সাহিত্য বিষয়ক সংগঠন বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ প্রসঙ্গ

ড.গোলসান আরা বেগমঃ কালের সাক্ষী হয়ে সাহিত্য অঙ্গনে নারী লেখিকাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ। কত লেখিকাকে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে, পথ দেখিয়েছে। সাহিত্য অঙ্গনে জামদানী শাড়ির আঁচল বিছিয়ে দিয়ে, বসতে দিয়ে,নারী  লেখকের হাতে তুলে দিয়েছে, লেখার ঘটক সোনালি কলম। সন্মানিত করে যাচ্ছে খ্যাত বিখ্যাত লেখকদের, তৈরি করছে সেতু বন্ধুন সাহিত্য জগতের লেখকদের মাঝে।চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ,সৃষ্টিশীল কাজে, মানানসই আড্ডায়, ধর্মে,কর্মে  সকল স্তরেই নারীরা রাখতে পারে অবদান। মেয়েরা পারে না,পারবে না – এই উক্তিটির মুখে দিয়েছে ছাই।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সত্তরের দশকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নারী লেখকদের একতাবদ্ধ করার প্রয়োজন দেখা দেয়।তাদের মেধার স্ফুরণ ঘটাতে হলে একটি ফুলের বৃন্তে আবদ্ধ হতে হবে।কে কেমন লিখছে, কি লিখছে তা ঘষে মেজে আরো শক্তিশালী করে দ্যুতি ছড়াতে হলে- ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিকল্প নেই। যতই ভালো লিখি না কেন,তা বালিশের নিচে রেখে দিলে  তা হবে মূল্যহীন।এই তাড়না থেকে বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ এর জন্ম হয় ১৯৭৩ সালে১৭ ডিসেম্বর।এর পর হাঁটি হাঁটি পা পা করে সংগঠনটি আজকের উজ্জলতর অবস্থানে এসে পৌঁছেছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নারী লেখকরা গান লিখে, গেয়ে,কবিতা আবৃত্তি করে যুদ্ধকে করেছে বেগবান, যুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীনতা নামক ফুল ছিনিয়ে আনে বাঙালি।সে ক্ষেত্রে নারী লেখকদের অবদান কম ছিলো না।
নারী লেখকদের দ্বারা পরিচালিত বাংলাদেশ লেখিকা সংঘের প্রতিষ্ঠা কালিন সময়ে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন — বেগম সুফিয়া কামাল, বেগম খোদেজা খাতুন, বেগম শামস রশিদ, সৈয়দা লূৎফুন্নিসা এবং বেগম মাজেদা খাতুন।প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন বেগম খোদেজা খাতুন প্রমুখ।ঢাকা কেন্দ্রিক এই প্রতিষ্ঠানটির বাহিরেও রয়েছে বহু শাখা সংগঠন।
বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ১৯৮৫ সাল থেকে ” বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ সাহিত্য পুরস্কার” এই শিরোনামে সাহিত্য পুস্কার দিয়ে আসছে।প্রতি বছর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে দুই জন খ্যাত লেখককে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়।
আগামী ২০২৩ সালে সংগঠনটি ৫০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উদযাপন করবে।ইতোমধ্যে এই সংগঠনের নিবেদিত অনেক কর্মি লেখক না ফেরার দেশে হারিয়ে গেছে, আবার বিধিমোতাবেক নতুন সদস্য যুক্ত হচ্ছে।বর্তমানে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় ২০০ জন।সামনে আরো অনেক সফলতা অর্জন করার প্রত্যয় ও প্রত্যাশা রয়েছে। প্রতিবছর বিভিন্ন লেখকের বই প্রকাশনার দায়িত্ব বহন করে।প্রতিভাবান লেখক খুঁজে বের করা, তাদের মূল্যায়ন করা,ম্যাগাজিন প্রকাশ  ও কবিতা পাঠের আসরের আয়োজন করা এই সংগঠনের কাজ। তাছাড়া কার্যনিবাহী কমিটির মিটিং,স্মরণসভা, মতবিনিময় সভা, সেবা ক্ষেত্রে অনুদান প্রদান ও উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নিয়ে থাকে।লেখিকা সংঘ থেকে প্রকাশিত গ্রন্থ ও জার্নালগুলো হচ্ছে- সঞ্চয়ন , বোবা কান্না,জাগ্রত শতাব্দী,হৃদয়ে কৃষ্ণচূড়া,প্রিয় পংক্তিমালা,বৃস্টি ভেজা মুখ এবং শত পুষ্প ( ৩ খন্ড) ইত্যাদি। সাহিত্যে অর্জন ঃ বাংলাদেশের নারী(১ম খন্ড ও ২য় খন্ড)বিশেষ উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
লেখিকা সংঘের রয়েছে একটি ” আলাপ পাতা” অনলাইন একাউন্ট। যে কেউ ইচ্ছে করলে এই এই একাউন্টে ঢুকে সংঘটনটির উন্নয়নে মতামত ও পথ চলায় উপদেশ দিতে পারেন। তবে আলাপ পাতার আলোচনায় অংশ গ্রহন করতে হলে বিধিমোতাবেক একটি অনলাইন একাউন্ট খুলতে হবে। গুগল একাউন্টে বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে।আসুন নারী লেখিকারা সংগঠনকে ভালোবেসে সদস্য হই ও আলাপন পাতার আলোচনায় অংশ গ্রহন করি। প্রতি একুশে বই মেলায় সংগঠনের নারীদের বই দিয়ে মেলা চত্ত্বরে স্টল সাজানো হয়।ওখান থেকে সকলেই বই সংগ্রহ করতে পারেন। বই ক্রয়ের আরো সুবিধা পেতে পারেন বিক্রয় ডটকম থেকে। এই সংগঠনের “ভাষা আমার বাংলা ভাষা” বইটি পড়তে হলে “মুক্তিযুদ্ধ ই-লাইব্রেরি” এ্যাপটি নামাতে পারেন।
বর্তমানে (২০২৩ সালে) আমার প্রিয় সংগঠনটির সভাপতি বিশিষ্ঠ সাহিত্যিক প্রফেসর অনামিকা হক লিলি এবং সাধারন সম্পাদক বিশিষ্ঠ লেখক, নাট্যকার ড. লিপি মনোয়ার এর দৃঢ় নেতৃত্তে পারিচালিত হচ্ছে।আমার মাথার ছত্র ছায়া রোকেয়া পদক বিজয়ী,লেখক, সংগঠক,শিক্ষাবিদ বেগম রাজিয়া হোসাইন এই সংগঠনের নামী দামী ব্যক্তিত্ব এবং প্রধান উপদেষ্ঠা।আমি তাঁর স্নেহ আদরের ছাত্রী, সহসভাপতির আসনে কাজ করছি। সেই থেকে কার্যনিবাহী কমিটির মিটিংএ অংশ গ্রহন করছি,লিখছি সঞ্চয়নে,সংগঠনের ভালো মন্দ দেখার চেস্টা করছি। জাতীয় যাদুঘরের সুফিয়া কামাল অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত বিগত বছরের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহন করেছি। বার্ষিক  শোক প্রস্তাবটি করেছি উপস্থাপন।
সংগটনের কল্যাণে আরো কিছু কাজ করার আগ্রহ মনের ঘরে জমা থাকলেও প্রতিফলন ঘটাতে পারবো কিনা জানি না।তবে প্রাণপণে চেষ্টা করবো।
