ঢাকা ১২:৪২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প: ৬ জনের চক্রে হাপিস ৫০০ কোটি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১১:২৬:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৪
  • ২৫ বার

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাখা অর্থ অনুমোদন ছাড়াই খরচ, বাড়তি ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ এবং গোপনে প্রকল্পের পরিত্যক্ত লোহা (স্ক্র্যাপ) বিক্রির মাধ্যমে এই অর্থ লোপাট করেছে একটি চক্র। ছয়জনের এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিক ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কালাম। এ নিয়ে গত মে মাসে একটি অভিযোগও জমা পড়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া আজকের পত্রিকার নিজস্ব অনুসন্ধানেও অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

পাবনার রূপপুরের পরেই বিদ্যুৎ খাতে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে দফায় দফায় ব্যয় বাড়িয়ে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। দুটি ইউনিটে মোট ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট গত বছরের জুলাই মাসে উৎপাদনে এসেছে। কেন্দ্রটিতে ঋণ দিয়েছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এই প্রকল্পে এর আগে কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাও করেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ দামে নাটবল্টু কিনেছে। এসবের পর এবার নতুন করে অভিযোগ এল নয়ছয় করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের।

অনুসন্ধানে জানা যায়,  মাতারবাড়ী প্রকল্পে জরুরি খাতে ব্যয় করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এই অর্থ অতি জরুরি প্রয়োজনে ব্যয় করার কথা ছিল। কোনো রকম অনুমতি ছাড়া এই বরাদ্দের পুরোটাই ব্যয় করা হয়েছে। যে ১৫টি কাজের বিপরীতে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৪টি কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন সিপিজিসিএলের বোর্ড পরিচালকেরা। বাকি ১১টি কাজে কোনো অনুমতির তোয়াক্কাও করেনি ছয়জনের চক্রটি। এই চক্রে আছেন সিপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী অর্থ পরিচালক মোহাম্মদ শহীদ উল্ল্যা, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (নকশা) মো. কামরুল ইসলাম, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মতিউর রহমান ও সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. আলফাজ উদ্দীন।

অনিয়ম-১:  প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (পিডিপিপি) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক বিটুমিন বা পিচের মাধ্যমে করার কথা ছিল, এতে ৮০ কোটি টাকার মতো ব্যয় নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু চক্রটি এই সড়ক বিটুমিনের মাধ্যমে না করে সিমেন্ট ও কংক্রিটের ঢালাই দেয়। এতে বাড়তি ব্যয় হয় ১৭০ কোটি টাকা। এই কেনাকাটায় সিপিজিসিএলের বোর্ড সভার অনুমতি নেওয়া হয়নি।

অনিয়ম-২: মাতারবাড়ী প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ একর জমিজুড়ে স্ক্র্যাপ বা বাতিল লোহা স্তূপাকারে ছিল। এসব লোহা ছিল মূলত বিভিন্ন ধরনের শাটার। ঢালাই কাজে এসব শাটার ব্যবহার করা হয়। শাটারের দামসহ ধরে ঠিকাদারদের নির্মাণ খরচ দেওয়া হয়। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বাতিল লোহা প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। ফলে মাতারবাড়ী প্রকল্পে যা কিছুই পরিত্যক্ত হবে, তার মালিক সিপিজিসিএল। কিন্তু পরিত্যক্ত এসব লোহার বড় অংশই বিক্রি করে দিয়েছেন সিপিজিসিএলের এমডি ও তাঁর সহযোগীরা, যার মূল্য কম করে হলেও ৩০০ কোটি টাকা। লোহা বেচার এই অর্থ সিপিজিসিএলের কোষাগারে যায়নি। পুরোটাই লোপাট করেছে এমডির নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট।

অনিয়ম-৩: মাতারবাড়ী প্রকল্পে সাগরের সুরক্ষা ও ভূমি সুরক্ষার কাজটি করেছে বিদেশি ঠিকাদার হুন্দাই। প্রকল্পের ভেতর তাদের ৭৮ হাজার ৫০০ বর্গফুটের তিনটি স্টিল নির্মিত ভবন ছিল, যেখানে তাদের লোকেরা থাকতেন। সবার আগে হুন্দাইর কাজ শেষ হয় এবং তারা এই তিনটি ভবন রেখে প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করে। তিনটি ভবনে অন্তত ১৫ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ লোহা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী, এই ভবন তিনটির মালিক সিপিজিসিএল। কিন্তু হুন্দাইর নাম বলে তা বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

একইভাবে প্রকল্পে পসকোর ১২ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ বাইরে বিক্রি করা হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে প্রচার করে। অথচ পসকো ও হুন্দাই এসব বিক্রির অনেক আগেই প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করেছে।

