জীবন সায়ান্নের কথা ভাবুন

ড. গোলসান আরা বেগমঃ ভেবে দেখেন তো জীবনের শেষ অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে আপনি কেমন আছেন। আপনার মনের তেজী ঘোড়াটা উধ্বশ্বাসে দৌড়াতে চায়,কিন্তু পারেন কি? উড়ন্ত পাখির মত হারিয়ে ইচ্ছে করে দূর আকাশে,যৌবনের রোদেলা দুপুরের অনেক কথাই মনে পড়ে। অর্থ সম্পদ, খ্যাতি, পদবি জড়ো করেছেন, তাতে মন ভরে না।আরো চাই,অমুকের এই আছে, হাতি ঘোড়া অনেক কিছু আমারও চাই। কিন্তু হাত পা তো আগের গতিতে চলে না।

এক সময়ে রাত দিন ছুটাছুটি করতেন, দু’ হাতে কামাই করতেন স্ত্রী সন্তানের জন্য ইঞ্চি ইঞ্চি করে সম্পদ। মানতেন না কোন নিষেধ মানা।প্রয়োজনে ভাংতেন নিজের স্বার্থে বা প্রয়োজনে পরের মাথায় কাঁঠাল। আরো চাই আরো চাই এর পেছনে উড়তে থাকতেন ফড়িংয়ের মতো। সাধ্যেরও বেশী শ্রম ঘাম ব্যয় করতেন আয়েশী রাজ প্রাসাদ নির্মানের পেছনে। একবারও ভেবে দেখতেন না — এ সব কিচ্ছিু আপনার না।যাদের সুখের জন্য সঞ্চয় করছেন, তারাও আপনার না। জীবনের মিছে ফাঁদে পড়ে শুধু মরিচিকার পেছনে ছুটছেন। সমাজ,রাষ্ট্র, সাধারণ মানুষের কল্যাণে কতটুকু অবদান রেখেছেন,তা মূল্যায়নে ভার আপনার উপরেই রইলো। তবে পান থেকে চূন খসলে স্ত্রী নামক প্রণীটিকে অবমূল্যায়ন করতে ভুল করেননি, ঠিক বলিনি?

এই মাত্র জানতে পারলাম এক বৃদ্ধ অসহার পিতার নির্মম মৃত্যু কাহিনী। তিন সন্তানের বাবা যথেষ্ট সম্পদের মালিক ছিলেন। বড় দুই সন্তানকে তাঁর বাড়ী লিখে দিয়েছেন। কিন্তু ছোট সন্তানকে কিছু জমি জমা দিয়েছেন, যা নিয়ে সে সন্তুষ্ট নয়। বাড়ি না দেয়ার কারণ হলো, সে সন্তানটি পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছে।সে বিয়েকে বাবা মেনে নিতে পারেনি।

মানুষ জানে না অর্থ সম্পদ মানুষের কত বড় শত্রু। সামান্য কথা কাটাকাটির রেশ ধরে বাবাকে ছেলে অনিচ্ছাকৃত ভাবে আঘাত করে। সে আঘাতে বাবা মারা যায়। এখানেই শেষ নয়, আমাদের চারপাশে এর চেয়ে আরো নির্মম নির্দয় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে প্রতিদিন। কেউ কেউ বুড়ু বাবা মা’কে রেখে আসছে বৃদ্ধাশ্রমে বা গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিচ্ছে বাড়ী থেকে। এই যদি হয় জীবন চিত্র,তা হলে কেন করি এতো হৈচৈ,কাড়াকাড়ি,ঠকবাজী,খাই খাই রীতিনীতির চর্চা।

সব মানুষ জানে, মৃত্যু অনিবার্য সত্য, সর্বদা কানের পাশে ঘুরাঘরি করে। নিঃশ্বাস করে নাকের নীচে উড়াউড়ি।যে কোন সময় যমদূত টেনে নিবে না ফেরার দেশে। এখন না তখন, যে কোন সময়, সাঙ্গ হবে দুনিয়ার পুতুল খেলার ছলনা। সে যাত্রায় কেউ হবে না সঙ্গের সাথী। শরীরের ঘাম ঝরানো সম্পদ যা যেখানে আছে জানাবে বিদায়।সঙ্গে যাবে আমলনামা, হাত পা,এক টুকরো সাদা কাপড়। নিজের মনকে বলুন এসব কথা।

আমরা এও জানি সব বরসে, সব কিছু মানানসই নয়। ভোরের সূর্য উদয় সন্ধ্যায় দেখা যাবে না। পাবো না চাঁদের ঝকমকে হাসি মধ্য দুপুরে। চৈত্রের গীত বৈশাখে গাইলে হবে না। ঠিক তেমনি ছোট বেলার ধূলোবালির পুতুল খেলা জীবনের অপরাহ্নে মানাবে না। চাইলেই পারবো না দমা দম মাসক্যালেন্ডার গান গেয়ে ষ্ট্যাইজ শো উপহার দিতে। অলরাউন্ডার ক্রিকেটার সাকিব খানের মত খেলোয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখা উচিত হবে না।

হাতে পায়ের শক্তি যখন কমে আসবে, এদিন কোমড়ে ব্যথা,ঐ দিন হাটুতে।তখন শরীর নামক যন্ত্রটির গতি কমে যাবে। বন্ধুদের সাথে সখ্যতা, আড্ডা, রসালাপ ক্রমান্নয়ে থেমে আসবে। পুরানো দিনের গান ছাড়া কিছুই ভালো লাগবে না। খাঁচায় বন্দি ময়না পাখিটির মত ধরফর করবে জীবন ।

কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন –প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া কেহ কখনো জয়ী হতে পারে না। আপনি চেষ্টা করলেও হিমালয় জয় করতে পারবেন না। বার্ধক্যকে নত শিরে বিনা বাক্য ব্যয়ে মেনে নিতে হবে।ঝরা পাতায় যতই পানি দেই না কেন তারুণ্য ফিরে আসবে না। চির সত্য কে মানতেই হবে।

আরো একটু ভেবে দেখুন তো– বুড়ু বয়সে আপনার সেবা যত্ন কে করবে? হাঁটতে পারেন না,স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় অচল, তখন কি হবে? ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলে দুধ কলা দিয়ে যাদের পোষেছেন, তারা পাশে দাঁড়াবে। অন্যথায় থাকবে নানা প্রকার বিড়ম্বনা।আসুন উদাহারণ টেনে বলি বিখ্যাত কয়েক জন স্বনাম ধন্য ব্যক্তির জীবনের শেষ অধ্যায়ের কথা —

জার্মান কবি ফ্রেডারিক হোন্ডারলিন জীবনের শেষ ৩৪ বছর মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পাগলের মত হয়ে ছিলেন।বউ ছেলে মেয়ে দুরের কথা, তিন কুলে তাঁর কেউ ছিলো না।জীবনের শেষ কয়েক বছর একটি গরিব মুচি পরিবার তাঁর দেখাশোন করতো। ফ্রেডারিক নামক যে লোককে তারা দয়া করে ঘুমানোর জায়গা দিয়ে এবং রুটি খাইয়ে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন, সেই লোক যে উনিশ শতকের বিরাট কবি তা তারা জানতেন না। বাংলা ভাষার কবি বিনয় মজুমদার ছিলেন অবিবাহিত এবং ৩৪ বছর মানসিক রুগী হয়ে বেঁচে ছিলেন।বিনয়কে জীবনের শেষ কয়েকটা দিন খাওয়া পরার জোগান দিয়েছিলেন এক গরিব ফুল বিক্রেতার পরিবার।তারা কবিতা কি,কিছু জানতেন না।তাদের কাছে বিনয় ছিলেন পাগল দাদু ( ৩১ মার্চ ২০২৩,দৈনিক প্রথম আলো)। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলম জীবনের শেষ দিকে ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন। তিনি তাঁর পরিবারের সঙ্গে বসবাস করতেন বাংলাদেশে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী প্রমিলা দেবি দেখবাল করতেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিভাগের অবসর প্রাপ্ত একজন অধ্যাপক আগারগাও প্রবীন হিতৈষী বৃদ্ধাশ্রমে জীবন যাপন করছেন।অথচ তাঁর রয়েছে নামী দামী চাকুরী করে এমন দু’টো ছেলে সন্তান ও এক মেয়ে। তাঁর তো এখানে থাকার কথা না। বহু নারী পুরুষ জীবন সায়ান্নে এসে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়েছে ঠাঁই। এ করণেই বৃদ্ধাশ্রমের কদর ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে।আমিও ভাবছি বৃদ্ধাশ্রমে নিজের নাম নিবন্ধন করবো কি না।

কেউ বলতে পারবে না,কার জীবন সায়ান্নের অধ্যায় কেমন হবে। কে কোথায় ধুকে ধুকে মরবে। জীবন স্মৃতির রীল টানতে টানতে আসবে ঘুরে রাতের পর দিন। এরপর মহা অন্ধকারের অপেক্ষায় আকাশের তারা গুনা এবং ইয়ানাফসি ইয়ানাফসি জপমালা করা ছাড়া কিছুই ভালো লাগবে না।

লেখক ঃ উপদেষ্টা, বাংলাদেশ কৃষকলীগ।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর