ঢাকা ০১:৩০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কপ-২৯ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবী রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিকল্প নেই

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১০:৩৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪
  • ১১ বার

জাতিসংঘের আয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তন (কপ ২৯) সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, পৃথিবীকে রক্ষা করতে চাইলে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিকল্প নেই। শুধু অর্থায়ন নয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে নিজেদের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. ইউনূস বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষায় এখনই সবাইকে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের প্রতিজ্ঞা করতে হবে। সবার বিশ্ব উষ্ণায়নের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। কীভাবে দেশগুলো বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়াতে ভূমিকা রাখে, সে ব্যাপারে সবার সজাগ থাকা উচিত।

সেমিনারে ড. ইউনূস বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে কৃষি হুমকির মুখে। ফসলসহ মানুষও নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। কৃষকরা খাদ্য উৎপাদনসহ পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তারা খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছে না। দেশে নারী কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে। জলবায়ুর প্রভাবে নারীরাও হুমকির মুখে রয়েছেন। দেশের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তা অনেকটাই উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য। কৃষকরা ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই কৃষকদের সুবিধা বাড়াতে এবং সব মানুষের জন্য ব্যাংকিং

সেবা নিশ্চিত করতে গ্রামীণ ব্যাংক যে ফর্মুলা ব্যবহার করে তা সব ব্যাংকে চালু করা উচিত।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ুর প্রভাবের যে সমস্যা তা আমরাই তৈরি করেছি। এটার সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। আমরা যদি সাত দিন কার্বন নিঃসরণ করি, তাহলে নিজেরা এক দিন কমিয়ে ছয় দিনে নিয়ে আসি। এভাবেই কার্বণ নিঃসরণ কমাতে হবে। তরুণরাই এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব রাখতে পারে। তারাই সারা পৃথিবীতে সব ধরনের পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায়ও তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা কপ ২৯ সম্মেলনস্থলে জার্মানি ও চিলি আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের জলবায়ু ক্লাব নেতাদের সভায় বক্তব্যে বলেন, সীমিত ডিকার্বনাইজেশন সক্ষমতা সম্পন্ন বেশির ভাগ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সবুজ শিল্প বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও রেয়াতি ডিকার্বনাইজেশন ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে ক্লাইমেট ক্লাবের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন আরও বেশি দ্রুত ও টেকসই উপায়ে হ্রাস এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্যে পৌঁছানোর জন্য উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বিশেষ করে উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রমাণিত কম নির্গমন প্রযুক্তি প্রদর্শন ও স্থাপন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অনেক ডিকার্বনাইজেশন প্রযুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগের প্রয়োজন। অর্থায়নের সীমিত সুযোগ রয়েছে- এমন দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের অধিক মূলধন বিনিয়োগ করা শিল্পের জন্য একটি বাধা হতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের শিল্পের জন্য রেয়াতি অর্থের সুযোগ লাভকে উৎসাহিত করে শিল্প ডিকার্বনাইজেশনের ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য আর্থিক ব্যবস্থার বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬.৮-এর অধীনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমদানিতে সুষম কার্বন খরচ আরোপ করে একটি সুষম ক্ষেত্র তৈরি করতে কার্বন মূল্য নির্ধারণ বা সীমা সমন্বয় করের আন্তর্জাতিক চুক্তির ওপর জোর দিয়ে ২০০৬ সালের নোবেল পিস লরিয়েট বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (এলডিসি) তাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও উন্নয়ন চাহিদার প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।

শিল্পের ডিকার্বনাইজেশন সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, কার্বন নির্গমন বিশ্বব্যাপী স্বল্প-কার্বন প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা কমিয়ে দিতে পারে, কারণ কিছু খাত টেকসই ব্যবস্থা অনুশীলনের তুলনায় ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিতে পারে। তিনি বলেন, এসব ঝুঁকি প্রশমিত করার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে ডিকার্বনাইজেশন প্রচেষ্টার ভারসাম্য বজায় রাখতে কার্বন সীমা সমন্বয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মতো নীতিগুলো অপরিহার্য।

ড. ইউনূস আরও বলেন, অন্যদিকে এসব নীতি বাংলাদেশের মতো বিশেষভাবে দুর্বল উন্নয়নশীল দেশের কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অধিক নির্গমন নীতির কারণে উচ্চ উৎপাদন খরচের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী তাদের কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও উন্নয়ন চাহিদার কারণে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইইউ প্রস্তাবিত কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (সিবিএএম) রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোতে নির্গমনের মান পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করে এবং কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু নীতি শক্তিশালী করতে উৎসাহিত করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তনকে সমর্থন করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ও উদীয়মান বাজারে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

এদিকে বাকুতে কপ-২৯ সম্মেলনে গতকাল ব্যস্ত সময় পার করেন ড. ইউনূস। বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশের শীর্ষ নেতা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সাথে দেখা করেছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করার জন্য কারাবন্দি ৫৭ জন বাংলাদেশি নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমিরাতের রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান। অধ্যাপক ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ ছাড়া মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজু, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে এবং নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।

এশিয়ার আটটি দেশের জন্য শীর্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন ড. ইউনূস। এর আগে তিনি বলেছিলেন, সার্কের পুনরুজ্জীবন হবে তার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি।

ড. ইউনূস বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী, ঘানার প্রেসিডেন্ট, বসনিয়া হার্জেগোভিনার প্রধানমন্ত্রী, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী, মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট, বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী, ব্রাজিল ও ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ফিফার প্রেসিডেন্ট এবং আইওএম মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাশাপাশি তিনি লিচেনস্টাইনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েলের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

এদিকে সাক্ষাৎকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ব্যাপক সংস্কার ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অভিযাত্রায় বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূস আজারবাইজানের বাকুর কপ-২৯ ভেন্যুতে বিশ্ব নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানান এরদোয়ান। ড. ইউনূসও তাদেরকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে এবং উন্নতি করবে বলে আশা জানিয়েছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড ইমাম ড. আহমেদ আল তাইয়েব। গতকাল মঙ্গলবার সকালে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর রিটজ কার্লটন হোটেলে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইসলামিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস। এ সময় ড. ইউনূসকে হাজার বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান গ্র্যান্ড ইমাম। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ফুল ফান্ডেন্ড স্কলারশিপ ঘোষণা করবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গতকাল উদ্বোধনী বক্তব্যে কঠোর বার্তা দেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে বক্তৃতাকালে জলবায়ু সংকেটর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর, যেটি জলবায়ু ধ্বংসের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে- উল্লেখ করে গুতেরেস দেশগুলোকে নির্গমন কমাতে অবিলম্বে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কেবলমাত্র আপনারাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিকে হারাতে পারেন। একটি শক্তিশালী পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশগত বিপর্যয়কে সীমাবদ্ধ করবে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

কপ-২৯ সম্মেলনে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথিবী রক্ষায় জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিকল্প নেই

আপডেট টাইম : ১০:৩৩:০৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪

জাতিসংঘের আয়োজনে জলবায়ু পরিবর্তন (কপ ২৯) সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, পৃথিবীকে রক্ষা করতে চাইলে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের বিকল্প নেই। শুধু অর্থায়ন নয়, পৃথিবীর প্রতিটি দেশকে নিজেদের জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে সরে আসতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছাড়া এর থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। স্থানীয় সময় মঙ্গলবার আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন।

ড. ইউনূস বলেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা কমাতে এবং পরিবেশ রক্ষায় এখনই সবাইকে জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের প্রতিজ্ঞা করতে হবে। সবার বিশ্ব উষ্ণায়নের ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত। কীভাবে দেশগুলো বিশ্ব উষ্ণায়ন বাড়াতে ভূমিকা রাখে, সে ব্যাপারে সবার সজাগ থাকা উচিত।

সেমিনারে ড. ইউনূস বলেন, জলবায়ুর প্রভাবে কৃষি হুমকির মুখে। ফসলসহ মানুষও নানা ধরনের ক্ষতির মুখে পড়ছে। কৃষকরা খাদ্য উৎপাদনসহ পরিবেশ রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কিন্তু তারা খুব বেশি সুবিধা পাচ্ছে না। দেশে নারী কৃষকের সংখ্যাও বাড়ছে। জলবায়ুর প্রভাবে নারীরাও হুমকির মুখে রয়েছেন। দেশের যে ব্যাংকিং ব্যবস্থা রয়েছে, তা অনেকটাই উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য। কৃষকরা ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই কৃষকদের সুবিধা বাড়াতে এবং সব মানুষের জন্য ব্যাংকিং

