আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বিভিন্ন খাতে বিপুল অঙ্কের অর্থ নয়ছয় করছে এসব প্রতিষ্ঠান। সিন্ডিকেটসহ বিভিন্ন কমিটির বৈঠকের সম্মানী, নামে-বেনামে কেনাকাটা, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমাকৃত স্থায়ী আমানত থেকে অর্থ উত্তোলন ও ঋণ গ্রহণসহ কয়েকটি খাতে খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরাই এ অর্থ লুটপাট করছেন। এছাড়াও আরও ১৬ ধরনের একাডেমিক, প্রশাসনিক অনিয়ম ধরা পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের তদন্ত রিপোর্টে। ইউজিসি এ রিপোর্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে জমা দিয়েছে। সার্টিফিকেট বিক্রি, সিন্ডিকেটের নামে অর্থ আত্মসাৎ, গবেষণার নাম করে এ খাতে টাকা উত্তোলনসহ আরও অনিয়মের উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির কাছে দেয়া ১০ পৃষ্ঠার ‘উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের বিষয়সহ সামগ্রিক চিত্র, বিচ্যুতি, উত্তরণের পন্থা’ শীর্ষক প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে। এসব সমস্যা উত্তরণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি নির্বাহী ক্ষমতা প্রদানের তাগিদ দেয়া হয়েছে সংস্থাটির পক্ষ থেকে।
বিষয়টি স্বীকার করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছেন, তাতে আর্থিক অনিয়ম, সার্টিফিকেট বিক্রি, নামে-বেনামে কেনাকাটা করার মতো অনিয়মের বিষয়টি উঠে এসেছে। বিষয়গুলোতে আমরা আলোচনা করেছি। এর প্রেক্ষিতে পরবর্তীতে আমরা ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করবো। এর আগে ২০১৪ সালে টিআইবি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৬ ঘাটে অনিয়ম হয় এমন তথ্য প্রকাশ করে। রিপোর্টে বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে সিন্ডিকেট, একাডেমিক কাউন্সিল ও অর্থ কমিটিসহ অন্যান্য কমিটির দায়িত্ব ও কার্যক্রম ট্রাস্টি বোর্ডের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে নিয়ন্ত্রিত হয়। এছাড়া, সমঝোতার মাধ্যমে নিজস্ব অন্যান্য ব্যবসা পরিচালনার ক্ষেত্র হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহার, ইউজিসিকে না জানিয়ে সাধারণ তহবিলের টাকা ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার, বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে ভুয়া কাগজপত্র ও স্বাক্ষর জাল করে ব্যাংক ঋণ গ্রহণ ও আত্মসাৎ, শিক্ষকদের পারফরমেন্স মূল্যায়নে প্রভাব বিস্তার, কম যোগ্য ব্যক্তিকে বিভাগীয় প্রধান করাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের কোন কোন সদস্য। এ রিপোর্টের আর্থিক অনিয়মসহ অন্যান্য বিষয়গুলো জানার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির পক্ষ থেকে আলাদা আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত এ রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়নি।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসব অভিযোগ আমরা গত বছর সংবাদ সম্মেলন করে বলেছিলাম। তখন শিক্ষামন্ত্রী ও ইউজিসি দুটি তদন্ত কমিটিও করেছিল। কিন্তু আজও এ প্রতিবেদনের আলোর মুখ দেখেনি। পক্ষান্তরে আমাদেরকে দোষারোপ করেছিল তারা। আমরা নাকি উচ্চ শিক্ষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছি। কিন্তু এখন খোদ ইউজিসির প্রতিবেদনের এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। তিনি বলেন, টিআইবি ও ইউজিসি পক্ষ থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি। তিনি বলেন, সরকারের নানা মহলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপের কারণে ইউজিসি অনেকটা নিরুপায়। সংস্থাটির ক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দেন তিনি।
এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটিতে প্রেরিত প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৬ ধরনের অনিয়মে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য আর্থিক অনিয়ম সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ। প্রতিবেদনে বলা হয়, অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ করেছে এবং কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় নির্ধারিত পরিমাণ অর্থ থেকে সিংহভাগ অর্থ উত্তোলন করে নিয়েছে। এ বিষয়ে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ারম্যান, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সঙ্গে আলোচনা করে সংরক্ষিত তহবিলের অর্থ বিষয় জানা এবং ঋণ পূর্ণভরণ করার জন্য আগামী ১৩ই আগস্ট সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বোর্ড অব ট্রাস্টিজদের ডাকা হয়েছে।
ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার উপ-পরিচালক জেসমিন আক্তার বলেন, কয়েকটি এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে আগামী ১৩ই আগস্ট ইউজিসিতে সকল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, বোর্ড অব ট্রাস্টিজদের সঙ্গে বৈঠক হবে। তবে আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি।
ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের শর্তে বলা আছে বিশ্ববিদ্যালয় হবে সম্পূর্ণ অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে ট্রাস্টি বোর্ড বা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোন আর্থিক সুবিধা নিতে পারবেন না। কিন্তু তাতে কী, এটিকে পাশ কাটিয়ে নানা কৌশলে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এসব টাকাকে জায়েজ করতে বের করেছেন নানা পথ। এর মধ্যে অন্যতম হলো, নামে-বেনামে কেনা কাটা, সিন্ডিকেট মিটিং এর নামে সম্মানি নেয়া, গবেষণার নামে টাকা উত্তোলন।
ইউজিসির বেসরকারি শাখার একজন কর্মকর্তা বলেন, দেড় লাখ টাকায় একজন শিক্ষকদের জন্য চেয়ার কেনা হয়েছে এমন তথ্য রয়েছে ইউজিসির কাছে। এছাড়া ল্যাবরেটরি, লাইব্রেরি সরঞ্জাম, ক্যাম্পাসে অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে কেনাকাটায় সীমাহীন অনিয়ম হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অর্থ আত্মসাৎ হয় সিন্ডিকেট মিটিংয়ের নামে সম্মানী গ্রহণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয় ৮টি ক্যাটিগরিতে মোট ১২ জন সিন্ডিকেট সদস্য থাকেন। প্রত্যেক মিটিংয়ে একজন সিন্ডিকেট সদস্যকে সাড়ে তিন লাখ টাকা দেয়া, দেশের বাইরে গিয়ে সিন্ডিকেট মিটিং করার নামে অর্থ আত্মসাৎ করার মতো রেকর্ড রয়েছে এরকম বিশ্ববিদ্যালয় আছে। কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের অধিকাংশ সদস্যরা নিয়োগ পান মালিকপক্ষের লোকজন। কখনও নিজের পরিবারের সদস্যরা। প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিল থেকে সিন্ডিকেট সদস্যরা সম্মানী বাবদ কোটি কোটি টাকা উত্তোলণ করেন।
ইউজিসির নীতিমালা অনুযায়ী, ১২ সদস্যের সিন্ডিকেটের মধ্যে সভাপতি থাকবেন ভিসি, সদস্য সচিব হবেন রেজিস্ট্রার। এছাড়া প্রো-ভিসি, ট্রেজারার, ভিসির মনোনীত একজন একাডেমিক কাউন্সিল সদস্য, একজন ডিন ও একজন বিভাগীয় প্রধান, সরকার মনোনীত একজন শিক্ষাবিদ বা শিক্ষানুরাগী, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ মনোনীত ৩ জন সদস্য এবং ইউজিসি মনোনীত একজন প্রতিনিধি। ইউজিসি কর্মকর্তা বলছেন, ট্রাস্টি বোর্ডে সদস্যরা সিন্ডিকেটের মিটিংয়ে অংশ নেয়া সদস্যকে নামমাত্র টাকা দিয়ে পরবর্তীতে পছন্দমতো টাকার পরিমাণ বসানো হয় তাদের নামের জায়গায়। কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির সদস্যের মনোনীত প্রার্থীকে নিয়োগ না দিয়ে নিজেদের পছন্দের শিক্ষক কিংবা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সিন্ডিকেট মিটিং করেন।
এ বিষয়ে ইউজিসি চেয়ারম্যান আব্দুল মান্নান বলেন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চাহিদা অনুযায়ী প্রতিবেদন দিয়েছি। এটি কমিটিতে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে তা বলতে পারবো না। সিন্ডিকেট মিটিংয়ের নামে নামে- বেনামে টাকা উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিষয়টি আমাকে আগে জানতে হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও ১৬ ধরনের আর্থিক অনিয়মে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। মোটা দাগে আর্থিক, প্রশাসনিকের বাইরে একাডেমিক দুর্র্নীতি নিমজ্জিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কয়েকটিতে লাগামহীন অবস্থায় পৌঁছেছে বলেও উল্লেখ করা হয়।
ইউজিসির প্রেরিত প্রতিবেদনের ‘গ’ উপধারায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা উল্লেখ করা হয়। সেখানে বলা হয়, স্থায়ী ক্যাম্পাস স্থাপনে নামে গড়িমসি। সামরিক অনুমতি পত্রের অন্যতম শর্ত ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর। কিন্তু ৫২ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এই সাময়িক অনুমতির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তাদেরকে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়েছে। ৫টি বোর্ড ট্রাস্টিজ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িত, সিন্ডিকেট সভায় অনিয়ম, শিক্ষক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিন্ন বেতন কাঠামো না মানা, ৬% শিক্ষার্থীদের বিনা বেতনে অধ্যয়ন করানো বাধ্যবাধ্যকতা না মানা, সংরক্ষিত তহবিলের বিপরীতে ঋণ গ্রহণ, মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি ও লাইব্রেরির অভাব, ভিসি, প্রো-ভিসি ও ট্রেজারার নিয়োগে অনীহা, গবেষণা খাতে অনীহা। গবেষণাখাতের চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা খাতে কোন অর্থ বরাদ্দ করেনি, ৪০টি বেশি নামেমাত্র গবেষণা সম্পাদন করেছে। ৯টি ক্যাম্পাস এখনও অনুমোদিত ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে, নানা অনিয়মের দায়ে সরকার বন্ধ করার পরও হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ নিয়ে ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে।
সংবাদ শিরোনাম
আর্থিক কেলেঙ্কারিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়
- Reporter Name
- আপডেট টাইম : ১২:৪৩:৩৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২ অগাস্ট ২০১৫
- ৩৫৪ বার
Tag :
জনপ্রিয় সংবাদ