হাওরের যে চিত্র আমরা এখন দেখছি- তাতে কষ্টে মনটা ভারি হয়ে ওঠে। যখন ভাত মুখে দেই, তখন কৃষকের অবদান মনে পড়ে। তাদের মলিন চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যে হাওরবাসী মাথার ঘাম পায়ে ফেলে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আমাদের চাহিদার প্রায় ১০ ভাগ চাল ও ২৮ শতাংশ মাছের জোগান দিচ্ছে, তারা আজ বিপন্ন।
বর্তমানে অনাহার-অর্ধাহারে কাটছে তাদের দিন। তার ওপর মহাজনের ঋণের বোঝা। সব মিলিয়ে গোটা হাওরাঞ্চলে এখন শুধু বোবা কান্না। অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর দশা আরও করুণ। কারণ লোকলজ্জায় তারা ত্রাণের জন্য লাইনেও দাঁড়াতে পারে না, আবার কারও কাছে হাতও পাততে পারছে না। বাধ্য হয়ে শহরমুখী হচ্ছে দিশেহারা হাওরবাসী। আদরের শিশু সন্তানদের মুখে খাবার তুলে না দিতে পেরে অন্যের বাড়িতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে।
হাওরজুড়ে এখন অসহায় মানুষের হাহাকার। সুনামগঞ্জের হাওরবেষ্টিত উপজেলা তাহিরপুরের শ্রীপুর উত্তর ইউনিয়নের বানিয়াগাঁও গ্রামের অবস্থাপন্ন কৃষক সাহেব আলী। অসময়ের বন্যা তাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে। এক সপ্তাহ আগের কথা। সাহেব আলীর ৯ সদস্যের পরিবারটি দু’দিন ধরে উপোষ থাকার পর স্ত্রী আকিজা বেগম লোকলজ্জার তোয়াক্কা না করে আঁচলে মুখ ঢেকে সাত-সকালে বাড়ি থেকে বের হয়েছিলেন ত্রাণের চালের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ভিজিডি কার্ড আনতে। কিন্তু কার্ড নিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি তার। সড়ক দুর্ঘটনায় আকিজা বেগম মারা যাওয়ার পর তার পরিবারের লোকজন জানতে পারেন, অভাবের তাড়নায় তিনি ত্রাণের জন্য লাইনে দাঁড়াতে এসেছিলেন।
বলতে গেলে গোটা হাওরের চিত্র এটি। বানের পানি প্রথমে ডুবিয়ে দিল বছরের একমাত্র ফসল। এরপর মরল মাছ। এরপর মরল হাঁস-মুরগি, ছাগল-ভেড়া। এখন মরছে স্বজন। এছাড়া অসহায় হাওরবাসীর ওপর চেপে বসেছে মহাজনের ঋণের সুদ। সুদের টাকা দিতে না পারায় ঘর খুলে নিয়ে যাচ্ছে মহাজনের লোকজন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগাম বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হাওর এলাকায় কৃষি ঋণের সুদের হার অর্ধেক এবং ঋণ আদায় আপাতত বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও যেসব কৃষক মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চসুদে ঋণ নিয়েছেন, তাদের কী হবে? বস্তুত ব্যাংক ছাড়াও অনেক এনজিও ঋণ দিয়েছে। তারা সুদের জন্য চাপ দিচ্ছে। এনজিও এবং মহাজনের ঋণের সুদের টাকার জন্য চাপ সহ্য করতে না পেরে অনেকে বাড়িঘরে তালা লাগিয়ে পাড়ি জমাচ্ছেন অজানা গন্তব্যে।
কিন্তু এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। গুটিকয়েক স্বার্থান্বেষী মানুষের জন্য আজ হাজার হাজার মানুষের নিদারুণ কষ্ট। হাওর এলাকায় আগাম বন্যা প্রতিরোধ ও নিষ্কাশন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ১২৬ কোটি টাকার পুরোটাই জলে গেছে। গত ৬ বছরে হাওর অধ্যুষিত ৬ জেলার ৫২টি হাওরের বোরো ফসল রক্ষায় এই টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞ কমিটির মতামত উপেক্ষা করা হয় প্রকল্প বাস্তবায়নে। হাওরে ৮ দশমিক ৮ মিটার পানি প্রবাহের বিপরীতে ৬ দশমিক ৫ মিটার বাঁধ নির্মাণ শুরু করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। আগাম বন্যার সময়কাল বিবেচনায় নেয়া হয়নি। বাঁধ নির্মাণ কার্যাদেশ দেয়ার ক্ষেত্রেও বিলম্ব করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
মাত্র দেড় সপ্তাহ পরেই পাকা ধান উঠত কৃষকের ঘরে। হঠাৎ বাঁধ ভেঙে সব শেষ হয়ে গেল। কৃষক এখন কী নিয়ে বাঁচবে? পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতির কথা না হয় বাদই দিলাম। পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হলে তার প্রভাব পড়তে সময় লাগে। এ কারণে পরিবেশ নিয়ে ভাবনা কমই হয়। হাওরের পানি আবদ্ধ। এই পানির দূষণ সহসাই ঠিক হওয়ার নয়, তা যতই চুন ছিটানো হোক না কেন!
যারা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি করলেন, যাদের কারণে লাখ লাখ কৃষক পরিবার পথে বসেছে, তাদের বিচার হবে- এ আশা দুরাশা মাত্র। এদের বিচার হয় না কখনও। হাওরবাসীর দেখভালের দায়িত্ব যাদের দিয়েছিল সরকার, তারা গেলেন কানাডায়, প্রমোদ ভ্রমণে। তাদের ভাষায় ‘জ্ঞান আহরণ’ করতে। তাই দুর্যোগ, ক্ষয়ক্ষতি এবং কৃষকদের সুবিধা-অসুবিধা ভালো বোঝেন এমন লোকজনদের দেয়া হোক হাওর দেখভালের দায়িত্ব, যাতে হাওরের কৃষকরা দ্রুত মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।