সেবা নিশ্চিত করতে গ্রামীণ ব্যাংক যে ফর্মুলা ব্যবহার করে তা সব ব্যাংকে চালু করা উচিত।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জলবায়ুর প্রভাবের যে সমস্যা তা আমরাই তৈরি করেছি। এটার সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। আমরা যদি সাত দিন কার্বন নিঃসরণ করি, তাহলে নিজেরা এক দিন কমিয়ে ছয় দিনে নিয়ে আসি। এভাবেই কার্বণ নিঃসরণ কমাতে হবে। তরুণরাই এই বিষয়ে বেশি গুরুত্ব রাখতে পারে। তারাই সারা পৃথিবীতে সব ধরনের পরিবর্তনে নেতৃত্ব দিয়েছে। ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায়ও তরুণদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান ড. ইউনূস।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা কপ ২৯ সম্মেলনস্থলে জার্মানি ও চিলি আয়োজিত উচ্চপর্যায়ের জলবায়ু ক্লাব নেতাদের সভায় বক্তব্যে বলেন, সীমিত ডিকার্বনাইজেশন সক্ষমতা সম্পন্ন বেশির ভাগ জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশের সবুজ শিল্প বিকাশের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রয়োজন। বাংলাদেশ সক্ষমতা বৃদ্ধি, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও রেয়াতি ডিকার্বনাইজেশন ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কাজে লাগিয়ে ক্লাইমেট ক্লাবের সঙ্গে কাজ করতে ইচ্ছুক।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন আরও বেশি দ্রুত ও টেকসই উপায়ে হ্রাস এবং ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন ৪৩ শতাংশ কমাতে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নেট-শূন্যে পৌঁছানোর জন্য উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ প্রয়োজন। তিনি বিশেষ করে উদীয়মান বাজার ও উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোতে প্রমাণিত কম নির্গমন প্রযুক্তি প্রদর্শন ও স্থাপন করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, অনেক ডিকার্বনাইজেশন প্রযুক্তির জন্য উল্লেখযোগ্য অগ্রিম বিনিয়োগের প্রয়োজন। অর্থায়নের সীমিত সুযোগ রয়েছে- এমন দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো সবচেয়ে দুর্বল উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এ ধরনের অধিক মূলধন বিনিয়োগ করা শিল্পের জন্য একটি বাধা হতে পারে।

প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশের মতো উদীয়মান উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতের শিল্পের জন্য রেয়াতি অর্থের সুযোগ লাভকে উৎসাহিত করে শিল্প ডিকার্বনাইজেশনের ক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য আর্থিক ব্যবস্থার বিকাশের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬.৮-এর অধীনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তি হস্তান্তর নিশ্চিত করা অপরিহার্য। আমদানিতে সুষম কার্বন খরচ আরোপ করে একটি সুষম ক্ষেত্র তৈরি করতে কার্বন মূল্য নির্ধারণ বা সীমা সমন্বয় করের আন্তর্জাতিক চুক্তির ওপর জোর দিয়ে ২০০৬ সালের নোবেল পিস লরিয়েট বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোতে (এলডিসি) তাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও উন্নয়ন চাহিদার প্রেক্ষিতে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।

শিল্পের ডিকার্বনাইজেশন সম্পর্কে ড. ইউনূস বলেন, কার্বন নির্গমন বিশ্বব্যাপী স্বল্প-কার্বন প্রযুক্তিভিত্তিক উদ্ভাবনের জন্য প্রণোদনা কমিয়ে দিতে পারে, কারণ কিছু খাত টেকসই ব্যবস্থা অনুশীলনের তুলনায় ব্যয়কে অগ্রাধিকার দিতে পারে। তিনি বলেন, এসব ঝুঁকি প্রশমিত করার জন্য অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার সঙ্গে ডিকার্বনাইজেশন প্রচেষ্টার ভারসাম্য বজায় রাখতে কার্বন সীমা সমন্বয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মতো নীতিগুলো অপরিহার্য।

ড. ইউনূস আরও বলেন, অন্যদিকে এসব নীতি বাংলাদেশের মতো বিশেষভাবে দুর্বল উন্নয়নশীল দেশের কোম্পানিগুলোর প্রতিযোগিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। অধিক নির্গমন নীতির কারণে উচ্চ উৎপাদন খরচের প্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী তাদের কম প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। তিনি আরও বলেন, স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য তাদের বিশেষ পরিস্থিতি ও উন্নয়ন চাহিদার কারণে অগ্রাধিকারমূলক ব্যবস্থার প্রয়োজন হবে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ইইউ প্রস্তাবিত কার্বন বর্ডার অ্যাডজাস্টমেন্ট মেকানিজম (সিবিএএম) রপ্তানিকৃত পণ্যগুলোতে নির্গমনের মান পরোক্ষভাবে প্রয়োগ করে এবং কার্বন নির্গমন প্রতিরোধ করে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে তাদের জলবায়ু নীতি শক্তিশালী করতে উৎসাহিত করতে পারে। অধ্যাপক ইউনূস বলেন, একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তনকে সমর্থন করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়াতে ও উদীয়মান বাজারে নতুন চাকরির সুযোগ তৈরি করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন।

এদিকে বাকুতে কপ-২৯ সম্মেলনে গতকাল ব্যস্ত সময় পার করেন ড. ইউনূস। বিশ্বের অন্তত ২০টি দেশের শীর্ষ নেতা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের সাথে দেখা করেছেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রেসিডেন্ট শেখ মোহাম্মদ বিন জায়েদ আল নাহিয়ানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জুলাই মাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ করার জন্য কারাবন্দি ৫৭ জন বাংলাদেশি নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমিরাতের রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান। অধ্যাপক ইউনূস পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ ছাড়া মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজু, ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং তোবগে এবং নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পৌডেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন তিনি।

এশিয়ার আটটি দেশের জন্য শীর্ষ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার আহ্বান জানিয়ে আসছেন ড. ইউনূস। এর আগে তিনি বলেছিলেন, সার্কের পুনরুজ্জীবন হবে তার পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি।

ড. ইউনূস বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী, ঘানার প্রেসিডেন্ট, বসনিয়া হার্জেগোভিনার প্রধানমন্ত্রী, রুয়ান্ডার প্রেসিডেন্ট, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী, মন্টেনিগ্রোর প্রেসিডেন্ট, বার্বাডোসের প্রধানমন্ত্রী, ব্রাজিল ও ইরানের ভাইস প্রেসিডেন্ট, ফিফার প্রেসিডেন্ট এবং আইওএম মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পাশাপাশি তিনি লিচেনস্টাইনের প্রধানমন্ত্রী ড্যানিয়েলের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

এদিকে সাক্ষাৎকালে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান ব্যাপক সংস্কার ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার অভিযাত্রায় বাংলাদেশকে সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। অধ্যাপক ইউনূস আজারবাইজানের বাকুর কপ-২৯ ভেন্যুতে বিশ্ব নেতাদের শীর্ষ সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তুরস্ক সফরের আমন্ত্রণ জানান এরদোয়ান। ড. ইউনূসও তাদেরকে শিগগিরই বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান।

অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সমৃদ্ধ হবে এবং উন্নতি করবে বলে আশা জানিয়েছেন আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যান্ড ইমাম ড. আহমেদ আল তাইয়েব। গতকাল মঙ্গলবার সকালে আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর রিটজ কার্লটন হোটেলে বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ইসলামিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. ইউনূস। এ সময় ড. ইউনূসকে হাজার বছরের পুরনো প্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা প্রদানের জন্য আমন্ত্রণ জানান গ্র্যান্ড ইমাম। আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ফুল ফান্ডেন্ড স্কলারশিপ ঘোষণা করবে বলেও জানান তিনি।

এদিকে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস গতকাল উদ্বোধনী বক্তব্যে কঠোর বার্তা দেন। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড লিডারস ক্লাইমেট অ্যাকশন সামিটে বক্তৃতাকালে জলবায়ু সংকেটর ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, ২০২৪ সাল হতে যাচ্ছে পৃথিবীর উষ্ণতম বছর, যেটি জলবায়ু ধ্বংসের একটি সুস্পষ্ট উদাহরণ। ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করছে- উল্লেখ করে গুতেরেস দেশগুলোকে নির্গমন কমাতে অবিলম্বে এবং কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, কেবলমাত্র আপনারাই বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ১.৫ ডিগ্রিকে হারাতে পারেন। একটি শক্তিশালী পরিকল্পনার মাধ্যমে পরিবেশগত বিপর্যয়কে সীমাবদ্ধ করবে।