বাংলাদেশ রেলের একজন দক্ষ চালক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ছালমা খাতুন। ছোটবড় নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে এবং সরকারি কাজের কিছু কিছু ক্ষেত্রে দূরদর্শিতার ঘাটতির মধ্যেও আনন্দের সঙ্গে কাজ করছেন বাংলাদেশের প্রথম নারী রেলচালক ছালমা। বর্তমানে এই পেশায় ১৫ জন নারী কর্মরত দেশের বিভিন্ন স্টেশনে। সালমার বর্তমান কর্মস্থল কমলাপুর রেল স্টেশন। ২০০৪ সালে সহকারী ট্রেনচালক হিসেবে নারী কোটায় পরীক্ষায় অংশ নেন বেশ ক’জন নারী। সেই সময় একমাত্র ছালমাই রেলের চালক হিসেবে নিয়োগ পান।
একজন নারী হিসেবে তিনি কীভাবে এতো ঝুকিপূর্ণ কাজের জন্য নিজেকে তৈরি করছেন। এছাড়া অন্য সহকর্মীদের থেকেইবা কেমন সহযোগিতা পাচ্ছেন ঝুকিপূর্ণ পেশায়- এসব বিষয় নিয়ে পরিবর্তন ডটকমের সঙ্গে কথা হয় ছালমা খাতুনের। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফররুখ বাবু।
২০০৪ সালে আপনি চালক হিসেবে আসেন। এই দীর্ঘ সময়ে রেলে নারী চালকের সংখ্যা মাত্র ১৫ জন। এখানে কোনো বাধ্যবাধকতা আছে কিনা?
বাধ্যবাধকতা নেই। এখানে লিখিত পরীক্ষা দিয়ে টিকতে হয়। তারপর মুখোমুখি হতে হয় ভাইভার। মৌখিক পরীক্ষায় পাস না করলে কীভাবে আসবে? অনেক নারী পরীক্ষা দিয়েছে, দিচ্ছে। কেউ পাস না করলে এই পেশায় আসবে কীভাবে? তবে নেওয়া-না নেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। যদি এক’শজন পাস করে তাহলে কোটা অনুযায়ী নিয়ে নেবে।
দিনরাত কাজ করতে হয় আপনাকে। নারী হিসেবে এখানে নিরাপত্তা কেমন?
আমি যতটুকু গণ্ডীর মধ্যে কাজ করি তা দিনের মধ্যেই শেষ হয়। আমি যে এলাকায় কাজ করি সেই ‘শেডে’আমার সহকর্মীরা শুরু থেকেই সহযোগিতা করছেন। তারা সব সময় বলেন, সালমা খুব ভালো। তা না হলে এতোগুলো ছেলের মধ্যে নারী হয়ে টিকে আছে কী করে।
নারী হিসেবে পুরুষ সহকর্মীদের মসকরার সম্মুখীন আপনাকে হতে হয়?
আমাকে ওইভাবে কেউ নিয়ে কিছু বলে না। ওরা আমাকে কিছু বললে মাইন্ড করি না। একটু হাসি দিয়ে চলে আসি।
১০ বছর না হওয়া পর্যন্ত মূল চালকের আসনে কেউ বসতে পারে না। তাহলে আপনি কেন এখনো আসতে পারছেন না?
আমরা যারা একসঙ্গে এখানে আসি, তাদের মধ্যে অনেকেই মূল চালক হয়ে গেছেন। আমি শুধু মা হওয়ার জন্য সময় নিতে গিয়ে পিছিয়ে পড়েছি, তা না হলে আমিও দুই বছর আগে মূল চালক হতে পারতাম।
জেনেছি, এখন পর্যন্ত ঢাকার বাইরে নারী চালকদের রাতে থাকার কোনো ব্যস্থা নেই? কিন্তু কেন?
