ঢাকা ১২:২৫ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২১ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মেয়েরা যদি জানতো তাদের আত্মসম্মানটা কোথায়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:২৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০১৬
  • ২৮১ বার

নাদিয়া ইসলাম:

গতকাল (০৩ অক্টোবর, ২০১৬) প্রথম আলোতে একটা ছোট সাইজের নিউজ দেখলাম। ‘বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার’! খবরে বলা হইছে, “৪১ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছেন, জীবনভর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে তাঁদের বিভিন্ন আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২৮ শতাংশের বেশি নারীকে আঘাতের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৪ শতাংশের বেশি নারী।”

বলা হইছে, “জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেকের বেশি বিবাহিত নারী (৫৫ শতাংশ) বলেছেন, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া, বাবার বাড়ি যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি, সন্দেহ করা, আবেগ, অনুভূতির মূল্যায়ন না করা, বিনা অনুমতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বাইরের মানুষের সামনে হেয় বা অপমান করা, যখন-তখন স্বামীর রেগে যাওয়াসহ স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাব ছিল সাধারণ বিষয়।”

এই খবর দেইখা যে আমি খুব অবাক হইছি বা পড়তে গিয়া চেয়ার থিকা পইড়া গেছি, তেমন না।

লন্ডনে আমার এক বন্ধু আছেন। ধরা যাক উনার নাম নাবিলা। তো নাবিলা শিক্ষিত, স্মার্ট, বুয়েট থিকা পাশ করা এবং একসময় ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করা, এক বাচ্চার মা মধ্যবয়স্ক একজন ক্রিয়েটিভ মেয়ে, যার আই-কিউ ১২০ এর উপরে। তিনি লন্ডনে এখন ‘স্টে-এ্যাট-হোম’ মাদার। ব্রিটিশ সরকার বাচ্চা পালার জন্য প্রচুর পয়সা ফাও দিয়া থাকেন, তাই বাড়িতে থাইকা বাচ্চা পালনেওয়ালা ও প্রতিদিন চল্লিশ পদের খাওয়া রান্ধা মা’দের কাজ না করলেও মাস চইলা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ বাঙ্গালী মেয়েদের যেহেতু আত্মসম্মান কম এবং পুরুষের ঘাড়ে চইড়া খাওনের জন্মগত অভ্যাস আছে, তাই নাবিলারে নিজের লিপস্টিক কিনতে ও বাড়ি ভাড়া দিতে উনার বাঙ্গালী পুরুষ স্বামীর কাছে হাত পাততে হয়। স্বামী বড় বড় মুখ কইরা তা দেন, এবং দেওয়ার সময় প্রত্যেকবারই উনারে জানাইয়া দেন যে, ‘উনার’ পয়সা দিয়াই নাবিলা এবং তার শিশু সন্তান চলতেছেন।

দুনিয়া যেহেতু গিভ এ্যান্ড টেইকের, তাই উনি এই পয়সার বিনিময়ে নাবিলার শারীরিক ও মানসিক আনুগত্য চান। সেইটা স্বামী যেইসময় যেইভাবে উনারে বিছানায় চান সেইসময় সেইভাবে বাকবাকুম করতে করতে বিছানায় হাজির হওয়া থিকা শুরু কইরা, স্বামীর ইচ্ছায় বাচ্চা এ্যাবরশান কইরা ফালায়ে দেওয়া এবং সেই বাবদ বাসায় কান্নাকাটি পর্যন্ত করতে না পারা পর্যন্ত বিস্তৃত। কারণ, কান্নাকাটির শব্দ শুনলে স্বামীসিংহের মহাপবিত্র মাথা ব্যথা করেন।

আমার আরেক বন্ধু, ধরা যাক উনার নাম সাদিয়া, উনিও লন্ডন থাকেন। কাজ করেন একটা সুপার স্টোরে। উনার স্বামী উনারে দিনে দুইবেলা কইরা নিয়ম ধইরা পিটান। কারণ কী? কারণ হইলো সাদিয়া খুব সুন্দরী দেখতে, উনি সাজতে ভালোবাসেন, লন্ডনের মেয়েদের মত জামা কাপড় পরেন এবং উনার অনেক পুরুষ ‘ফ্যান’ আছেন, যারা সাদিয়ারে মাঝেমধ্যে ‘তুমি খুব সুন্দর’ ‘তোমাকে আজকে সুন্দর দেখাচ্ছিলো’ টাইপ টেক্সট কইরা থাকেন।

আমার মায়ের বন্ধু, ধরা যাক উনার নাম হুমায়রা, তো হুমায়রা আন্টি বাংলাদেশ ব্যাংকে খুব উঁচা এক পোস্টে চাকরি করেন। উনার স্বামী ইম্পোটেন্ট, এবং সেক্সুয়ালি পারভার্টেড। উনাদের ৩১ বছরের বিবাহিত (?) জীবন। গত ৩১ বছরে উনার স্বামী বেশিরভাগ রাতেই বাড়িতে বেশ্যা ডাইকা আইনা উনার সামনে দুইজনরে কাপড় খোলাইয়া আক্ষরিক অর্থে নাচতে কইছেন। উনারাও নাচছেন, আক্ষরিক অর্থেই।

আমার আশেপাশে যেইসব বিবাহিত মেয়েদের দেখি, তাদের বেশিরভাগেরই (নাকি প্রত্যেকেরই?) নিজেদের স্বামীদের নিয়া অভিযোগের অন্ত নাই। কারো স্বামী হাতে মারেন, কারো স্বামী বাসার কোনো কাজ করেন না, কারো স্বামী তার আবেগের মূল্য দেন না, কারো স্বামী বন্ধু বান্ধব তাসের আড্ডা মদের আড্ডা সাহিত্যের আড্ডায় গিটার, ফুটবল, ক্রিকেট, বাংলা সাহিত্য ও সমাজসেবা নিয়া ব্যস্ত, কারো স্বামী পরকীয়া করেন, কারো স্বামী তারে কথায় কথায় অপমান করেন, কারো স্বামী তার যৌনচাহিদা নিয়া মাথা ঘামান না, কারো স্বামী জোর কইরা তারে শুইতে বাধ্য করেন বা ধর্ষণ করেন, কারো স্বামী তারে দিয়া জোর কইরা শ্বশুর বাড়ির সেবা করান, বাপ মা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেন না, কারো স্বামী তারে চাকরি করতে দেন না, পড়ালেখা করতে দেন না, কারো স্বামী বাসা, বাচ্চা এবং সংসার সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তে তার মতামতের পাত্তা দেন না- ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।

পুরুষতন্ত্র এবং পুরুষতান্ত্রিক নারী ও পুরুষরে দোষ দেওনের আগে এই অধমে ভিকটিম মেয়েদের দুইটা কথা জিগাইতে চাই। যারা এই ফালতু লেখা পড়তেছেন, তারা শিক্ষিত এবং ইন্টারনেট এ্যাক্সেস আছে বিধায় আধুনিক সমাজে বাস করতেছেন এই ধইরা নিয়া প্রশ্ন করতেছি। সমাজের নিম্নবিত্ত মেয়েদের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন না।

আপা, আপনে যদি জানেন, আপনার উপর অন্যায় হইতেছে, আপনি কি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন কখনো? বাইর হইয়া আসতে চান কখনো? যদি বাইর হইয়া আসতে চান কিন্তু পারেন না, তাইলে কীসের ভয়ে পারেন না? আপনি বাইর হইয়া আসার চেষ্টা করলে আপনার স্বামী আরো অত্যাচার করবেন বইলা ভাবেন? একলা থাকতে পারার আপনার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সামর্থ্য নাই? আপনার পরিবার এবং সমাজ আপনারে সমর্থন করবেন না, ভাবেন? সন্তান হারানোর ভয় করেন? মনে করেন এই অত্যাচার হওনের পিছে আপনার নিজেরই অপরাধ আছে? আপনে ভাবেন, সকল পুরুষই একরকম? আপনে এইগুলারে অত্যাচার বইলা মনেই করেন না? ভাবেন, এই সমস্ত স্বাভাবিক? ভাবেন, বিবাহিত জীবন এমনই? ভাবেন, ডিভোর্সি মেয়েদের সমাজ বেশ্যার চোখে দেখেন? ভাবেন, মানাইয়া চলাই আপনার নারীধর্ম?

এই সকল প্রশ্নের একটার উত্তরও যদি হ্যাঁ হয়, তাইলে আপা, সমস্যা কিছুটা হইলেও আপনার নিজের। পুরুষতন্ত্র আপনারে মুখে উঠাইয়া খাওয়াইয়া দেওনের জন্য ময়ূর সিংহাসনে বইসা নাই। আপনি মিঁউমিঁউ করলে পুরুষতন্ত্রের সুবিধা। পুরুষতন্ত্র আমাদের শিখাইছেন মেয়েরা নিচুস্তরের প্রাণী। পুরুষতন্ত্র কইছেন, মেয়েদের কারণেই পুরুষ স্বর্গচ্যুত হইছেন, কইছেন, পুরুষের হাড্ডি দিয়া মেয়েদের বানানো হইছে! পুরুষতন্ত্র শিখাইছেন, মেয়েদের জন্ম হইছে পুরুষের সেবা করতে, এবং সেই বাবদ মেয়েদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখার জন্য তাদের ‘শাসন’ করা পুরুষের কর্তব্য, এবং তা সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য বা ন্যায্য।

১৯৭৩ সালে একজন ব্রিটিশ পুরুষ (হ) ‘প্রথম’ স্বামীর মারফত স্ত্রীর উপর (এবং স্বামীর উপর স্ত্রীর) অত্যাচাররে ‘পারিবারিক সহিংসতা’ নাম দিয়া মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। এর আগে প্রাচীন রোমে স্বামীর লাঠি দিয়া স্ত্রীরে ‘হালকা’ মারারে খারাপ চোখে দেখা হইতো না। ইসলাম ধর্মেও স্বামী স্ত্রীরে ‘সামান্য’ মারতে পারবেন বইলা পুরুষরে অনুমতি দেওয়া হইছে। কুরানে বলা হইছে, “পুরুষরা নারীদের সংরক্ষণকারী [ভরণপোষণকারী] কারণ আল্লাহ পুরুষদের কয়েকজনকে অন্যদের (নারী/পুরুষ) থেকে বেশি দিয়েছেন [অনুগ্রহ করেছেন, সন্মানিত করেছেন], এবং তারা (পু) নিজেদের সম্পত্তি থেকে খরচ করে। আর নীতিবান নারীরা আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত অনুগত [ধর্ম প্রাণ, আন্তরিক, অনুগত], গোপন ব্যাপারগুলো গোপন রাখে যা আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করতে বলেছেন। আর তাদের (স্ত্রী) মধ্যে যাদেরকে তোমরা (পু) অন্যায় আচরণ/বিদ্রোহাচারণ ভয় করো, তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) সতর্ক করো [উপদেশ, সাবধান, প্রহার করা], তারপর তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) বিছানায় [শোবার ঘরে] ত্যাগ করো, এবং সবশেষে তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) আলাদা করে দাও/দৃষ্টান্ত দাও। তবে যদি তারা (স্ত্রী) তোমাদের (পু) সম্মতি দেয়, তাদের (স্ত্রী) বিরুদ্ধে কিছু করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সবচেয়ে প্রজ্ঞাময়।” (৪:৩৪)

অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়া পারিবারিক সহিংসতা ঠেকানোর প্রথম রাস্তা। এবং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার অর্থ ব্যাংকে বা ইস্কুলে রোমান্টিক চাকরি কইরা মাস শেষে নিজের পিৎজা খাওয়ার টাকা উপার্জন না। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার অর্থ বাড়ি ভাড়া দিয়া থাইকা নিজের খাওয়ার খরচ এবং গ্যাস-পানি-বিদ্যুত বিল দিতে পারার সামর্থ্য, পুরুষের উপর নির্ভর না কইরাই। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী মেয়েদের উপরেও কি অত্যাচার হয় না? হয়। কিন্তু সেইসব মেয়েদের তখন গলার জোর থাকে প্রতিবাদ করার। এবং মামলা করার।যেইসব মেয়েরা বিশ্বাস করেন তারা পুরুষের সমকক্ষ না বা হইতে পারবেন না, যেইসব মেয়েরা ভাবেন সকল (বা যেকোনো একখান) ধর্ম নারীরে বিশাল মর্যাদা দিয়া আসমানে তুইলা ফেলছেন, তাদের উপর পুরুষেরা অত্যাচার করবেন এইটা বুঝতে তো বিদ্যাসাগর হওয়া লাগে না। যেইসব মেয়েরা নামকাওয়াস্তে পড়ালেখা করেন একটা ‘বি-বি-এ’ ‘এম-বি-এ’ ডিগ্রি থাকা এখন ফ্যাশনেবল তাই এবং দিনশেষে তারা বাপের ও স্বামীর পয়সায় শাড়ি ও ম্যাকের লিপস্টিক কিনবেন ও সিঙ্গাপোরে ছুটি কাটাইতে যাবেন বইলা সিন্ডারেলা মার্কা স্বপ্ন দেখেন, ভাবেন শাহরুখ খান সালমান খান মার্কা গাবদাগোবদা নায়কেরা সাদা ঘোড়ায় চাইপা তাদের দৈত্যপুরী থিকা উদ্ধার কইরা নিয়া গিয়া সোনার পালংকে ঘুমাইতে দিবেন, তারা নিজেরাই নিজেদের অত্যাচারিত হওয়ার রাস্তা তৈরি করতেছেন।

গর্ভপাত নিষিদ্ধ কইরা সরকারের নতুন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের সকল মেয়েরা গতকাল ধর্মঘটে নামছেন। তারা অফিসে যাইতেছেন না, তারা ইস্কুল-কলেজে যাইতেছেন না, এমনকি তারা ঘরের রান্না-বান্না, কাপড়ধোয়াও বন্ধ কইরা দিছেন।

(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ অক্টোবর, ২০১৬) আমার ধারণা, বাংলাদেশের সব মেয়ে যদি এইরকম মানসিক জোর দেখানোর এবং আন্দোলন কইরা বেড়ানো ‘খারাপ’ মেয়ে হওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, একদিন পুরুষের জন্য সকল কাজ করা বন্ধ কইরা দিতেন এবং একদিনের জন্য হইলেও নিজের কথা ভাবতেন, তাইলে এই দেশে মেয়েদের উপর অত্যাচার বন্ধ না হইলেও কইমা যাইতো আরো অনেক অনেক আগে।

বিয়া হয়তো পবিত্র বন্ধন, আপা, কিন্তু যেই ব্যক্তি বিয়ার মধ্যে থাইকা আপনারে শারীরিক, মানসিক, মৌখিক, সামাজিক, ধর্মীয়, যৌন এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যাচার করার ধৃষ্টতা দেখান, তিনি সেই বন্ধন থিকা টাটা বাই বাই কইরা বাইর হইয়া গেছেন আপনার অনেক আগেই। আপনার আর সেই বন্ধনের অন্যপাশের দড়ি ধইরা ‘একলা’ দাঁড়াইয়া থাইকা স্বামী সিংহের নাম জপ করার প্রয়োজন নাই। আপনার শরীর ভর্তি প্রচুর প্রেম থাকলেও নাই।

সুতরাং এ্যাবিউজিভ সম্পর্ক থিকা বাইর হইয়া আসেন। পড়ালেখা শিখেন। নিজের যোগ্যতারে দাম দেওয়া শিখেন। নিজেরে সেকেন্ড সেক্স হিসাবে দেখা বন্ধ করেন। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হন। কথা বলা শিখেন। প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদ করতে গিয়া খুন হন, এবং খারাপ মেয়ে হন।

কিন্তু মাইর খায়েন না। মানে যদি কানতে না চান, এই ৮০% এর দলে নাম লেখাইতে না চান, আরকি!

সৌজন্যে: উইমেন চ্যাপ্টার

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

মেয়েরা যদি জানতো তাদের আত্মসম্মানটা কোথায়

আপডেট টাইম : ১২:২৩:৪৫ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ৫ অক্টোবর ২০১৬

নাদিয়া ইসলাম:

গতকাল (০৩ অক্টোবর, ২০১৬) প্রথম আলোতে একটা ছোট সাইজের নিউজ দেখলাম। ‘বিবাহিত নারীদের ৮০ শতাংশ নির্যাতনের শিকার’! খবরে বলা হইছে, “৪১ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছেন, জীবনভর স্বামীর শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের কারণে তাঁদের বিভিন্ন আঘাতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। ২৮ শতাংশের বেশি নারীকে আঘাতের কারণে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ৪ শতাংশের বেশি নারী।”

বলা হইছে, “জরিপে অংশ নেওয়া প্রায় অর্ধেকের বেশি বিবাহিত নারী (৫৫ শতাংশ) বলেছেন, বন্ধুর সঙ্গে কথা বলতে না দেওয়া, বাবার বাড়ি যেতে নিষেধাজ্ঞা জারি, সন্দেহ করা, আবেগ, অনুভূতির মূল্যায়ন না করা, বিনা অনুমতিতে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে না দেওয়া, বাইরের মানুষের সামনে হেয় বা অপমান করা, যখন-তখন স্বামীর রেগে যাওয়াসহ স্বামীর নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ বা মনোভাব ছিল সাধারণ বিষয়।”

এই খবর দেইখা যে আমি খুব অবাক হইছি বা পড়তে গিয়া চেয়ার থিকা পইড়া গেছি, তেমন না।

লন্ডনে আমার এক বন্ধু আছেন। ধরা যাক উনার নাম নাবিলা। তো নাবিলা শিক্ষিত, স্মার্ট, বুয়েট থিকা পাশ করা এবং একসময় ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করা, এক বাচ্চার মা মধ্যবয়স্ক একজন ক্রিয়েটিভ মেয়ে, যার আই-কিউ ১২০ এর উপরে। তিনি লন্ডনে এখন ‘স্টে-এ্যাট-হোম’ মাদার। ব্রিটিশ সরকার বাচ্চা পালার জন্য প্রচুর পয়সা ফাও দিয়া থাকেন, তাই বাড়িতে থাইকা বাচ্চা পালনেওয়ালা ও প্রতিদিন চল্লিশ পদের খাওয়া রান্ধা মা’দের কাজ না করলেও মাস চইলা যায়। কিন্তু বেশিরভাগ বাঙ্গালী মেয়েদের যেহেতু আত্মসম্মান কম এবং পুরুষের ঘাড়ে চইড়া খাওনের জন্মগত অভ্যাস আছে, তাই নাবিলারে নিজের লিপস্টিক কিনতে ও বাড়ি ভাড়া দিতে উনার বাঙ্গালী পুরুষ স্বামীর কাছে হাত পাততে হয়। স্বামী বড় বড় মুখ কইরা তা দেন, এবং দেওয়ার সময় প্রত্যেকবারই উনারে জানাইয়া দেন যে, ‘উনার’ পয়সা দিয়াই নাবিলা এবং তার শিশু সন্তান চলতেছেন।

দুনিয়া যেহেতু গিভ এ্যান্ড টেইকের, তাই উনি এই পয়সার বিনিময়ে নাবিলার শারীরিক ও মানসিক আনুগত্য চান। সেইটা স্বামী যেইসময় যেইভাবে উনারে বিছানায় চান সেইসময় সেইভাবে বাকবাকুম করতে করতে বিছানায় হাজির হওয়া থিকা শুরু কইরা, স্বামীর ইচ্ছায় বাচ্চা এ্যাবরশান কইরা ফালায়ে দেওয়া এবং সেই বাবদ বাসায় কান্নাকাটি পর্যন্ত করতে না পারা পর্যন্ত বিস্তৃত। কারণ, কান্নাকাটির শব্দ শুনলে স্বামীসিংহের মহাপবিত্র মাথা ব্যথা করেন।

আমার আরেক বন্ধু, ধরা যাক উনার নাম সাদিয়া, উনিও লন্ডন থাকেন। কাজ করেন একটা সুপার স্টোরে। উনার স্বামী উনারে দিনে দুইবেলা কইরা নিয়ম ধইরা পিটান। কারণ কী? কারণ হইলো সাদিয়া খুব সুন্দরী দেখতে, উনি সাজতে ভালোবাসেন, লন্ডনের মেয়েদের মত জামা কাপড় পরেন এবং উনার অনেক পুরুষ ‘ফ্যান’ আছেন, যারা সাদিয়ারে মাঝেমধ্যে ‘তুমি খুব সুন্দর’ ‘তোমাকে আজকে সুন্দর দেখাচ্ছিলো’ টাইপ টেক্সট কইরা থাকেন।

আমার মায়ের বন্ধু, ধরা যাক উনার নাম হুমায়রা, তো হুমায়রা আন্টি বাংলাদেশ ব্যাংকে খুব উঁচা এক পোস্টে চাকরি করেন। উনার স্বামী ইম্পোটেন্ট, এবং সেক্সুয়ালি পারভার্টেড। উনাদের ৩১ বছরের বিবাহিত (?) জীবন। গত ৩১ বছরে উনার স্বামী বেশিরভাগ রাতেই বাড়িতে বেশ্যা ডাইকা আইনা উনার সামনে দুইজনরে কাপড় খোলাইয়া আক্ষরিক অর্থে নাচতে কইছেন। উনারাও নাচছেন, আক্ষরিক অর্থেই।

আমার আশেপাশে যেইসব বিবাহিত মেয়েদের দেখি, তাদের বেশিরভাগেরই (নাকি প্রত্যেকেরই?) নিজেদের স্বামীদের নিয়া অভিযোগের অন্ত নাই। কারো স্বামী হাতে মারেন, কারো স্বামী বাসার কোনো কাজ করেন না, কারো স্বামী তার আবেগের মূল্য দেন না, কারো স্বামী বন্ধু বান্ধব তাসের আড্ডা মদের আড্ডা সাহিত্যের আড্ডায় গিটার, ফুটবল, ক্রিকেট, বাংলা সাহিত্য ও সমাজসেবা নিয়া ব্যস্ত, কারো স্বামী পরকীয়া করেন, কারো স্বামী তারে কথায় কথায় অপমান করেন, কারো স্বামী তার যৌনচাহিদা নিয়া মাথা ঘামান না, কারো স্বামী জোর কইরা তারে শুইতে বাধ্য করেন বা ধর্ষণ করেন, কারো স্বামী তারে দিয়া জোর কইরা শ্বশুর বাড়ির সেবা করান, বাপ মা বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রাখতে দেন না, কারো স্বামী তারে চাকরি করতে দেন না, পড়ালেখা করতে দেন না, কারো স্বামী বাসা, বাচ্চা এবং সংসার সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্তে তার মতামতের পাত্তা দেন না- ইত্যাদি আরো অনেক কিছু।

পুরুষতন্ত্র এবং পুরুষতান্ত্রিক নারী ও পুরুষরে দোষ দেওনের আগে এই অধমে ভিকটিম মেয়েদের দুইটা কথা জিগাইতে চাই। যারা এই ফালতু লেখা পড়তেছেন, তারা শিক্ষিত এবং ইন্টারনেট এ্যাক্সেস আছে বিধায় আধুনিক সমাজে বাস করতেছেন এই ধইরা নিয়া প্রশ্ন করতেছি। সমাজের নিম্নবিত্ত মেয়েদের উদ্দেশ্যে এই প্রশ্ন না।

আপা, আপনে যদি জানেন, আপনার উপর অন্যায় হইতেছে, আপনি কি প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেন কখনো? বাইর হইয়া আসতে চান কখনো? যদি বাইর হইয়া আসতে চান কিন্তু পারেন না, তাইলে কীসের ভয়ে পারেন না? আপনি বাইর হইয়া আসার চেষ্টা করলে আপনার স্বামী আরো অত্যাচার করবেন বইলা ভাবেন? একলা থাকতে পারার আপনার শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক সামর্থ্য নাই? আপনার পরিবার এবং সমাজ আপনারে সমর্থন করবেন না, ভাবেন? সন্তান হারানোর ভয় করেন? মনে করেন এই অত্যাচার হওনের পিছে আপনার নিজেরই অপরাধ আছে? আপনে ভাবেন, সকল পুরুষই একরকম? আপনে এইগুলারে অত্যাচার বইলা মনেই করেন না? ভাবেন, এই সমস্ত স্বাভাবিক? ভাবেন, বিবাহিত জীবন এমনই? ভাবেন, ডিভোর্সি মেয়েদের সমাজ বেশ্যার চোখে দেখেন? ভাবেন, মানাইয়া চলাই আপনার নারীধর্ম?