গুহাবাসি আমাদের পুর্ব পুরুষরা পাথরে খোদাই করে,তাম্র লিপিতে লিখে রেখে গিয়েছিল তাঁদের মনের অনুভূতি। হাজার হাজার বছর অতিক্রম করে সেখান থেকেই মনের কথা, আবেগ, অনুভূতি প্রকাশ কালক্রমে এসে দাঁড়ায় সহিত্যাঙ্গনে। তারপর আবিস্কার করা করা হয় অনেক অসাধ্যের দেয়াল ভেঙ্গে কাগজ, কালি, বই খাতা,আরো প্রয়োজনীয় উপাদান।
ডিজিটাল যুগে সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে নখের ডগায়।পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে গ্লোবাল ভিলেজে করছে আমব্রেলা বন্দি। তৈরি করেছে বহুধিক লিখার মাধ্যম।ইচ্ছে করলেই ফেইজ বুক পেইজে লিখতে ও পড়তে পাড়ি। যে কোন তথ্য পাঠিয়ে দিতে পারি পৃথবীর দুর মুল্লুকে। লিখা সংগ্রহ করতে পারি সফট কপি হিসেবে গুগলে, বাংলাপিডিয়ায়, আর্কাইবে, হার্ড মাধ্যম হিসেবে বই,জার্নাল,ম্যাগাজিন,লাইব্রেরি,গবেষণা পত্র, অভিধানে,পেনড্রাইবে, ভিডও অডিও ক্যাসেডে। সর্বোপরি মানুষের মনের মণি কোঠায়,আজ সর্ব জয়ের মন্ত্র।
আদি এবং একমাত্র নারী কবি চন্দ্রাবতীর কথা উল্ল্যেখ না করলেই নয়। তাঁর কালজয়ী লেখা সাহিত্য অঙ্গনকে করেছে কৃতার্থ। নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়াও কলম ধরেছিলেন শক্ত হাতে।সমাজ বির্নিমানে তার লেখার অবদানের কথা অতুলনীয়।নারী সমাজকে জাগিয়ে তুলেছিলেন কালি ও কলম পিষে। অজ্ঞতা,অপসংস্কৃতির অন্ধকার কুঠুরী থেকে মুক্ত করে আনেন নানা যুক্তি,তর্ক খন্ডন করে। বেগম রোকেরয়ার তেজস্বি ভূমিকার জন্য নারীজাগরণের বিপ্লবে আসে গতিশীলতা, অতঃপর আসে নারী মুক্তি। নারীরা আজ মুক্ত  বাতাসে যুক্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। কোমর সোজা করে,মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে নিজের অধিকার আদায়ে লড়াই করছে,নারী পুরুষে সমাধিকারের পক্ষে তুলছে জিগীর। সেই স্পৃহা থেকে নারীরা হয়েছে লেখক,গড়েছে বহু মতাদর্শের সাহিত্য সংগঠন। সেই ধারাবাহিকথায় শুধু নারী লেখকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ। আরো নতুন আঙ্গিকে সংগঠনটি সাহিত্য কল্যাণে  উজ্জল থেকে উজ্জলতর অবস্থানে পৌঁছে যাবে – এই করি প্রত্যাশা।
বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ দেশের সাহিত্য অঙ্গনে আগিয়ে যাবার দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহন করেছে এবং দিনে দিনে আলো সম্প্রসারণ করে লেখিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করছে।লেখার মান বৃদ্ধি প্রশ্নে আলোচনা সমালোচনার অবকাশ নিয়ে, মূল্যায়নের সুযোগ নিচ্ছে।অনেক লেখিকা এি দীর্ঘ পরিসরে বহুরকম পুরস্কার পেয়েছে।নারী লেখকগণ আর বন্দি নয়- আত্মমুক্তির আস্বাদনে নিজেকে প্রকাশ করার স্বাধীনতা পেয়েছে।এমন দিন ছিলো বলা হত, নারীর কলম ধরাই পাপ কার্য।দিন বদলে গেছে। আমাদের লেখিকা সংঘ এগিয়ে যাবে দ্রুত,বলিষ্ঠতায় ঈপ্সিত লক্ষ্যে।এটাই আমাদের দৃঢ় সংকল্প।
লেখকঃ সহসভাপতি, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ।
Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর