হাওর বার্তা ডেস্কঃ বানোত (বন্যা) সউক ভাসি গেইচে। অষ্টাশি সালের বানোতেও হামার এমন সর্বনাশ হয় নাই। রৌদত (রোদ) ধানগাছ পচি গন্ধ বাইর হইচে। এবার মরণ ছাড়া হামার উপায় নাই। মরার বানোত মানুষ নিঃস্ব হয়া গেল। বউ-ছইল নিয়া না খায়া দিন যাইবে। ’ আঞ্চলিক ভাষায় গতকাল রবিবার দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার মধুপুর ইউনিয়নের বিলেরপাড় এলাকার চাষি লাবলু মিয়া (৪৬)। টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তাঁর ক্ষেতের সব আমনের চারা পচে গেছে। তাঁর মতো একই অবস্থা নাওপাড়া এলাকার কৃষক রফিকুল ইসলামের (৫০)। তিনি এবার দুই একর জমিতে আমনের চারা রোপণ করেন। কিন্তু সর্বনাশা বন্যায় সব আমন ক্ষেত শেষ।
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মোর ধানের সউগ চারা পচি গেইচে। এক জাগা থাকি ৮০টা ধানের গোছা এক হাজার টাকা দিয়া কিনি আনছি। এখন শ্যাষ বেলা কেমন ধান হইবে কায় জানে। ’ একই চিত্র উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নের। এ ছাড়া বন্যার পানিতে ভেসে গেছে ৩৪৪টি ছোট-বড় পুকুরের প্রায় চার কোটি টাকার মাছ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, পানি কমে যাওয়ায় বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। এখন চারদিকে শুধু ক্ষতির চিহ্ন চোখে পড়ে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটগুলো ভেঙে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে কোনোমতে চলাচল করছে মানুষ। বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে বানভাসি মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে। উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো হচ্ছে বদরগঞ্জ পৌর শহরের গরুহাটি, থানাপাড়া, মাস্টারপাড়া, জাদুনগর, শাহপাড়াসহ অন্তত ১০টি গ্রাম। মধুপুর ইউনিয়নের নাওপাড়া, রাজারামপুর, বগুড়াপাড়া, পাকার মাথা ও চিকারপাড়া। পাকের মাথা বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের ঘৃলাই ও ওসমানপুর। রামনাথপুর ইউনিয়নের বানুয়া, মাসানডোবা, চকমোনাই ও বানুয়া মুকসিদপুর। দামোদুরপুর ইউনিয়নের চাপড়ারদোলা, জলুবর, মাছুয়াপাড়া বোয়ালী, মোস্তফাপুর ও ময়মনসিংহপাড়া। রাধানগর ইউনিয়নের ধোলাই খাল ও মানসিংহপুর। লোহানীপাড়া ইউনিয়নের চাপড়ারদোলা, মালতোলা, কচুয়া ও শাহপাড়া। গোপালপুর ইউনিয়নের নান্দিনার বিল ও ছালাটানা দোলা। কালুপাড়া ইউনিয়নের শংপুর এলাকার বরাইবাড়ী, মাঝিপাড়া, সরকারপাড়া, বেলপাড়া, বৈরামপুর এলাকার নরসুন্দরের পাড়া, কবিরাজপাড়া ও মাস্টারপাড়া। গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বুড়িরহাট ও বালাডাঙ্গা। মধুপুর ইউনিয়নের মাস্টারপাড়ার চাষি মকমেল হোসেন (৬০) এবার দুই একর জমিতে আমনের চারা রোপণ করেছিলেন। কিন্তু বন্যায় জমিতে লাগানো সব চারা পচে নষ্ট হয়েছে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘মোর তো এবার সউক শ্যাষ হয়া গেল। এখন নয়া করি আমনের চারা পামো কোনটে। আর চারা পাইলে দাম পড়বে বহুগুণ। হামার এবার কষ্ট ছাড়া উপায় নাই। না খায়া দিন যাইবে। ’ একই ধরনের কথা বলেন রাজারামপুর গ্রামের আলমগীর হোসেন (৫০)। তিনি এবার আড়াই একর জমিতে গুটি স্বর্ণা জাতের আমনের চারা বুনেছিলেন। কিন্তু বন্যার পানিতে সব তলিয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘কী করি খামু, তার উপায় থাকবে না। উঁচা জমি হইলে রবিশস্য চাষ করা যাইত। কিন্তু দোলা (নিচু) জমিতে কোনো ফসল হবার ন্যায়। এখনো কায়ো হামার জমির ক্ষতি দেইখপার আইসে নাই। ’
লোহানীপাড়া ইউনিয়নের মানুষ এবারের বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার। সেখানকার চেয়ারম্যান রাকিব হাসান ডলু শাহ জানান, তাঁর এলাকায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার একর জমির ফসল পানির নিচে ডুবে আছে। ওই ইউনিয়নের কাঁচাবাড়ী গ্রামের হাজীপাড়ার কৃষক মোস্তাফিজার রহমান (৫৫)। এবার তিনি সাত একর জমিতে আমনের চারা রোপণ করেন। কিন্তু আশপাশে বন্যার পানি নেমে গেলেও এখনো যমুনাশ্বরী নদীর পানিতে তলিয়ে আছে তাঁর ক্ষেত। একই ইউনিয়নের শাহপাড়ার চাষি ওবাইদুল হকের চার একর জমির আমনের চারা পচে নষ্ট হয়েছে। ওবাইদুল হক বলেন, ‘বাবা কপালোত কান্দোন ছাড়া উপায় নাই। এখন ধানের চারা লাগানোর শ্যাষ সময়। বেছন পামো কোনটে। ’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুবার রহমান বলেন, ‘বন্যায় প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির আমনের চারা পানিতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ছয় হাজার ৫৭৫ হেক্টর জমির আমনের চারা একেবার পচে গেছে। উঁচু জমির অবশিষ্ট চারা তুলে চাষিদের নতুন করে রোপণ করতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।