সিপিজিসিএলের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এর আগে পায়রা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাতিল লোহা ওই কেন্দ্রের মালিকপক্ষ দরপত্র করে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপও দরপত্র আহ্বান করে বিক্রি করা হয়েছে। মাতারবাড়ী প্রকল্পেরও ৯ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ প্রথমে দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এরপর বলা হয়, এটি প্রকল্পের ঠিকাদার জাপানি কোম্পানির মালিকানাধীন স্ক্র্যাপ। ফলে তারা এই বাতিল লোহালক্কড় বিক্রি করবে। এই ঘোষণা দেওয়ার পর সেখানে থাকা প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার লোহা বিক্রি করা শুরু হয়। এসব লোহা বিক্রির অর্থ সিপিজিসিএলের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদের মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কল করা হয়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু ২২ আগস্ট পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব দেননি।

কান্ট্রি অব অরজিন পরিবর্তন করার অভিযোগ: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে লিখিত অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী যে দেশ থেকে যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা, সে দেশ থেকে না এনে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আনা হয়েছে। সিপিজিসিএলের এমডি আবুল কালাম আজাদ ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা নিয়েছে। তবে এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা আজকের পত্রিকার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে মতামত চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, যত বড় প্রকল্প তত বড় দুর্নীতি। বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এতে খরচের মাত্রাও অনেক বেশি। এখানে জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে, এখানে নাটবল্টু অস্বাভাবিক দামে কেনা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পের পুরোনো লোহালক্কড় বেচে দিচ্ছে প্রকল্পের কর্মকর্তারা। দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। না হলে বিদ্যুৎ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্প: ৬ জনের চক্রে হাপিস ৫০০ কোটি

আপডেট টাইম : ১১:২৬:৪১ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৪

কক্সবাজারের মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুর্নীতি ও অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। প্রকল্পের জরুরি প্রয়োজন মেটানোর জন্য রাখা অর্থ অনুমোদন ছাড়াই খরচ, বাড়তি ব্যয়ে সড়ক নির্মাণ এবং গোপনে প্রকল্পের পরিত্যক্ত লোহা (স্ক্র্যাপ) বিক্রির মাধ্যমে এই অর্থ লোপাট করেছে একটি চক্র। ছয়জনের এই চক্রের নেতৃত্বে ছিলেন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির মালিক ও বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল কালাম। এ নিয়ে গত মে মাসে একটি অভিযোগও জমা পড়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ে। এ ছাড়া আজকের পত্রিকার নিজস্ব অনুসন্ধানেও অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

পাবনার রূপপুরের পরেই বিদ্যুৎ খাতে দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটি নির্মাণে দফায় দফায় ব্যয় বাড়িয়ে সর্বশেষ ব্যয় ধরা হয় ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা। দুটি ইউনিটে মোট ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের মধ্যে ৬০০ মেগাওয়াটের একটি ইউনিট গত বছরের জুলাই মাসে উৎপাদনে এসেছে। কেন্দ্রটিতে ঋণ দিয়েছে জাপানের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা। এই প্রকল্পে এর আগে কেন্দ্রের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে স্থানীয় জেলা প্রশাসকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। এ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলাও করেছে। এ ছাড়া সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটি উচ্চ দামে নাটবল্টু কিনেছে। এসবের পর এবার নতুন করে অভিযোগ এল নয়ছয় করে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাতের।

অনুসন্ধানে জানা যায়,  মাতারবাড়ী প্রকল্পে জরুরি খাতে ব্যয় করার জন্য প্রায় ১ হাজার ৩৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। এই অর্থ অতি জরুরি প্রয়োজনে ব্যয় করার কথা ছিল। কোনো রকম অনুমতি ছাড়া এই বরাদ্দের পুরোটাই ব্যয় করা হয়েছে। যে ১৫টি কাজের বিপরীতে এই অর্থ ব্যয় হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ৪টি কাজের অনুমতি দিয়েছিলেন সিপিজিসিএলের বোর্ড পরিচালকেরা। বাকি ১১টি কাজে কোনো অনুমতির তোয়াক্কাও করেনি ছয়জনের চক্রটি। এই চক্রে আছেন সিপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী অর্থ পরিচালক মোহাম্মদ শহীদ উল্ল্যা, ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী (নকশা) মো. কামরুল ইসলাম, উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) মতিউর রহমান ও সহকারী নিরাপত্তা কর্মকর্তা মো. আলফাজ উদ্দীন।

অনিয়ম-১:  প্রকল্পের প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনায় (পিডিপিপি) বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরের সড়ক বিটুমিন বা পিচের মাধ্যমে করার কথা ছিল, এতে ৮০ কোটি টাকার মতো ব্যয় নির্ধারণ করা ছিল। কিন্তু চক্রটি এই সড়ক বিটুমিনের মাধ্যমে না করে সিমেন্ট ও কংক্রিটের ঢালাই দেয়। এতে বাড়তি ব্যয় হয় ১৭০ কোটি টাকা। এই কেনাকাটায় সিপিজিসিএলের বোর্ড সভার অনুমতি নেওয়া হয়নি।

অনিয়ম-২: মাতারবাড়ী প্রকল্পের অভ্যন্তরে প্রায় ১০০ একর জমিজুড়ে স্ক্র্যাপ বা বাতিল লোহা স্তূপাকারে ছিল। এসব লোহা ছিল মূলত বিভিন্ন ধরনের শাটার। ঢালাই কাজে এসব শাটার ব্যবহার করা হয়। শাটারের দামসহ ধরে ঠিকাদারদের নির্মাণ খরচ দেওয়া হয়। কোনো উন্নয়ন প্রকল্পের বাতিল লোহা প্রকল্পটি বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের সম্পদ। ফলে মাতারবাড়ী প্রকল্পে যা কিছুই পরিত্যক্ত হবে, তার মালিক সিপিজিসিএল। কিন্তু পরিত্যক্ত এসব লোহার বড় অংশই বিক্রি করে দিয়েছেন সিপিজিসিএলের এমডি ও তাঁর সহযোগীরা, যার মূল্য কম করে হলেও ৩০০ কোটি টাকা। লোহা বেচার এই অর্থ সিপিজিসিএলের কোষাগারে যায়নি। পুরোটাই লোপাট করেছে এমডির নেতৃত্বাধীন সিন্ডিকেট।

অনিয়ম-৩: মাতারবাড়ী প্রকল্পে সাগরের সুরক্ষা ও ভূমি সুরক্ষার কাজটি করেছে বিদেশি ঠিকাদার হুন্দাই। প্রকল্পের ভেতর তাদের ৭৮ হাজার ৫০০ বর্গফুটের তিনটি স্টিল নির্মিত ভবন ছিল, যেখানে তাদের লোকেরা থাকতেন। সবার আগে হুন্দাইর কাজ শেষ হয় এবং তারা এই তিনটি ভবন রেখে প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করে। তিনটি ভবনে অন্তত ১৫ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ লোহা ছিল। নিয়ম অনুযায়ী, এই ভবন তিনটির মালিক সিপিজিসিএল। কিন্তু হুন্দাইর নাম বলে তা বাইরে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

একইভাবে প্রকল্পে পসকোর ১২ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ বাইরে বিক্রি করা হয় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সম্পদ হিসেবে প্রচার করে। অথচ পসকো ও হুন্দাই এসব বিক্রির অনেক আগেই প্রকল্প এলাকা ত্যাগ করেছে।

সিপিজিসিএলের দুজন শীর্ষ কর্মকর্তা আজকের পত্রিকাকে জানিয়েছেন, এর আগে পায়রা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাতিল লোহা ওই কেন্দ্রের মালিকপক্ষ দরপত্র করে বিক্রি করেছে। এ ছাড়া পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের স্ক্র্যাপও দরপত্র আহ্বান করে বিক্রি করা হয়েছে। মাতারবাড়ী প্রকল্পেরও ৯ কোটি টাকার স্ক্র্যাপ প্রথমে দরপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। এরপর বলা হয়, এটি প্রকল্পের ঠিকাদার জাপানি কোম্পানির মালিকানাধীন স্ক্র্যাপ। ফলে তারা এই বাতিল লোহালক্কড় বিক্রি করবে। এই ঘোষণা দেওয়ার পর সেখানে থাকা প্রায় আড়াই শ কোটি টাকার লোহা বিক্রি করা শুরু হয়। এসব লোহা বিক্রির অর্থ সিপিজিসিএলের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়নি।

এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে সিপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদের মোবাইল ফোনে দফায় দফায় কল করা হয়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরেও বার্তা পাঠানো হয়। কিন্তু ২২ আগস্ট পর্যন্ত তিনি কোনো জবাব দেননি।

কান্ট্রি অব অরজিন পরিবর্তন করার অভিযোগ: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের বিদ্যুৎ বিভাগের কাছে লিখিত অভিযোগে দাবি করা হয়েছে, চুক্তি অনুযায়ী যে দেশ থেকে যন্ত্রপাতি দেওয়ার কথা, সে দেশ থেকে না এনে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভারত থেকে আনা হয়েছে। সিপিজিসিএলের এমডি আবুল কালাম আজাদ ও ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এই সুবিধা নিয়েছে। তবে এই অভিযোগের সত্যতা যাচাই করা আজকের পত্রিকার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে মতামত চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম আজকের পত্রিকাকে বলেন, যত বড় প্রকল্প তত বড় দুর্নীতি। বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর মধ্যে মাতারবাড়ী সবচেয়ে ব্যয়বহুল প্রকল্প। এতে খরচের মাত্রাও অনেক বেশি। এখানে জমি অধিগ্রহণে দুর্নীতি হয়েছে, এখানে নাটবল্টু অস্বাভাবিক দামে কেনা হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে এই প্রকল্পের পুরোনো লোহালক্কড় বেচে দিচ্ছে প্রকল্পের কর্মকর্তারা। দ্রুত ট্রাইব্যুনাল গঠন করে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। না হলে বিদ্যুৎ খাতে শৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।