে তখন সে দৃশ্য বড়ই চিত্তাকর্ষক। সমগ্র হাওর অঞ্চল কিশোরগঞ্জের শস্য ও মৎস ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। মিঠামইন, ইটনা ও অষ্টগ্রামে ফসলী জমি রয়েছে মোট-৯০০৪০৫ হেক্টর,আবাদযোগ্য ৮৯৯৯১ হেক্টর,ভূমিহীন পরিবার ও চাষী রয়েছে ২৮৮৮১,প্রান্তিক চাষী ১৯৪৪৬, ক্ষুদ্র চাষী ১৬২০৩ এবং বৃহৎ চাষী ৪৬৮৬। তাদের জমির পরিমান নিম্নে ৪৯ শতক এবং উর্ধে ৭৫০ এরও বেশী।অর্থাৎ ভূমিহীন,ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষীর সংখ্যাই হাওড় অঞ্চলে অধিক।
জানা গেছে, একসময় ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রামে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদন করা হতো। পাশাপাশি মাছের জন্য এ উপজেলাগুলো বিখ্যাত ছিল। কিন্তু গত তিন দশকে ধানের জমিন পানিতে ডুবিয়ে যাওয়া ও বর্ষাকালের ভাঙনে এসব উপজেলার অর্ধশতাধিক গ্রাম বিলীন হয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বিভিন্ন উপজেলা ও রাজধানী ঢাকায় আশ্রয় নিয়েছে। প্রতিবছর আকস্মিক বন্যায় বোরো ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ গ্রামের মানুষ ঢাকাসহ বিভিন্ন বড় বসবাস করছে।
হাওর অঞ্চলের বিনোদন :
কিশোরগঞ্জে মিঠামইন ঐতিহ্যবাহী নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। নৌকাবাইচকে কেন্দ্র করে উপজেলা সদরসহ পুরো হাওরবাসীর মাঝে থাকে ঊৎসবের আমেজ। ছন্দের তালে তালে মাঝিদের দাড় বেয়ে নৌকা এগিয়ে নেয়ার দৃশ্য উপভোগ করে শিশু, নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার কয়েক লাখ মানুষ মিঠামইন ও আশপাশের বেশ কয়েকটি উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা বিপুলসংখ্যক লোকজন নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা দেখতে বেড়িবাঁধ সংলগ্ন সোয়াইজনী নদীর পাড়ে এসে ভিড় জমায়।
হাওরাঞ্চলের সমস্যা ও সমাধানে করণীয় :
হাওরাঞ্চলে স্যানিটেশন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। হাওর বার্তা অনলাইন পত্রিকার এক অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা যায় যে,কিশোরগঞ্জ জেলার হাওড়ঞ্চলের ৬ টি উপজেলার বর্তমানে ৩৫% পরিবার স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা ব্যবহার করছে। গড়ে ৬৫% পরিবার এখনও ঝুলন্ত পায়খানা বা কাচাঁ পায়খানা ব্যবহার করছে। জেলার হাওড়ঞ্চলে স্বাস্থ্যসন্মত পায়খানা ব্যবহারের প্রবণতা খুবই কম।বছরের ৬ মাস হাওর অঞ্চলের বিপুল সংখক মানুষ ক্ষেতখামার, ঝোপ-জংগল, পুকুর পাড়, হাওড় বাওড়, নদীর পাড়,বর্ষা মৌসুমে খোলা ও ঝুলন্ত পায়খানায় মলমূত্র ত্যাগ করে।
গবাদি পশু সংখ্যা হাওরাঞ্চলেই বেশি দেখা যাওয়া সত্বেও বায়ুগ্যাস প্লান্ট অল্পই চোখে পরে। বলা যায় হাঁস মুরগির বিষ্ঠা ও গরু গোবর তুলনামূলক বায়ুগ্যাস প্লান্ট তৈরি হলে বিদ্যুৎ এবং পরিবেশ বান্ধব গ্যাস ব্যবহারে অধিক ফলনসহ সার্বিক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে।
বর্ষায় ভাসমান স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থার কথা ভাবা যেতে পারে।
নারীদের কর্মমুখী করে গড়ে তুলতে হবে। হাস, মুরগি, কবুতরসহ গৃহপালিত পশু পালন, সবজি উৎপাদন, মুড়ি, চিড়া, খৈ তৈরি ও প্যাকেটজাতকরণ, শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্ত ও কুটিরশিল্প খাতে নারীদের নিয়োজিত করা যেতে পারে।
উন্মুক্ত উঁচুস্থানে এমন গাছ লাগানো যেতে পারে যেসব গাছ পানিতে বেঁচে থাকে এবং বাড়ে।
নির্দিষ্ট স্থানে ঘের করে এই পোনা বড় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে পরে তা মুক্ত জলাশয়ে অবমুক্ত করা যেতে পারে। মুক্ত জলাশয়ে ঘের পদ্ধতিতে মাছ চাষ এবং ভাসমান সবজি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে।
আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে বেকারত্ব কমানো যেতে পারে।হাওর এলাকার অনেকে বছরের ছমাস বেকার থাকে। তাদের কর্মসংস্থানে কোন পদক্ষেপ নেয়া হয় নাই। অথচ উন্মুক্ত জলাশয়ে, খাড়িতে মৎস্য-মুক্তা চাষ, ভাসমান কৃত্রিম ভূমিতে, মাচায় সব্জি চাষ, কুটির শিল্পের প্রসার, হাঁস পালন, সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার বৃদ্ধি, পর্যটন শিল্প বিকাশের অফুরন্ত সম্ভাবনা রয়েছে এখানে।
গার্মেন্টস শিল্পের একটা অংশ হাওর এলাকায় স্থানান্তর করা যেতে পারে। সহজে ও সস্তায় নেী চলাচলের জন্য হাওর ইপিজেড বা শিল্প পার্ক স্থাপন করা যেতে পারে।
সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ও আধুনিক ব্যবস্থা না থাকা এবং সুষ্ঠু বাজারজাতকরণের অভাবে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলায় প্রতিবছর কোটি টাকার মাছ পচে নষ্ট হচ্ছে। বরফের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে নিকলী হাওর এলাকায় প্রতিবছর গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীত মৌসুমে প্রায় এক কোটি টাকার মাছ পচে যায়।
বর্ষাকালে হাওরাঞ্চলে প্রচন্ড ঢেউয়ের আঘাতে ঘর বাড়ি ভেঙ্গে নিয়ে জানমালের প্রচুর ক্ষতি সাধন করে। এই ক্ষতি থেকে রক্ষা পেতে হলে গ্রাম প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করা একান্ত অপরিহার্য । কিন্তু অত্র এলাকার দরিদ্র মানুষ প্রতিরক্ষা দেয়াল নির্মাণ করতে পারেনা।
হাওরের মানুষের দু:খ কষ্ট লাঘবে সামাজিক ব্যবসা তথা কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অর্থনৈতিক উদ্যোগ নিতে পারলে মানুষ উপকৃত হবে।সুদমুক্ত ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের মাধ্যমে সুদখোর অর্থলিপ্সুদের হাতের পুতুল বা দাবার গুটি হওয়া থেকে গরিব নি:স্ব অসহায় মানুষদের রেহাই দেয়া সম্ভব। এমন কোন সমন্বিত খামার বা আয়বর্ধক কর্মসূচি নেয়া যায় কিনা যাতে মাছ চাষ হবে, মুরগী ও হাস থাকবে। যার মুনাফায় বেকারের কর্মসংস্থান হবে। বায়োগ্যাস প্লান্ট তৈরি করা যেতে পারে।