ঢাকা ০৪:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নানামুখী সংকটে ভোলার জেলেদের জীবন

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৩০:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অগাস্ট ২০১৭
  • ২৯৯ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গোপসাগরের লোনা জলের আঁছড়ে পড়া ঢেউ ভেঙ্গে রূপালী ইলিশ ধরা জেলেদের জীবন এখন নানামুখী সংকটে বিপন্ন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের আকাল আর ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জেলে পরিবারগুলোতে আগের মত এখন আর আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। এর উপর রয়েছে জলদস্যুদের তান্ডব আর মহাজনদের দৌরাত্ম্য। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। ঝড়ের কবলে পড়ে জীবন হারানোর মতো ঝুঁকি নিয়েই বেঁচে আছে উপকূলের কয়েক লাখ জেলে।

সূত্রে জানা যায়, মেঘনা-তেঁতুলিয়ার তীর ঘেঁষা ভোলার মনপুরা, সামরাজ, বকশী, খেজুরগাছিয়া, ঘোষেরহাট, মাদ্রাজ, বেড়িভাঙ্গা, বেতুয়া, হাজীরহাট, ঢালচর, চরপাতিলা ও চর জহির উদ্দিনের প্রায় ৫ লাখ মানুষ মৎস্য পেশার সাথে জড়িত। এদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ লাখ সরাসরি ইলিশ শিকারের সাথে যুক্ত। বাকিরা মৎস্য শ্রমিক, পাইকার, আড়তদার ও দাদনদার।

চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া মৎস্য ঘাটে দাঁড়ালে নদীর যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই সারিবদ্ধ ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের বহর দেখা যায়। শত শত সারিবদ্ধ ট্রলার ছুটে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। চাল-ডাল সঙ্গে নিয়ে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে চেপে হাজার হাজার জেলে হারিয়ে যায় গভীর বঙ্গোপসাগরে। বেতার বার্তায় যখন ঝড়ের আভাস পায় তখন আর তারা তীরে ফেরার সুযোগ পায় না। লাশ হতে হয় তাদের। দাফনের ভাগ্যও জোটে না। এদের বৌ-ছেলেমেয়েরা তীরে অপেক্ষা করে দিন কাটায়। প্রিয়জন হারানোর শোক ভুলে নিজেরাই এ পেশা বেছে নেয় অভাবের তাড়নায়। পেশার পরিবর্তন হয় না। ভাগ্যও বদলায় না। মরে গেলে সাগর তীরে তাদের সমাধি হয়। নদী ভাঙ্গনে হারিয়ে যায় সেই সমাধি। বাপ-দাদার কবর জিয়ারতের সুযোগটি পর্যন্ত পায় না জেলেরা।

এনজিওর ঋণ ও দাদন নামের অভিশাপ অথবা করুণার যাঁতাকলে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে উপকূলের জেলে জীবন। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাগর কিংবা নদীতে ইলিশ থাকে না। আবার মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকে। বছরের বিশাল এই সময় জেলে পাড়াগুলোতে চলে দুর্দিন। এ সুযোগটি বেছে নেয় দাদন ব্যবসায়ী মহাজনরা। খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এ সময় চড়া সুদে এনজিওর কাছ থেকেও ঋণ নেয় জেলেরা। স্ত্রী-কন্যার মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে নিরুপায় জেলেরা এ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করে মৌসূমের।

জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলে পরিবারগুলো। অনেকের ৮/১০ বছরের শিশু পুত্র দিনরাত উপেক্ষা করে বাঁচা-মরা লড়াইয়ে সামিল হয়। ইলিশ ভর্তি জেলে নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সাথে সাথে বাজ পাখির মত ছোঁ মারে মহাজনের লোকেরা। দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী। প্রতিবাদের শক্তি নেই জেলেদের। শুধু ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। এনজিওদের ঋণ ইলিশ মৌসূমে সুদে-আসলে পরিশোধ না করলে খাটতে হয় জেল। মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিওদের চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক জেলে। মহাজন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও জেলেদের কাছে ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু।

চরপাতিলার জেলে জসীম উদ্দিন জানান, ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, ডাকাতের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। হঠাৎ এসে এরা কেড়ে নেয় জেলেদের সর্বস্ব। মৎস্য শিকারে যাবার পর স্বামীর চিন্তায় ঘুমায় না জহুরা। আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তার উৎকণ্ঠা। না জানি কখন হানা দেয়ে জলদস্যু। কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু। জাল-বৈঠা নিয়ে ক্ষান্ত হবে তো। নাকি তার স্বামীকে মারধর করে গাঙ্গে ফেলে দেবে। পাথরঘাটা উপকূলের এ চিন্তা শুধু জহুরার নয়। ভোলার দৌলতখাঁনের বেড়ীবাঁধ থেকে শুরু করে ঢালচর’র জেলে পলীর সকল বৌ-এর একই দুশ্চিন্তা।

বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারীদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় একদল হায়না। এ হিংস্র দানবদের জেলেরা জলদস্যু কিংবা ডাকাত নামেই চেনে। মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় জলদস্যু কৃষ্ণা, বাবু বাহিনী ও ভুট্টো বাহিনীসহ তজুমদ্দিন ও কালকিনিতে রয়েছে একাধিক জলদস্যু বাহিনী। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে এরা নৌ-পথে চলাচল করে। জেলেদের জাল, নৌকা এমনকি শিকার করা ইলিশ ও ট্রলারের ইঞ্জিন পর্যন্ত এরা খুলে নিয়ে যায়। কখনো কখনো জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে সাগরে আসা-যাওয়া করেন এখানকার জেলেরা। যখনই মহাজনের ডাক আসে তখনই নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে ছোটেন গভীর সমুদ্রে। ঘরে ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়ে সাগরে গেলেও অনেকেরই আর ফেরা হয় না। দেখা হয় না প্রিয় সন্তান, স্ত্রী কিংবা বাবা-মায়ের মুখ। এতসব নানামুখী সংকট আর সমস্যা নিয়েই চলছে ভোলার জেলেদের জীবন।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

নানামুখী সংকটে ভোলার জেলেদের জীবন

আপডেট টাইম : ০৫:৩০:৩০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বঙ্গোপসাগরের লোনা জলের আঁছড়ে পড়া ঢেউ ভেঙ্গে রূপালী ইলিশ ধরা জেলেদের জীবন এখন নানামুখী সংকটে বিপন্ন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইলিশের আকাল আর ঝড় ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে জেলে পরিবারগুলোতে আগের মত এখন আর আনন্দ-উচ্ছ্বাস নেই। এর উপর রয়েছে জলদস্যুদের তান্ডব আর মহাজনদের দৌরাত্ম্য। প্রতিনিয়ত দ্রব্যমূল্যের কষাঘাতে জর্জরিত উপকূলের জেলে পরিবারগুলোর ঋণের বোঝা বেড়েই চলছে। ঝড়ের কবলে পড়ে জীবন হারানোর মতো ঝুঁকি নিয়েই বেঁচে আছে উপকূলের কয়েক লাখ জেলে।

সূত্রে জানা যায়, মেঘনা-তেঁতুলিয়ার তীর ঘেঁষা ভোলার মনপুরা, সামরাজ, বকশী, খেজুরগাছিয়া, ঘোষেরহাট, মাদ্রাজ, বেড়িভাঙ্গা, বেতুয়া, হাজীরহাট, ঢালচর, চরপাতিলা ও চর জহির উদ্দিনের প্রায় ৫ লাখ মানুষ মৎস্য পেশার সাথে জড়িত। এদের মধ্যে ৩ থেকে ৪ লাখ সরাসরি ইলিশ শিকারের সাথে যুক্ত। বাকিরা মৎস্য শ্রমিক, পাইকার, আড়তদার ও দাদনদার।

চরফ্যাশন উপজেলার চর কচ্ছপিয়া মৎস্য ঘাটে দাঁড়ালে নদীর যে দিকে চোখ যায় সে দিকেই সারিবদ্ধ ইঞ্জিন চালিত ট্রলারের বহর দেখা যায়। শত শত সারিবদ্ধ ট্রলার ছুটে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের দিকে। চাল-ডাল সঙ্গে নিয়ে ইঞ্জিন চালিত ট্রলারে চেপে হাজার হাজার জেলে হারিয়ে যায় গভীর বঙ্গোপসাগরে। বেতার বার্তায় যখন ঝড়ের আভাস পায় তখন আর তারা তীরে ফেরার সুযোগ পায় না। লাশ হতে হয় তাদের। দাফনের ভাগ্যও জোটে না। এদের বৌ-ছেলেমেয়েরা তীরে অপেক্ষা করে দিন কাটায়। প্রিয়জন হারানোর শোক ভুলে নিজেরাই এ পেশা বেছে নেয় অভাবের তাড়নায়। পেশার পরিবর্তন হয় না। ভাগ্যও বদলায় না। মরে গেলে সাগর তীরে তাদের সমাধি হয়। নদী ভাঙ্গনে হারিয়ে যায় সেই সমাধি। বাপ-দাদার কবর জিয়ারতের সুযোগটি পর্যন্ত পায় না জেলেরা।

