এই ব্যক্তির কথায় দেশব্যাপী দুর্যোগ নেমে আসবে

সুনামগঞ্জকে যারা দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন তাদের কোন জ্ঞানই নেই- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালের এমন বক্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর সারা জেলাজুড়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এছাড়া তার বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেইসবুকে প্রকাশিত হওয়ায় দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন সকল শ্রেণিপেশার মানুষ।
ছাতক-দোয়ারার সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাড. আব্দুল মজিদ বলেন,‘ত্রাণ সচিবের বক্তব্য কৃষকসহ সারা জেলার মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করেছে। উনি নিজেকে সবজান্তা মনে করেন যা মোটেও সঠিক নয়। বুধবারের সভায় উনার চেয়ে অনেক জ্ঞানী লোকজন উপস্থিত ছিলেন। উনার বক্তব্য আরো বিনয়ী হওয়া প্রয়োজন ছিল। উনার বক্তব্য জেলার ক্ষতিগ্রস্ত কৃষককে সরকারের বিপক্ষে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। উনার বক্তব্য প্রত্যাহার করা উচিত। ’
জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাড. রবিউল লেইস রোকেস বলেন,‘একজন সচিবের এই ধরনের মন্তব্য খুবই দুঃখজনক। প্রজাতন্ত্রের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা হয়ে এভাবে কথা বলা কোনভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।’
জামালগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ইউসুফ আল আজাদ বলেন,‘সুনামগঞ্জের দুর্যোগ নিয়ে সচিবের বক্তব্য দায়িত্বহীনতার পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এসব বক্তব্যে দুর্দশাগ্রস্ত মানুষ আরো কষ্ট পেয়েছে।’
বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাড. নিরঞ্জন তালুকদার বলেন, ‘দুর্গত সুনামগঞ্জের কৃষকদের বার্ঁচানোর স্বার্থেই সুনামগঞ্জবাসী এই এলাকাকে দুর্গত ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন। এই দাবিকারীদের দেশপ্রেম নিয়ে যে ব্যক্তি প্রশ্ন তুলে অন্তত তাকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রাখার যৌক্তিকতা নেই। আমরা মনে করি এই ব্যক্তিকে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে রাখলে দেশবাসীর জন্যই দুর্যোগ নেমে আসবে।’
তাহিরপুর উপজেলার মাটিয়ান হাওর উন্নয়ন কমিটির সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন,‘ সচিবের এমন বক্তব্যে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নতুন করে আরো খুব কষ্ট পেয়েছে। ’
শাল্লা উপজেলার বাহাড়া ইউপির ঘুঙ্গিয়ারগাঁও গ্রামের কৃষক মোজাম্মেলন হোসেন ও নাইন্দা গ্রামের কৃষক লুকেশ তালুকদার বলেন,‘আমরা ত্রাণ সচিবের বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। সচিব সাহেব দুর্যোগের সময় কৃষকদের পাশে না দাঁড়িয়ে সহমর্মিতা প্রকাশ না করে উল্টো জ্ঞান দিয়ে গেলেন। উনি যদি এলাকায় সরেজমিনে আসতেন তাহলে দেখতে ও বুঝতে পরতেন মানুষ কি অবস্থায় আছে।’
দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামের কৃষক হেলু মিয়া বলেন,‘ দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিব ঢাকায় থাকেন, তিনি হাওরের কৃষকদের দুঃখ সম্পর্কে কি বুঝেন ও কি জানেন। এসি লাগানো গাড়ি চড়েন। মোটা অংকের সরকারি বেতন পান। উনার হাওরে যদি জমি থাকত ও তলিয়ে যেত তাহলে এভাবে একটা জেলার লাখ লাখ মানুষকে নিয়ে তিনি কটাক্ষ করে বক্তব্য দিতে পারতেন না। ’
ফেইসবুক পোস্টের মন্তব্যে সুনামগঞ্জ পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মীর মোশারফ হোসেন মন্তব্য করেছেন,‘ওই সভায় উপস্থিত মাননীয় সংসদ সদস্যগণ ও সম্মানিত জনপ্রতিনিধিগণ প্রতিবাদ করেছেন কি ?
লেখক ও আইনজীবী কল্লোল তালুকদার চপল লিখেছেন,‘ব্রিটিশের পয়দা এই করণিক শ্রেণিই তো এখন সকল ক্ষমতার উৎস-রাষ্ট্রযন্ত্রের মূল চালিকা শক্তি। হর্তাকর্তা। তেনারা সর্বজ্ঞ, পরমজ্ঞানী। বাদবাকিদের তো তেনারা মূর্খ বলবেনই । এতে দোষের কী আছে !
লেখক ডা. মোর্শেদ আলম লিখেছেন, ‘ত্রাণ সচিবের এরূপ মন্তব্যের পর সুনামগঞ্জের দুর্গত জনগণের উচিত বিষ পান করে করে অর্ধেক মানুষ মরে যাওয়া যাতে আইনের সংজ্ঞা অনুসারে সুনামগঞ্জকে তিনি দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে পারেন। উনার এমন ব্যাখ্যার জন্য তাঁকে সুনামগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে ধন্যবাদ দেওয়া কর্তব্য।’
দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহবায়ক সেলিম রেজা লিখেছেন,‘এসির নিচে থেকে মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা বুঝার কথা নয় সচিব মহোদয়ের। কিন্তু আমাদের নেতাদেরতো সেটা বুঝার কথা।’
শহরের ষোলঘরের ব্যবসায়ী ও ফুটবলার কল্লোল তালুকদার লিখেছেন,‘শুধু সচিব কামাল না, তার দুসরও সৃষ্টি হয়ে গেছে। তাদের কাছেও শিখতে হবে কে কি চায়।’
জামালগঞ্জের বিনাজুরা গ্রামের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞান রঞ্জন সরকার লিখেছেন,‘ ত্রাণ সচিব গরীব অসহায় মানুষের দুঃখ বুঝবেন কি করে। তিনি এয়ার কন্ডিশনে থাকেন। উনার বক্তব্যকে ধিক্কার জানাই।’
এসএ টিভির জেলা প্রতিনিধি মাহতাব উদ্দিন তালুকদার লিখেছেন,‘এই সচিব সাগর চুরির ভাগ পেয়েছেন। ২২ ধারার বিধান উল্লেখ করে বলেছে, অর্ধেকের চেয়ে বেশী মানুষ মারা না গেলে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করা যায় না। তিনি যে ধারাটি উল্লেখ করেছেন সেটা জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। নতুবা ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ তার উচিৎ প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হবেন।’
জামালগঞ্জের মাহমুদপুর গ্রামের বাসিন্দা সমাজসেবক মো. আখতারুজ্জামান তালুকদার লিখেছেন,‘ দুর্যোগ ও ত্রাণ সচিবকে ধিক্কার জানাই। আপনি কোন কৃষকের কোলে জম্ম নেননি? আপনি কৃষকের ফলানো ভাত খাননি? আপনি হাওরের সুস্বাদু মাছ ভক্ষণ করেননি? আপনি অট্টালিকায় থাকেন বিদেশী খাবার খান। দুর্যোগ দুর্গতি কি জিনিস সেটা ঝুববেন কিভাবে ? সুনামগঞ্জের কৃষক যখন সব হারিয়ে সর্বশান্ত ঠিক তখন আপনি আমাদের নিয়ে উপহাস করছেন ?
উল্লেখ্য, বুধবার রাতে জেলা প্রশাসকের সম্মেলনকক্ষে অনুষ্ঠিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় সচিব সঞ্চালকের দায়িত্ব নিয়ে সুনামগঞ্জকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে আন্দোলনকারীদের দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তুলে এমন মন্তব্য করেন সচিব। তিনি বলেন,‘ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বলি, দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নামে একটা আইন আছে। এই আইনের ২২ ধারায় বলা হয়েছে কোন এলাকার অর্ধেকের উপরে জনসংখ্যা মরে যাওয়ার পর ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে হয়। না জেনে যারা এমন এমন সস্তা দাবি জানায় তাদের কোনপ্রকার জ্ঞানই নেই।’
সচিব আরো বলেন,‘জাতিসংঘ ও ইউনিসেফ যদি দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানায় তাহলে সেই এলাকার প্রশাসন মন্ত্রণালয়কে জানাবে। মন্ত্রণালয় তদন্ত করে মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে জানানোর পর মহামান্য রাষ্ট্রপতি তখন ওই এলাকাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা করবেন।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সচিবের এমন মনগড়া তথ্য শোনার পর উপস্থিত জনপ্রতিনিধি, সুধীজন, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের লোকদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। সেইসাথে ফসলহার কৃষকের পক্ষে আন্দোলনকারীদের নিয়ে সচিবের এমন কটূক্তির প্রতিবাদে উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীরা সভা থেকে বেরিয়ে আসেন।
সভায় উপস্থিত সুধিজনেরা জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন ২০১২ এর ২২ ধারার কোন উপধারায় দুর্গত এলাকা ঘোষণা করতে অর্ধেকের বেশি মানুষ মারা যাওয়ার কোন শর্তের কথা কোথাও উল্লেখ নাই।
সভায় অবজ্ঞার সুরে দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামাল সচিব আরো বলেন, কিসের দুর্গত এলাকা। সুনামগঞ্জে একটি ছাগলও তো মারা যায়নি।
প্রসঙ্গত, চলতি মৌসুমে ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে, কোথাও বাঁধ না হওয়ায় একের পর এক হাওর তলিয়ে যাওয়ার পর জেলার বিস্তীর্ণ এলাকার লাখ লাখ বোরো চাষী সর্বশান্ত হয়ে গেলে জেলা জুড়ে বিভিন্ন ব্যক্তি, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, কৃষক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় গত ৫ এপ্রিল শহরের আলফাত স্কয়ারে জনসভা করে জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। একই দিন দুপুরে শহরের শহীদ জগৎজ্যোতি পাঠাগার মিলনায়তনে সংবাদ সম্মেলন করে জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট ও সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ুব বখত জগলুল। দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবিতে ধারাবাহিক আন্দোলন করে হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও আন্দোলন। সংবাদ সম্মেলন করে জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানান জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক এমপি নাছির উদ্দিন চৌধুরী। জেলা আইনজীবী সমিতি ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ প্রধানমন্ত্রী বরাবরে স্মারকলিপি দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলাকে দুর্গত এলাকা ঘোষণার দাবি জানিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর