আলমগীর শাহরিয়ার
‘সুনামগঞ্জকে যারা দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তাদের কোনো জ্ঞানই নেই। কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।’ গত মঙ্গলবার রাতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবশাহ কামাল এমন মন্তব্য করেছেন।
উল্লেখ্য, ভারী বৃষ্টিপাত, পাহাড়ি আকস্মিক ঢল, পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ফলে দুর্বল ও কোথাও কোথাও নামমাত্র দেওয়া বাঁধ ভেঙ্গে অকালে হাওরাঞ্চলের বোরো ফসল পেকে আসার আগেই কাঁচা অবস্থায় তলিয়ে গেছে। ফলে, ওই অঞ্চলের কৃষকেরা অন্যান্য বছর শত শত মণ ধান ঘরে তুললেও এবার কেউ এক সের ধানও ঘরে তুলতে পারেন নি। এ ধরণের প্রাকৃতিক ও কিছুটা মন্যুষ্যসৃষ্ট বিপর্যয়ে বিক্ষুব্ধ হাওরাঞ্চলের সচেতন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত প্রান্তিক কৃষকের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে ওই অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে মানব বন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ করছেন। তাদের দাবি-দাওয়া আদায়ের আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন।
পুরো হাওরাঞ্চলে চৈত্রের প্রথমার্ধে ফসলহানির এমন ঘটনা অভাবনীয় ও অকল্পনীয়। সুনামগঞ্জের পার্শ্ববর্তী ক্ষতিগ্রস্ত কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলেরই সন্তান রাষ্ট্রপতি ক্ষতিগ্রস্থ অঞ্চল পরিদর্শন করতে যেয়ে এ কথা স্বীকার করে বলেছেন তাঁর জীবদ্দশায় এমন ঘটনা তিনি দেখেন নি। একই সঙ্গে তিনি স্থানীয় বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে মত বিনিময়কালে নিজেকে একজন কৃষকের সন্তান হিসেবে উল্লেখ করে দুর্গত মানুষের দুঃখ দুর্দশা তিনি উপলব্ধি করেন বলে জানিয়েছেন। পাশাপাশি তিনি আশ্বস্ত করেন, এ দুর্যোগ ও সংকট উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইতোমধ্যে তিনি কথা বলেছেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আরো কথা বলবেন।
কিছুটা বিলম্বে হলেও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন কারো দুর্যোগ কবলিত হাওর এলাকা পরিদর্শন ওই এলাকার মানুষকে দুঃখের দিনে কিছুটা ভরসা দিয়েছে।
কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক জায়গায় থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েরসচিব শাহ কামালের ‘কিসের দুর্গত এলাকা? একটি ছাগলও মারা যায় নি।’ – এমন হৃদয়হীন, কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্য ওই এলাকার মানুষকেও ভীষণ ক্ষুব্ধ করেছে।
তাঁর এ মন্তব্য প্রমাণ করে ওই এলাকার মানুষের দুঃখ তাঁর হৃদয়কে স্পর্শ করেনি। ব্যথিত করেনি। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সম্পর্কে তাঁর নূন্যতম ধারণা নেই। রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা ভোগ করা এ আমলা তাঁর এমন বক্তব্য দিয়ে প্রমাণ করলেন কতো নির্মম, নিষ্ঠুর আমাদের প্রশাসনের অনুভূতি। কতো দয়ামায়াহীন হয়ে উঠছে প্রশাসনযন্ত্র। একবারও মনে পড়লো না আপনার সুনিশ্চিত জীবন, নিরাপদ জীবন, বিলাসীতা, আড়ম্বরপূর্ণ জীবন, বিদেশ ভ্রমণ এসবের নেপথ্যে আছে এসব মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রম আর ঘাম। এদের দুর্যোগের দিনে রাষ্ট্রের শক্তি ও সম্পদ নিয়ে পাশে দাঁড়ানোর বদলে সমুদ্রসম দুঃখে ভেসে থাকা আশাহীন মানুষের উদ্দেশ্যে এমন বক্তব্য নির্মম রসিকতাই বটে। আপনার এ পদে থাকার আর নৈতিক কোনো ভিত্তি নেই।
আমরা ইতিমধ্যেই জেনেছি, হাওরে কাঁচা ধান পচে তৈরী হওয়া বিষক্রিয়ায় হাওরের মাছ মরে ভেসে উঠছে, সেসব মাছ খেয়ে হাস মরছে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে আশেপাশের লোকালয়ে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা আশংকা করছেন, বৃষ্টিপাত না হলে পানির এ বিষক্রিয়া মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জন্য ভয়াবহ দুর্যোগের পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে অচিরেই।
এগুলো দুর্যোগের সাময়িক দৃশ্যমান অভিঘাত।
সচিব মহোদয়, আপনার হয়তো ভাববার অবসর নেই হাওরাঞ্চলে এ দুর্যোগেরঅদৃশ্য অভিঘাত হবে সুদূরপ্রসারী। যা হয়তো কোনো গবেষণা ও পরিসংখ্যানের খাতায় উঠবে না। বাঁচার অবলম্বনহীন সংসারে যে ছেলে বা মেয়েটি বাধ্য হয়ে স্কুল ছাড়বে সে আর কখনোই স্কুলে ফিরবে না। তার একটি সুন্দর জীবনের স্বপ্ন এখন আর আয়না নয়, একটি ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোর মতো। আপনাদের সন্তানটি ঠিকই অভিজাত বিদ্যায়তনে তার শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করবে। সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়বে। শুধু আপনি জানবেন না, যে কৃষক বছরের পর বছর সন্তানের মত গৃহে সযতনে যেসব গবাদিপশুর যত্ন নিয়েছে, ওগুলো দিয়ে মওসুমে ফসল ফলিয়েছে, নানাভাবে উপকৃত হয়েছে, এবার হয়তো সেগুলোও সে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হবে। আসছে কোরবানি ঈদের জন্য কোন এক সুযোগ সন্ধানী জাত ব্যবসায়ী সেটা কিনবেঅ বেশি মুনাফার আশায় আরো মোটাতাজা করে সুরম্য বহুতল ভবনের রাজধানী শহরের কোন হাটে বিক্রি করবে। আপনার পরিচিত কোন বড়লোকেই হয়তো ঝকঝকে কাপড় পরে উৎসব মেজাজে হাটে যেয়ে এর খরিদদার হবেন, দাম হাকবেন। অথচ ঈদের দিন সে কৃষক নতুন কাপড় দূরে থাক সামান্য খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাবে। তাদের ছেলে মেয়েরা নীরবে কাঁদবে।
যে জমিতে চাষ করে হাওরের কৃষক বাঁচে সে জমিটুকুও অভাবের তাড়নায় হয়তো বিক্রি করে দেবে। যারা কিনবে তাদের আপনাদের মত কর্মকর্তাদের পরিচিত জানাশোনা রাজধানী শহরে আবাসন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে কেনা বসবাসের আরো অনেক ফ্লাট আছে। বর্ষা শেষে আসা শীতে শুধু মাথা গোঁজার ঠাঁই থাকবে না ওই সর্বস্বান্ত কৃষকের।
ফসল ঘরে তুলে কৃষক তার যে বিবাহযোগ্য কন্যাকে পাত্রস্থ করার ইচ্ছে ও প্রস্তুতি ছিল তারও বিলম্ব ঘটবে। কিন্তু আপনার পরিচিত বড়লোকদের ছেলে মেয়েদের পাঁচ তারকা হোটেলে জমকালো বিয়ে হবে আলোর জলসায়। আপনিও হয়তো এর কোনো একটাতে কালো গাড়ি চড়ে দামী গিফট নিয়ে একবেলা বউ-বাচ্চাসহ আমোদ ফূর্তিতে খেয়ে আসবেন ।
কিন্তু ঋণগ্রস্থ কৃষকের ঋণের অসহনীয় বোঝা বাড়বে। খবর পাওয়া যাবে, এনজিওয়ালাদের ঋণের কিস্তি পরিশোধের ভয়ে অনেকেই ওয়ারেন্টের আসামির মত বাড়ি ঘর ছেড়ে ভয়ে পালিয়ে থাকছে। অথচ আপনাদের পরিচিত আশেপাশে হররোজ ঘুরঘুর করেন এমন ধুরন্ধর বণিকেরা রাষ্ট্রীয় ব্যাংক থেকে শত হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা আর খুব বেশি রকমের পুচকে হলে নিদেন পক্ষে মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম অফারে বাড়ি কিনে দেশে আরো ধান্ধায় মতিঝিল ও তোপখানা রোডের আশেপাশে ঘুরবে। আপনি হয়তো জেনেও জানেন না, যারা ওখানে কৃষির সঙ্গে প্রত্যক্ষ জড়িত না তারাও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। বিপন্ন হবে। যেহেতু ওই সমাজটা হলো কৃষি অর্থনীতি প্রভাবিত একটি সমাজ।
এমন অসংখ্য সামাজিক সংকটে নিপতিত হাওরের মানুষ। যুদ্ধে বন্দুক ও বোমায় মানুষ মরলে গোনা যায়। কিন্তু যে নিরস্ত্র যুদ্ধে মরার আগেই বহু মানুষ মরে যায় সে সংখ্যা আপনি গুণবেন কিভাবে বলেন। আপনি কেবল পরিসংখ্যান চিনলেন, মানুষের হৃদযন্ত্রে অবিরাম বৃষ্টি ও চোখের জলে জমা অব্যক্ত বেদনার অনির্নেয় সংখ্যা দেখতে পেলেন না। বহুমাত্রিক রঙিন রোদ চশমা পরে আছেন আপনি। খুলে দেখুন, কত স্বচ্ছ, পরিষ্কার মানুষের বেদনা। শুধু একটি ছাগল নয়, ওই অঞ্চলে মরার আগে বহু মানুষ মরে গেছে। পরিবেশ-প্রতিবেশ বিপন্ন হয়ে গেছে।
কখনও কী শুনেছিলেন সেই গানটা-“কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়/ প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা/কতটা কান পাতলে তবে কান্না শোনা যাবে/কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে/বড্ড বেশি মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে।”
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক।