কারও ন্যূনতম সমালোচনার মুখে পড়লেই তাকে প্রতিপক্ষ হিসেবে নিয়ে নিতেন বিপ্লব বড়ুয়া। আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই বিশেষ সহকারী পুলিশ, গোয়েন্দা দপ্তর, এমনকি আদালতে ফোন করে প্রতিপক্ষের শাস্তি ঠিক করে দিয়ে বলতেন, ‘এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দাপ্তরিক আদেশ। আমি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলছি’। বিপ্লব বড়–য়ার এই বক্তব্য যাচাই বাছাইয়ের (ক্রসচেক) সুযোগ ছিল না। কারণ, যাচাই-বাছাই করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেই কথা বলতে হতো, যা কখনোই সম্ভব নয়।
ছাত্রজীবনে চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সদস্য পদে থাকলেও কোনোদিন মিছিল-সমাবেশে দেখা যায়নি তাকে। তারপরও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও সামরিক সচিব মিয়া জয়নুল আবেদীনের বিশেষ আগ্রহে রাতারাতি আওয়ামী লীগের সদস্য, এক মাস পর উপদপ্তর সম্পাদক, পরে দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী হন বিপ্লব বড়–য়া। বনে যান প্রধানমন্ত্রীর
কার্যালয়ের শক্তির-সমান্তরাল উৎসে। দলের দপ্তর সম্পাদক হয়ে দলেরই ক্ষতি করেছেন বেশি। বিশেষ সহকারী হয়েই বিশেষ সিন্ডিকেট তৈরি করে ক্ষমতা কুক্ষিগত করা ও ঘনিষ্টদের আখের গোছানোর কাজে মনোনিবেশ করেন।
মিয়া জয়নুলের বাড়ি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলায়। বিপ্লবের বাড়িও সেখানে। মিয়া জয়নুল চেয়েছিলেন চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসন থেকে সংসদ সদস্য হবেন। এজন্য ওই আসনের দুই প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলাম ও মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীকে কোণঠাসা করতে তিনি কাজে লাগান ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়াকে। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চাকরি শেষ করার আগেই মারা যান মেজর জেনারেল মিয়া জয়নুল আবেদীন। তিনি মারা গেলে বিপ্লব বড়–য়া আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। সাতকানিয়ায় সংসদ সদস্য নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার পরিবর্তে প্রার্থীকে পোস্টারে ব্যবহার করতে হয়েছে বিপ্লব বড়–য়ার ছবি।
প্রথম দিকে সাতকানিয়ার এমপি আবু রেজা নদভীকে নিয়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে তৃণমূলকে উপেক্ষা করে নিজেদের ইচ্ছামতো মনোনয়ন বাণিজ্যে মেতে উঠেন বিপ্লব বড়–য়া। এ মাধ্যমে নিজেদের লোকদেরও দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করেন। দুজনের তখন গলায় গলায় ভাব। বিপ্লব বড়ুয়া কখনও নির্বাচন না করার ঘোষণা দিলেও এমপি নদভী যখন দেখলেন সাতকানিয়া এবং লোহাগাড়ায় যেকোনো রাজনৈতিক পোস্টার-ব্যান্যারে বিপ্লব বড়ুয়ার ছবি বাধ্যতামূলক করা হলো এবং দলের সহযোগী সংগঠনের কমিটিতে নিজের লোক দিয়ে বিপ্লব পুরো এলাকার একক নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া, তখনই দুজনের বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের বছরখানেক আগে থেকে বিপ্লব সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এম এ মোতালেবকে নিয়ে নতুন করে মাঠে নামেন। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমিনুল ইসলামকে ঠেকানোর জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করেন।
বিপ্লব বড়–য়ার বেপরোয়া হস্তক্ষেপে আমিনুল ইসলাম ও মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর পাশাপাশি চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনও চট্টগ্রামের রাজনীতিতে চরম কোণঠাসা হয়ে পড়েন। বিপরীতে প্রভাব বাড়ে বিপ্লবের মতোই একদিনের জন্যও মাঠের রাজনীতি না করা মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের।
ক্ষমতার পাশাপাশি শেখ হাসিনার সান্নিধ্যে এসে বিপ্লব বড়–য়া বিপুল বিত্তেরও মালিকও বনে যান। চট্টগ্রামের আসকার দিঘির পাড় এলাকায় নগদ অর্থে কিনে নেন প্রায় ১২ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত ১০তলা ভবন। অভিযোগ রয়েছে, সরকারি বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকায় বিপ্লব বড়–য়ার অর্থকড়ি ও সম্পদ নিয়ে কোনো তদন্ত হয়নি। এমনকি ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ভারত পালিয়ে যাওয়া বিপ্লব বড়য়া একবার দেশেও আসেন। তিন দিন থেকে আকাশপথে ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশে পাড়ি দেন। এই পুরো কাজে তিনি সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করেন।
যেভাবে শুরু : বিপ্লব বড়–য়ার বাবা সুনীল বড়–য়া ছিলেন সাতকানিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সাতকানিয়া সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাসের পর বাবা সুনীল বড়–য়া তার প্রাক্তন ছাত্র মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীকে বলেন বিপ্লবকে সাহায্য করতে। মাঈনুদ্দিন হাসান তখন ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি। তিনি বিপ্লব বড়–য়াকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এমএসএস প্রিলিমিনারিতে ভর্তি করিয়ে দেন ১৯৯৪ সালে। আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন হলে বিপ্লব বড়–য়াকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে চাকরির ব্যবস্থা করে দেন। একই সঙ্গে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ বিমানে চাকরি নিয়ে দেন বিপ্লবের স্ত্রীকে।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে আওয়ামী লীগের আমলের অনেকের মতো বিপ্লব বড়–য়াও চাকরি হারান। এরপর তিনি শ্বশুরের টাকায় যুক্তরাজ্যে ব্যারিস্টারি পড়তে যান। ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর তৎকালীন সামরিক সচিব মেজর জেনারেল মিয়া জয়নুল আবেদীনের চেষ্টায় সরাসরি আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক হন ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়–য়া। ২০১৯ সালে হন আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক এবং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী। অথচ এর আগে বিপ্লব বড়–য়া একদিনের জন্যও আওয়ামী লীগ বা ছাত্রলীগ-যুবলীগের রাজনীতি করেননি। কোনো দিন এসব সংগঠনের মিছিল সমাবেশে গেছেন এমন তথ্যও নেই। বরং যুক্তরাজ্যে ব্যারিস্টারি পড়াকালীন সময়ে এক-এগারোর সরকারের কাছে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে লন্ডনে বসবাসরত বাঙালিদের গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেছিলেন, তিনি আওয়ামী লীগ করেন না। ঢাবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন এ অভিযোগ করেছিলেন। এ বিষয়ে অ্যাডভোকেট সাজ্জাদ হোসেন কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, বিপ্লব আমার বন্ধু। একটি কমেন্ট না করলেই কি নয়?
জানা যায়, একসময় শেখ হাসিনা ‘ব্যারিস্টার’ শব্দটির প্রতি দুর্বল ছিলেন। মিয়া জয়নুল সেই সুযোগে ‘ব্যারিস্টার’ বিপ্লব বড়–য়াকে শেখ হাসিনার সান্নিধ্যে আনেন।
ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফেরা বিপ্লব বড়–য়া আওয়ামী লীগের উপদপ্তর সম্পাদক হওয়ার পর থেকে মাঈনুদ্দিন হাসান চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। উল্টো মাঈনুদ্দিন হাসান যাতে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে না পারেন, সেজন্য সর্বদা তৎপর থাকতেন।
বিপ্লবের বিত্তবৈভব : নগরীর আসকার দিঘির পাড়ে একটি ১০তলা ভবনের মালিক বিপ্লব বড়–য়া। গত রবিবার সেখানে গিয়ে কথা হয় কেয়ারটেকার উদয়ন বড়–য়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, বাড়ির মালিক এখানে থাকেন না। তবে এটি বড়–য়া বাড়ি বলে এলাকায় পরিচিত। তিনি দাবি করেন, বিপ্লব বড়–য়াকে তিনি কোনো দিন দেখেননি। কাতালগঞ্জের কার্যালয়ে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমার মুখে তালা মারা। জানা গেছে, রাউজানের হাসান মাহমুদ নামের এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে তিনি বাড়িটি নগদ টাকায় কিনে নেন।