এনজিওর ঋণ ও দাদন নামের অভিশাপ অথবা করুণার যাঁতাকলে দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে উপকূলের জেলে জীবন। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সাগর কিংবা নদীতে ইলিশ থাকে না। আবার মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত উপকূলের মৎস্য অভয়ারণ্যগুলোতে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকে। বছরের বিশাল এই সময় জেলে পাড়াগুলোতে চলে দুর্দিন। এ সুযোগটি বেছে নেয় দাদন ব্যবসায়ী মহাজনরা। খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য এ সময় চড়া সুদে এনজিওর কাছ থেকেও ঋণ নেয় জেলেরা। স্ত্রী-কন্যার মুখে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে নিরুপায় জেলেরা এ ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অপেক্ষা করে মৌসূমের।

জুন মাসের শুরুতে বর্ষা ও জোয়ারের পানি দেখে আশায় বুক বাঁধে জেলে পরিবারগুলো। অনেকের ৮/১০ বছরের শিশু পুত্র দিনরাত উপেক্ষা করে বাঁচা-মরা লড়াইয়ে সামিল হয়। ইলিশ ভর্তি জেলে নৌকা ঘাটে ভিড়ানোর সাথে সাথে বাজ পাখির মত ছোঁ মারে মহাজনের লোকেরা। দরদাম ঠিক হয় মহাজনের ইচ্ছানুযায়ী। প্রতিবাদের শক্তি নেই জেলেদের। শুধু ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে। এনজিওদের ঋণ ইলিশ মৌসূমে সুদে-আসলে পরিশোধ না করলে খাটতে হয় জেল। মহাজনের দাদনের টাকা ও এনজিওদের চড়া সুদের ঋণের টাকা শোধ করতে না পেরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে অনেক জেলে। মহাজন, বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের চেয়েও জেলেদের কাছে ভয়ংকর রুদ্রমূর্তি হচ্ছে জলদস্যু।

চরপাতিলার জেলে জসীম উদ্দিন জানান, ঝড়-বন্যার তবুও আলামত পাওয়া যায়, ডাকাতের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। হঠাৎ এসে এরা কেড়ে নেয় জেলেদের সর্বস্ব। মৎস্য শিকারে যাবার পর স্বামীর চিন্তায় ঘুমায় না জহুরা। আকাশে মেঘ নেই, গাঙ্গে বানের কিংবা তুফানের আলামত নেই। তবুও তার উৎকণ্ঠা। না জানি কখন হানা দেয়ে জলদস্যু। কেড়ে নেয় তাদের সবকিছু। জাল-বৈঠা নিয়ে ক্ষান্ত হবে তো। নাকি তার স্বামীকে মারধর করে গাঙ্গে ফেলে দেবে। পাথরঘাটা উপকূলের এ চিন্তা শুধু জহুরার নয়। ভোলার দৌলতখাঁনের বেড়ীবাঁধ থেকে শুরু করে ঢালচর’র জেলে পলীর সকল বৌ-এর একই দুশ্চিন্তা।

বঙ্গোপসাগরে ইলিশ শিকারীদের পাশাপাশি ঘুরে বেড়ায় একদল হায়না। এ হিংস্র দানবদের জেলেরা জলদস্যু কিংবা ডাকাত নামেই চেনে। মেঘনা-তেঁতুলিয়ায় জলদস্যু কৃষ্ণা, বাবু বাহিনী ও ভুট্টো বাহিনীসহ তজুমদ্দিন ও কালকিনিতে রয়েছে একাধিক জলদস্যু বাহিনী। অত্যাধুনিক অস্ত্র নিয়ে এরা নৌ-পথে চলাচল করে। জেলেদের জাল, নৌকা এমনকি শিকার করা ইলিশ ও ট্রলারের ইঞ্জিন পর্যন্ত এরা খুলে নিয়ে যায়। কখনো কখনো জেলেদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করা হয়।

জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করে সাগরে আসা-যাওয়া করেন এখানকার জেলেরা। যখনই মহাজনের ডাক আসে তখনই নৌকা কিংবা ট্রলার নিয়ে ছোটেন গভীর সমুদ্রে। ঘরে ফিরে আসার মনোবাসনা নিয়ে সাগরে গেলেও অনেকেরই আর ফেরা হয় না। দেখা হয় না প্রিয় সন্তান, স্ত্রী কিংবা বাবা-মায়ের মুখ। এতসব নানামুখী সংকট আর সমস্যা নিয়েই চলছে ভোলার জেলেদের জীবন।