এই সকল প্রশ্নের একটার উত্তরও যদি হ্যাঁ হয়, তাইলে আপা, সমস্যা কিছুটা হইলেও আপনার নিজের। পুরুষতন্ত্র আপনারে মুখে উঠাইয়া খাওয়াইয়া দেওনের জন্য ময়ূর সিংহাসনে বইসা নাই। আপনি মিঁউমিঁউ করলে পুরুষতন্ত্রের সুবিধা। পুরুষতন্ত্র আমাদের শিখাইছেন মেয়েরা নিচুস্তরের প্রাণী। পুরুষতন্ত্র কইছেন, মেয়েদের কারণেই পুরুষ স্বর্গচ্যুত হইছেন, কইছেন, পুরুষের হাড্ডি দিয়া মেয়েদের বানানো হইছে! পুরুষতন্ত্র শিখাইছেন, মেয়েদের জন্ম হইছে পুরুষের সেবা করতে, এবং সেই বাবদ মেয়েদের ‘নিয়ন্ত্রণে’ রাখার জন্য তাদের ‘শাসন’ করা পুরুষের কর্তব্য, এবং তা সামাজিক, ধর্মীয় ও নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য বা ন্যায্য।

১৯৭৩ সালে একজন ব্রিটিশ পুরুষ (হ) ‘প্রথম’ স্বামীর মারফত স্ত্রীর উপর (এবং স্বামীর উপর স্ত্রীর) অত্যাচাররে ‘পারিবারিক সহিংসতা’ নাম দিয়া মানুষের সামনে উপস্থাপন করেন। এর আগে প্রাচীন রোমে স্বামীর লাঠি দিয়া স্ত্রীরে ‘হালকা’ মারারে খারাপ চোখে দেখা হইতো না। ইসলাম ধর্মেও স্বামী স্ত্রীরে ‘সামান্য’ মারতে পারবেন বইলা পুরুষরে অনুমতি দেওয়া হইছে। কুরানে বলা হইছে, “পুরুষরা নারীদের সংরক্ষণকারী [ভরণপোষণকারী] কারণ আল্লাহ পুরুষদের কয়েকজনকে অন্যদের (নারী/পুরুষ) থেকে বেশি দিয়েছেন [অনুগ্রহ করেছেন, সন্মানিত করেছেন], এবং তারা (পু) নিজেদের সম্পত্তি থেকে খরচ করে। আর নীতিবান নারীরা আল্লাহর প্রতি অত্যন্ত অনুগত [ধর্ম প্রাণ, আন্তরিক, অনুগত], গোপন ব্যাপারগুলো গোপন রাখে যা আল্লাহ তাদেরকে রক্ষা করতে বলেছেন। আর তাদের (স্ত্রী) মধ্যে যাদেরকে তোমরা (পু) অন্যায় আচরণ/বিদ্রোহাচারণ ভয় করো, তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) সতর্ক করো [উপদেশ, সাবধান, প্রহার করা], তারপর তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) বিছানায় [শোবার ঘরে] ত্যাগ করো, এবং সবশেষে তাদেরকে (স্ত্রী) তোমরা (পু) আলাদা করে দাও/দৃষ্টান্ত দাও। তবে যদি তারা (স্ত্রী) তোমাদের (পু) সম্মতি দেয়, তাদের (স্ত্রী) বিরুদ্ধে কিছু করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সব কিছু জানেন এবং সবচেয়ে প্রজ্ঞাময়।” (৪:৩৪)

অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়া পারিবারিক সহিংসতা ঠেকানোর প্রথম রাস্তা। এবং অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার অর্থ ব্যাংকে বা ইস্কুলে রোমান্টিক চাকরি কইরা মাস শেষে নিজের পিৎজা খাওয়ার টাকা উপার্জন না। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার অর্থ বাড়ি ভাড়া দিয়া থাইকা নিজের খাওয়ার খরচ এবং গ্যাস-পানি-বিদ্যুত বিল দিতে পারার সামর্থ্য, পুরুষের উপর নির্ভর না কইরাই। কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী মেয়েদের উপরেও কি অত্যাচার হয় না? হয়। কিন্তু সেইসব মেয়েদের তখন গলার জোর থাকে প্রতিবাদ করার। এবং মামলা করার।যেইসব মেয়েরা বিশ্বাস করেন তারা পুরুষের সমকক্ষ না বা হইতে পারবেন না, যেইসব মেয়েরা ভাবেন সকল (বা যেকোনো একখান) ধর্ম নারীরে বিশাল মর্যাদা দিয়া আসমানে তুইলা ফেলছেন, তাদের উপর পুরুষেরা অত্যাচার করবেন এইটা বুঝতে তো বিদ্যাসাগর হওয়া লাগে না। যেইসব মেয়েরা নামকাওয়াস্তে পড়ালেখা করেন একটা ‘বি-বি-এ’ ‘এম-বি-এ’ ডিগ্রি থাকা এখন ফ্যাশনেবল তাই এবং দিনশেষে তারা বাপের ও স্বামীর পয়সায় শাড়ি ও ম্যাকের লিপস্টিক কিনবেন ও সিঙ্গাপোরে ছুটি কাটাইতে যাবেন বইলা সিন্ডারেলা মার্কা স্বপ্ন দেখেন, ভাবেন শাহরুখ খান সালমান খান মার্কা গাবদাগোবদা নায়কেরা সাদা ঘোড়ায় চাইপা তাদের দৈত্যপুরী থিকা উদ্ধার কইরা নিয়া গিয়া সোনার পালংকে ঘুমাইতে দিবেন, তারা নিজেরাই নিজেদের অত্যাচারিত হওয়ার রাস্তা তৈরি করতেছেন।

গর্ভপাত নিষিদ্ধ কইরা সরকারের নতুন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের সকল মেয়েরা গতকাল ধর্মঘটে নামছেন। তারা অফিসে যাইতেছেন না, তারা ইস্কুল-কলেজে যাইতেছেন না, এমনকি তারা ঘরের রান্না-বান্না, কাপড়ধোয়াও বন্ধ কইরা দিছেন।

(বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০৪ অক্টোবর, ২০১৬) আমার ধারণা, বাংলাদেশের সব মেয়ে যদি এইরকম মানসিক জোর দেখানোর এবং আন্দোলন কইরা বেড়ানো ‘খারাপ’ মেয়ে হওয়ার ক্ষমতা রাখতেন, একদিন পুরুষের জন্য সকল কাজ করা বন্ধ কইরা দিতেন এবং একদিনের জন্য হইলেও নিজের কথা ভাবতেন, তাইলে এই দেশে মেয়েদের উপর অত্যাচার বন্ধ না হইলেও কইমা যাইতো আরো অনেক অনেক আগে।

বিয়া হয়তো পবিত্র বন্ধন, আপা, কিন্তু যেই ব্যক্তি বিয়ার মধ্যে থাইকা আপনারে শারীরিক, মানসিক, মৌখিক, সামাজিক, ধর্মীয়, যৌন এবং অর্থনৈতিকভাবে অত্যাচার করার ধৃষ্টতা দেখান, তিনি সেই বন্ধন থিকা টাটা বাই বাই কইরা বাইর হইয়া গেছেন আপনার অনেক আগেই। আপনার আর সেই বন্ধনের অন্যপাশের দড়ি ধইরা ‘একলা’ দাঁড়াইয়া থাইকা স্বামী সিংহের নাম জপ করার প্রয়োজন নাই। আপনার শরীর ভর্তি প্রচুর প্রেম থাকলেও নাই।

সুতরাং এ্যাবিউজিভ সম্পর্ক থিকা বাইর হইয়া আসেন। পড়ালেখা শিখেন। নিজের যোগ্যতারে দাম দেওয়া শিখেন। নিজেরে সেকেন্ড সেক্স হিসাবে দেখা বন্ধ করেন। অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হন। কথা বলা শিখেন। প্রতিবাদ করেন। প্রতিবাদ করতে গিয়া খুন হন, এবং খারাপ মেয়ে হন।

কিন্তু মাইর খায়েন না। মানে যদি কানতে না চান, এই ৮০% এর দলে নাম লেখাইতে না চান, আরকি!

সৌজন্যে: উইমেন চ্যাপ্টার