তবে দেশে দৃশ্যমান সম্পদ না হলেও বিপ্লব বড়–য়ার পিএস আরিফের নামে দুবাই শহরে একটি স্বর্ণের দোকান আছে। অভিযোগ রয়েছে, যেখানে যাবতীয় বিনিয়োগ বিপ্লব বড়ুয়ার। আরিফ একসময় টেম্পুর হেলপার ছিলেন। লেখাপড়া হাইস্কুলের গ-ি পার হননি। সেই আরিফ গণভবনে বিপ্লবের সঙ্গে ছিলেন দীর্ঘ বছর। আরিফের বাড়িও লোহাগাড়ায়।
বিপ্লব বড়–য়ার আরেক ব্যবসায়িক অংশীদার সন্তোষ মল্লিকের বাড়ি সাতকানিয়ায়। ৫ আগস্টের পর তিনিও দুবাই পলাতক। স্বর্ণ চোরাচালানী ও হুন্ডি ব্যবসায়ী সন্তোষ মল্লিক আওয়ামী লীগের শাসনামলে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগে একবার গ্রেপ্তারও হন। সন্তোষকে দিয়েই মূলত দেশের বাইরে টাকা পাচার করেন বিপ্লব।
একসময় সাতকানিয়ার শিবির ক্যাডার মোহাম্মদ আলীকে সাতকানিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করেন বিপ্লব। তাকে দিয়ে ট্রাকে করে সিলিন্ডারের গ্যাস বিক্রির ব্যবসা চালু করেন, যার সরকারি অনুমতি নেই। মোহাম্মদ আলী সাতকানিয়াকেন্দ্রিক হুন্ডি ব্যবসা ও থানার নিয়ন্ত্রণের কাজটি করতেন। আলী এখন আত্মগোপনে। এ ছাড়া বিপ্লব শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার হুমায়ুনকে করেন লোহাগাড়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক, এক মুহূর্তের জন্যও আওয়ামী লীগ না করা সাজেদা সুরাতকে করেন কেন্দ্রীয় মহিলা আওয়ামী লীগের শিক্ষা সম্পাদক, কোনো দিন মিছিল-মিটিং না করা লিলি নামের একজনকে করেন যুব মহিলা লীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক। টাকার বিনিময়ে সাতকানিয়া লোহাগাড়ার জামাত ও বিএনপির লোকজন এবং অনেক ব্যবসায়ীকে আওয়ামী লীগের উপকমিটিতে পদ দিয়ে তৃণমূল নেতাকর্মী ও দলের বারোটা বাজিয়েছেন।
নির্বাচনে বিপ্লবের ছবি ব্যবহার : বিপ্লব বড়–য়া সাতকানিয়া এলাকায় এত বেশি প্রভাবশালী ছিলেন যে, ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এম এ মোতালেব পোস্টারে তার ছবি ব্যবহার করেন। আর নৌকার প্রার্থী আবু রেজা নদভী ব্যবহার করেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার ছবি। ৭ জানুয়ারির সেই নির্বাচনে বিপ্লবের প্রার্থী মোতালেব শেখ হাসিনার প্রার্থী আবু রেজা নদভীকে পরাজিত করে এমপি হন।
এ ছাড়া লোহাগাড়া উপজেলার প্রত্যন্ত বড়হাতিয়া ইউনিয়নে বিপ্লব বড়ুয়া নিজের চাচাতো ভাই বিজয় বড়–য়াকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউপি চেয়ারম্যান করেন। ইউনিয়নটি জামায়াত অধ্যুষিত।
শক্তির উৎস : জানা যায়, আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হওয়ার পরই মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ ও গান বাংলার তাপসের সঙ্গে গড়ে তুলেন সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের প্রধান নেতা ছিলেন ওবায়দুল কাদের। বিভিন্ন কমিটিতে নগদ টাকার বিনিময়ে তারা লোকজন ঢোকাতেন।
সমালোচনা সহ্য করতেন না : বিপ্লব বড়–য়ার ছোট ভাই ডা. বিদ্যুৎ বড়–য়াকে নিয়ে একটি পোস্ট দেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাত হোসেন। এ জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাজ্জাতকে গ্রেপ্তার করান, রিমান্ড করান ৯ দিন। জেল খাটান টানা ছয় মাসের বেশি। শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে সাজ্জাতের জামিন হয়। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে জামিন বাতিলের জন্য বিপ্লব বড়–য়া বিচারককেই ফোন দেন বলে দাবি করেন সাজ্জাত। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, তখন ডিজিএফআইয়ের লোকজন জামিনের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিষয়টি বিচারককে জানালে আমি সাড়া পাই। কিন্তু মামলাটি এখনও চলমান। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হয়। কিন্তু ১৩ আগস্ট বিপ্লব বড়–য়া পুনরায় সাজ্জাতের জামিন বাতিলের জন্য আইনজীবী দিয়ে আদালতে আবেদন করেন। আবার সাজ্জাতের ফেসবুক পোস্টে একটি কমেন্ট করে সঙ্গে সঙ্গে মুছে দিয়ে বিপ্লবের কাছে ভুলের জন্য ক্ষমা চাওয়ার পরও ৮০-এর দশকের ত্যাগী ছাত্রনেতা চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ফখরুদ্দিন বাবলুকেও গ্রেপ্তার করিয়ে প্রায় ৬ মাস জেল খাটান।