এতো দিন কোনো নারী চালক ছিল না। এ জন্য প্রশাসন সেই ব্যবস্থা করেনি। এখন নারীরা আসছে, প্রশাসন ব্যবস্থা করবে।
এই পেশায় অন্য নারীদের উৎসাহিত করবেন কি?
অবশ্যই, ঢাকায় দুই’শ জন ট্রেন চালকের মধ্যে আমি একমাত্র নারী। এখানে আমরা এক’শ না আসতে পারলেও ৫০ জন এলে ভালো হতো।
পেশার দিক থেকে দেশে নারী-পুরুষ সমান অধিকার। এখানে কাজ করতে এসে আপনি কোনো বৈষম্যের সম্মুখীন হয়েছেন কি?
না, এখানে তেমন কিছু চোখে পড়েনি আমার।
সংসার এবং কর্মস্থল একসঙ্গে কীভাবে পরিচালনা করেন?
কাজের ফাঁকে যে সময় পাই তা সংসারের কাজে ব্যয় করি। আমার সব সেইভাবেই বণ্টন করা।
এ পর্যন্ত আসতে কী ধরনের বাধা ডিঙিয়ে আসতে হয়েছে আপনাকে?
আমার পরিবার আমাকে সহযোগিতা করে। সকালে ডিউটি থাকলে আমার স্বামী স্টেশনে পৌঁছে দেন। আমি যেহেতু ট্রেন চালাই, তাই পরিবারের সবাই আমাকে নিয়ে ভাবে। এতোদিন আমি শুধু কমলাপুর স্টেশনের গণ্ডীর মধ্যে ট্রেন চালিয়েছি, এখন তো সবার একটা ভাবনা আছে সালমা লাইনে যাবে। প্রতিবন্ধকতা তো আসবেই, লাইনে প্রতিবন্ধকতা থাকবেই। যখন আসবে তখন দেখা যাবে। আমার বিয়ের আগে মূল চালকের পাশে বসে সহকারী চালকের দায়িত্ব পালন করতাম। এখন কমলাপুর স্টেশনে যে ট্রেন আসে, তার ইঞ্জিন পরিবর্তনের মাধ্যমে সরাসরি ট্রেন চালানোর কাজ করছি। এভাবে দুই বছর সবাইকে করতে হয়। তারপর মূল চালকের স্থানে বসতে হয়।
১৯৮৩ সালে একবার নারী ট্রেন চালকের কথা উল্লেখ করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০০৪ সালে আবারও নারী রেল চালক চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সেখানে ছালমা খাতুনসহ আরও অনেক নারী পরীক্ষায় অংশ নিলেও একমাত্র সালমাই চালক হিসেবে নিয়োগ পান। কথার ফাঁকে ফাঁকে এমন সব তথ্য জানাচ্ছিলেন তিনি। ২০০৪ সালে তার কর্মজীবনের সূচনা হয় সহকারী লোকোমাস্টার হিসেবে। সে সময় ছালমাকে ‘ফায়ার ম্যান’ হিসেবে ডাকতেন অনেকে। ঢাকা-জয়দেবপুর রুটে সহকারী চালক হিসেবে কাজে গেলে কিংবা কোনো এলাকায় ট্রেনিংয়ে গেলে স্থানীয়রা খুব উৎসুক হয়ে তাকে দেখতে আসতেন। এছাড়া নারী চালকদের জন্য সরকারিভাবে কোনো থাকার ব্যবস্থা না থাকায় রেলের কর্মকর্তারা পরিচিত কারো বাসায় থাকার ব্যবস্থা করতেন ছালমার জন্য। সেই সময় আশপাশের মানুষ ছালমাকে ফায়ার ম্যান হিসেবে সম্বোধন করতো, যা তার ভালো লাগার একটা বিষয় ছিল।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে অন্য নারীদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কি?
অন্যের কথা মাথায় না নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে নারীকে। নারীদের মাঝে সাহস বাড়ালে, অনেক কিছুই করা সম্ভব হবে।