ঢাকা ০৮:২৭ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কিশোরগঞ্জের হাওরে কৃষকের দুর্দশা কাটছে না

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৮:৪০:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭
  • ৪৭৪ বার

নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ:
অকাল বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় চরম দুর্দশায় পড়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরবাসী। পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অনেকে। এলাকায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়া পচা ধান সংগ্রহের শেষ চেষ্টায় লিপ্ত হাজার হাজার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ। দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাধ্যমতো ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম। এমন পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছে না অনেকেই। এরই মধ্যে কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার টেঙ্গুরিয়া এলাকার কৃষক ইমাম হোসেন আর পাঁচ বছর পরই শতবর্ষে পা দেবেন। কিন্তু বানের পানি ফসল কেড়ে নেওয়ায় শেষ জীবনে এসেও দুই ছেলে আর নাতিকে নিয়ে সকাল থেকে পানিতে ডুব দিয়ে আধাপচা ধান কাটছিলেন। শীতে কাঁপছিল তার শরীর। একই সঙ্গে পানির নিচ থেকে ধান কেটে নৌকায় তুলছিল তার দুই ছেলে আফিল উদ্দিন, রহম আলী ও এক নাতি। ইমাম হোসেন জানান, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এবার তিনি ৩০ কানি জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। এসব জমিতে দেড় হাজার মণ ধান হতো। কিন্তু অকাল বন্যায় ধানের সঙ্গে যেন তার ভাগ্যও ডুবে গেছে। ইমাম হোসেন বলেন, ‘বাবা, সব তো গ্যাছেই। আমার না, বেবাকেরই গ্যাছে। না কাইট্যা তো আর পারি না। আল্লায় যহন বিপদে ফালাইছে, কী আর করবাম। পানির তলে ডুব দিয়া তাই ধান কাটতাছি। নাইলে কাইয়াম কী?’ একই উপজেলার সিংপুর গ্রামের আম্বিয়া খাতুনের কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। তিনি একজন শ্রমজীবী। স্বামী, এক ছেলে, ছেলের বউ আর এক মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘরে খাবার নেই। তিন মাস বয়সী নাতির মুখে খাবার দিতে পারছেন না। ৬৫ বছর বয়সী আম্বিয়া জানান, ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে তিনি সিলেটে ইটখোলাতে কাজ করতেন। বৈশাখে ধান কেটে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসবে, এমন ভাবনায় বাড়িতে আসেন। কিন্তু কৃষকের ধানের সঙ্গে তার পরিবারের আনন্দও ভেসে গেছে। তিনি বলছিলেন, ‘পেটে ভাত নাই। নাতিডার মুহে দুধ দিতাম পারতাছি না। ধান পানির তলে। কাম নাই। কাইয়াম কী? বাবারে অহন মরণ ছাড়া আর গতি নাই।’ কৃষক ইমাম হোসেন ও আম্বিয়ার মতো কিশোরগঞ্জের হাওরে এখন এমন দৃশ্য যেন স্বাভাবিক ঘটনা। হাজার হাজার মানুষ বোরো ধান হারিয়ে অন্তত কিছু ফসল ঘরে তোলার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত। অনেকের ঘরেই খাবার নেই। মাথায় মহাজনী ঋণের বোঝা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। সিংপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জানান, এ গ্রামের অনেকেই কাজ না থাকায় ঢাকায় চলে গেছে। তারা বিভিন্ন বস্তিতে থেকে রিকশা চালানো ও ফেরিওয়ালার কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি আগের ব্যাংক ঋণ আদায় স্থগিত ও নতুন করে ঋণ দেওয়া এবং হাওরের জলাশয়গুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানায় এলাকাবাসী। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে সরেজমিনে দেখা গেছে, অকাল বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় দিন দিন বাড়ছে কৃষকের দুর্দশা। এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার সঙ্কট। পানি নামতে শুরু করায় প্রায় বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ধান সংগ্রহের চেষ্টা করছে তারা। অন্যদিকে এনজিও আর মহাজনী ঋণের টাকা পরিশোধে চিন্তিত হাজার হাজার কৃষক। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চললেও চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। অনেকের ভাগ্যে জুটছে না ত্রাণের চাল। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, হাওরে দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে ভিজিএফ কর্মসূচি ও খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও এক লাখ কৃষককে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৬২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা। ফসলডুবিতে দেড় লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৬শ’ টন জিআর চাল ও ৩২ লাখ নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার কৃষককে ভিজিএফের আওতায় আনা হয়েছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কিশোরগঞ্জের হাওরে কৃষকের দুর্দশা কাটছে না

আপডেট টাইম : ০৮:৪০:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৯ মে ২০১৭

নূর মোহাম্মদ, কিশোরগঞ্জ:
অকাল বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় চরম দুর্দশায় পড়েছে কিশোরগঞ্জের হাওরবাসী। পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে অনেকে। এলাকায় খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। পানিতে ডুবে যাওয়া পচা ধান সংগ্রহের শেষ চেষ্টায় লিপ্ত হাজার হাজার কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষ। দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সাধ্যমতো ত্রাণ সহায়তা দিচ্ছে সরকার। তবে চাহিদার তুলনায় তা কম। এমন পরিস্থিতিতে বেকায়দায় পড়েছে শ্রমজীবী মানুষ। পরিবারের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছে না অনেকেই। এরই মধ্যে কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার টেঙ্গুরিয়া এলাকার কৃষক ইমাম হোসেন আর পাঁচ বছর পরই শতবর্ষে পা দেবেন। কিন্তু বানের পানি ফসল কেড়ে নেওয়ায় শেষ জীবনে এসেও দুই ছেলে আর নাতিকে নিয়ে সকাল থেকে পানিতে ডুব দিয়ে আধাপচা ধান কাটছিলেন। শীতে কাঁপছিল তার শরীর। একই সঙ্গে পানির নিচ থেকে ধান কেটে নৌকায় তুলছিল তার দুই ছেলে আফিল উদ্দিন, রহম আলী ও এক নাতি। ইমাম হোসেন জানান, এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে এবার তিনি ৩০ কানি জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। এসব জমিতে দেড় হাজার মণ ধান হতো। কিন্তু অকাল বন্যায় ধানের সঙ্গে যেন তার ভাগ্যও ডুবে গেছে। ইমাম হোসেন বলেন, ‘বাবা, সব তো গ্যাছেই। আমার না, বেবাকেরই গ্যাছে। না কাইট্যা তো আর পারি না। আল্লায় যহন বিপদে ফালাইছে, কী আর করবাম। পানির তলে ডুব দিয়া তাই ধান কাটতাছি। নাইলে কাইয়াম কী?’ একই উপজেলার সিংপুর গ্রামের আম্বিয়া খাতুনের কান্না যেন কিছুতেই থামছিল না। তিনি একজন শ্রমজীবী। স্বামী, এক ছেলে, ছেলের বউ আর এক মেয়েকে নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। ঘরে খাবার নেই। তিন মাস বয়সী নাতির মুখে খাবার দিতে পারছেন না। ৬৫ বছর বয়সী আম্বিয়া জানান, ছেলে ও ছেলের বউকে নিয়ে তিনি সিলেটে ইটখোলাতে কাজ করতেন। বৈশাখে ধান কেটে সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আসবে, এমন ভাবনায় বাড়িতে আসেন। কিন্তু কৃষকের ধানের সঙ্গে তার পরিবারের আনন্দও ভেসে গেছে। তিনি বলছিলেন, ‘পেটে ভাত নাই। নাতিডার মুহে দুধ দিতাম পারতাছি না। ধান পানির তলে। কাম নাই। কাইয়াম কী? বাবারে অহন মরণ ছাড়া আর গতি নাই।’ কৃষক ইমাম হোসেন ও আম্বিয়ার মতো কিশোরগঞ্জের হাওরে এখন এমন দৃশ্য যেন স্বাভাবিক ঘটনা। হাজার হাজার মানুষ বোরো ধান হারিয়ে অন্তত কিছু ফসল ঘরে তোলার শেষ চেষ্টায় ব্যস্ত। অনেকের ঘরেই খাবার নেই। মাথায় মহাজনী ঋণের বোঝা। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে কাজের সন্ধানে এলাকা ছাড়ছে অনেকে। সিংপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান জহিরুল ইসলাম জানান, এ গ্রামের অনেকেই কাজ না থাকায় ঢাকায় চলে গেছে। তারা বিভিন্ন বস্তিতে থেকে রিকশা চালানো ও ফেরিওয়ালার কাজ করছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারি সহযোগিতা বাড়ানোর পাশাপাশি আগের ব্যাংক ঋণ আদায় স্থগিত ও নতুন করে ঋণ দেওয়া এবং হাওরের জলাশয়গুলো উন্মুক্ত করে দেওয়ার দাবি জানায় এলাকাবাসী। কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন হাওরে সরেজমিনে দেখা গেছে, অকাল বন্যায় ফসল ডুবে যাওয়ায় দিন দিন বাড়ছে কৃষকের দুর্দশা। এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র খাবার সঙ্কট। পানি নামতে শুরু করায় প্রায় বিনষ্ট হয়ে যাওয়া ধান সংগ্রহের চেষ্টা করছে তারা। অন্যদিকে এনজিও আর মহাজনী ঋণের টাকা পরিশোধে চিন্তিত হাজার হাজার কৃষক। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চললেও চাহিদার তুলনায় তা খুবই কম। অনেকের ভাগ্যে জুটছে না ত্রাণের চাল। কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, হাওরে দরিদ্রদের জন্য ত্রাণ সহায়তার পাশাপাশি সরকারের কর্মসৃজন প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। ঋণের কিস্তি আদায় স্থগিত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মাঝে ত্রাণ দেওয়ার পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগে ভিজিএফ কর্মসূচি ও খোলাবাজারে চাল বিক্রি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এছাড়া পরিস্থিতি সামাল দিতে আরও এক লাখ কৃষককে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় আনতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক। কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, কিশোরগঞ্জের ১০টি উপজেলায় এ পর্যন্ত ৬২ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে গেছে। যার ক্ষতির পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকা। ফসলডুবিতে দেড় লাখ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ৬শ’ টন জিআর চাল ও ৩২ লাখ নগদ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার কৃষককে ভিজিএফের আওতায় আনা হয়েছে।