হাওর বার্তা ডেস্কঃ ইউরোপে অবৈধভাবে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা বহিষ্কার আতঙ্কে আছে। তাদের সুনির্দিষ্ট সংখ্যা না জানা গেলেও সংশ্লিষ্টদের ধারণা, এ সংখ্যা এক লাখেরও বেশি হতে পারে। সরকারি সূত্রগুলো বলছে, অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশকে চাপ দিচ্ছে। এমনকি ইউরোপে অবৈধ বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে বাংলাদেশ দেরি করলে তাদের পাঠিয়ে দেওয়ারও হুমকি দিচ্ছে। ইইউয়ের এমন কঠোর অবস্থানে আতঙ্ক বাড়ছে অবৈধভাবে অবস্থানরতদের মধ্যে।
নরসিংদীর রায়পুরার মির্জারচর ইউনিয়নের আজম মোল্লার ছেলে মিজান মোল্লা পরিবারে সচ্ছলতা আনতে তিন বছর আগে লিবিয়ায় যান। সেখানে এক বছর থাকার পর স্থানীয় এক দালালের প্ররোচনায় তুরস্ক হয়ে সাগরপথেই গ্রিসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাড়ি দেন গ্রিসে। সেখানে ছয় মাস থেকে আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে তিনি যান ইতালিতে।
এর পর থেকে সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় কাজ নেন। ভালোই আয় করছিলেন তিনি। কিন্তু অবৈধদের দেশে ফেরত পাঠানোর খবর শোনার পর থেকে তাঁর দুশ্চিন্তার আর শেষ নেই।
মিজান মোল্লা গত রবিবার দুপুরে বলেন, ‘জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে এসেছি পরিবারে সচ্ছলতা আনতে। সাগরপথে ইউরোপে আসার সময় সহযাত্রীদের অনেকেই মারা গেছেন। কিন্তু যদি আবার দেশেই ফিরে যেতে হয় তাহলে সব স্বপ্নই ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। ’ তিনি বলেন, লিবিয়া-তুরস্ক হয়ে ইউরোপে আসতে দালালদের দিতে হয়েছে ১০ লাখ টাকারও বেশি। সেই টাকা দেশ থেকেই ধারদেনা করে জোগাড় করতে হয়েছিল। কিন্তু এখন দেশে ফিরতে হলে মরা ছাড়া উপায় নেই। বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ইইউয়ের সঙ্গে আলোচনা করে আমাদের ইউরোপেই রাখার ব্যবস্থা করা। ’
মিজান মোল্লার মতোই লিবিয়া-তুরস্ক হয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছান ঢাকার সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের আব্দুল খালেকের ছেলে রমজান আলী। তিনি এখন জার্মানির ডুসেলডর্ফ শহরের একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন। জার্মানিতে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলেন, তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
রমজান আলী বলেন, ‘লিবিয়া, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের নাগরিকদের আবেদন গ্রহণ করছে জার্মানি। কিন্তু বাংলাদেশিদের অধিকাংশ আবেদনই নাকচ করে দিচ্ছে এবং জার্মানি ছেড়ে চলে যেতে বলছে। হয়তো আগামী সপ্তাহেই আবারও ইতালি চলে যাব। লুকিয়ে লুকিয়ে যত দিন থাকা যায়!’
এ দুজনের মতো আতঙ্কে আছে অবৈধভাবে ইউরোপে ঢোকা অন্য বাংলাদেশিরাও। তাদের অনেকেই তুরস্ক-লিবিয়া হয়ে প্রথমে ইতালি কিংবা গ্রিসে ঢুকে পরে ইইউয়ের অন্য কোনো দেশে যাওয়ার কৌশল নেয়। কিন্তু অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে ইউরোপের কঠোর অবস্থানের কারণে এখন সব কিছুই কঠিন হয়ে গেছে। অবৈধ বাংলাদেশিদের প্রত্যাশা, দেশে ফেরত না পাঠিয়ে ইউরোপেই তাদের থাকার ব্যবস্থা করা হোক। তবে তা কতটা সম্ভব হবে তা নিয়েই সংশ্লিষ্টদের শঙ্কা আছে।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়া আশ্রয়প্রার্থীদের মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশিরা। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এভাবে বাংলাদেশের দুই হাজার ৮০০ জন বাংলাদেশি ইতালিতে গেছে। ইইউ এখন অবৈধ সবাইকে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশকে তাগিদ দিচ্ছে।
গত বছরের এপ্রিলে ঢাকা সফরের সময় ইইউ প্রতিনিধিদল ইউরোপে ৮০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশি থাকার কথা বলেছিল। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত আট বছরে ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি ইউরোপের দেশগুলোতে অবৈধভাবে প্রবেশ করেছে। তবে প্রবাসীরা বলছে, প্রকৃত অর্থে অবৈধ প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা কয়েক গুণ বেশি হতে পারে।
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জানান, ইউরোপ থেকে অবৈধদের যদি ফেরত পাঠাতেই হয় তবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেই পাঠাতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের উচিত, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে জোরালো অবস্থান নেওয়া। তা না হলে তাদের পরিবারগুলোই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে দালালদের প্ররোচনায় পড়ে বাংলাদেশিরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ পাড়ি দিচ্ছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সতর্ক হওয়া উচিত। ইউরোপে অবৈধভাবে কর্মী যাওয়ায় দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
বাংলাদেশের একজন কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের বিদ্যমান আইন ও নীতিমালা অনুসরণ করেই অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হবে বলে ইইউকে জানানো হয়েছে। তার আগে ওই ব্যক্তিদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ব্যাপক যাচাই-বাছাই করতে চায় ঢাকা। এ কাজে যেটুকু সময় প্রয়োজন, বাংলাদেশের তা পাওয়া উচিত। শুধু বাংলাদেশি নয়, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারাও অসাধু উপায়ে বাংলাদেশি পাসপোর্ট সংগ্রহ করে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তারাও বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে।