হাওর বার্তা ডেস্কঃ ষাট বছর বয়সী চানবানুর ঘর ছিল। এখন নেই। কয়েক দিন আগে হাওরের ঢেউ কেড়ে নিয়েছে তাঁর ঘর। এরপর তাঁর ছেলে চলে গেছেন ঢাকায়, রেখে গেছেন পাঁচ সন্তান। তাদের নিয়ে এখন পরের ঘরে চানবানুর বাস। এরপর থেকে চানবানুর দুশ্চিন্তার শেষ নেই। মনের মধ্যে খেলা করে কত প্রশ্ন? কত দিন এভাবে পরের ঘরে থাকতে হবে? এমন সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দিশেহারা এই বৃদ্ধ নারী। তাঁর গ্রামের নাম সন্তোষপুর। সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নে অবস্থিত।
চানবানুর মতো সুনামগঞ্জের আরও চারটি উপজেলায় অন্তত ২০টি পরিবারের খোঁজ মিলেছে, ঘর হারিয়ে যেসব মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছেন। গত ১০ দিন সুনামগঞ্জের শাল্লা, দিরাই, তাহিরপুর, জামালগঞ্জ ও ধরমপাশার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম ঘুরে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আবার গত বৃহস্পতিবার থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত জেলার তাহিরপুর, সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক ও জামালগঞ্জ উপজেলায় ১৮ হাজার ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পাঁচ হাজার হেক্টর জমির রোপা আমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘরহারা এসব মানুষ বলছেন, ঋণ করে হাওরের ধান চাষ করেন তাঁরা। গেল চৈত্রে বাঁধ ভেঙে সেই ফসল গেছে পানিতে তলিয়ে। আর ঘর হারিয়ে এখন কী করবেন, তা ভাবতেই পারছেন না। অবশ্য ঘরহারা এসব মানুষকে সরকারি সহায়তায় আবার ঘর তৈরি করে দেওয়ার কথা জানালেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. সাবিরুল ইসলাম। এই জেলা প্রশাসকের ভাষ্য, যেসব মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে যাচ্ছে, এর তালিকা হচ্ছে। এসব ঘরবাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে।
চলতি বছর জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮২ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ হয়। এর মধ্যে ১৫৪টি হাওরের ধান তলিয়ে যায় পানিতে। সরকারি তথ্য বলছে, পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬১২ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। আর হাওরের পানিদূষণে মারা গেছে ১ হাজার ২৭৬ টন মাছ। যে মাছের মূল্য প্রায় ৪১ কোটি টাকা। হাওর অঞ্চলের লোকেরা ঢেউকে বলে আফাল। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামগুলো আঁটি নামে পরিচিত। আঁটি হলো বিপুল জলরাশির মধ্যে একখণ্ড জমি। যেখানে ৫ থেকে ৫০টি পরিবার বসবাস করে থাকে। বর্ষাকালে প্রায় প্রতিবছরই নদী আর হাওরের ঢেউয়ে বাড়িঘরে ভাঙন দেখা দেয়। এবারও হাওর এলাকায় ভেঙেছে ঘরবাড়ি।
নাসিমা খাতুন এখন থাকেন পরের ঘরে। অথচ এক মাস আগে চোখের সামনে তাঁর প্রিয় ঘর চলে যায় নদীর গর্ভে। তাঁর মতো আরও ১৫ জনের বাড়ি বিলীন হয়ে গেছে নদীতে। ঘর হারিয়ে এসব মানুষ এখন দিশেহারা। এই গ্রামের নাম ভূঁইয়ারহাটি। এটি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। গত বুধবার সরেজমিনে দেখা গেল, নদীর তীর থেকে মাত্র এক থেকে দুই হাত দূরে আছে অন্তত পাঁচটি ঘর। নদীতে ঢেউয়ের তেজ ছিল। যেকোনো সময় এসব ঘরবাড়ি নদীতে ভেঙে পড়তে পারে। ঘরহারা নাসিমা বলছিলেন, ঘর গেছে নদীতে। পরের ঘরে থাকেন। ঘরে খাবার নেই। নাসিমার মতো তাহিরপুর উপজেলার জয়পুর নয়াহাটি গ্রামের হিরু মিয়ারও একই অবস্থা। দুই মাস আগে হাওরের ঢেউ কেড়ে নিয়েছে তাঁর ঘর। পরের ঘরে স্ত্রী আর পাঁচ সন্তান নিয়ে বড় কষ্টে দিন কাটছে তাঁর। হিরু মিয়ার ভাষ্য, হাওরে মাছ মেরে কোনো রকম সংসার চালাচ্ছেন। বাড়ি বানানোর ক্ষমতা তার নেই। ৪০ হাজার টাকা ঋণ করে ঘর বানান। সেই ঋণ তিনি শোধ দিতে পারেননি।
হাওরের ফসলডুবির পরপরই ‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন’—নামের একটি সংগঠন ফসলহারা মানুষের পক্ষে আন্দোলন করে আসছে। সংগঠনটির আহ্বায়ক বজলুল মজিদ চৌধুরী বলছেন, ফসলডুবির পর সুনামগঞ্জে অন্তত ৫০০ জন ঘরবাড়ি হারিয়েছে। এলাকায় নতুন করে বন্যা আঘাত এনেছে। এতে ঘরহারা মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এটা বাড়তেই থাকবে। এসব মানুষের পুনর্বাসন দরকার। এমনিতে তাদের ঘরে এখন খাবার নেই। তারপর ঘরবাড়ি না থাকায় এসব মানুষ বড় বিপদে আছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের শিক্ষক গওহার নঈম ওয়ারা প্রথম আলোকে বলেন, ঘরহারা এসব মানুষের তালিকা করে বিনা সুদে অবিলম্বে তাদের ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারিভাবে ঘর তৈরির সরঞ্জামাদি দিতে হবে। এসব মানুষের কথা ভুলে গেলে চলবে না।