ঢাকা ০৮:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:৫৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ ২০২২
  • ২২১ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রকৃতির বিরুদ্ধচারণ করে টিকে থাকার চিন্তা করাও বোকামী। আর সেই কাজটি করেছিলেন চীনের কমিউনিষ্ট নেতা মাও সে তুং। যা দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন নামে পরিচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনক মাও সে তুং একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবেশ থেকে চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করার।

সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে প্রায় ৬৫ কোটি চড়ুই পাখি নিধন করা হয়েছিলো। কিন্তু এমন অন্যায় সহ্য করেনি প্রকৃতি, কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ের ফলে পরবর্তী তিন বছরের মাথায় চীনে প্রাণহানির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৫ মিলিয়নে।

দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড

এসব কিছুর শুরুটা হয়েছিল নয় বছর আগে। ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। অর্থনীতিকে অতি দ্রুত বদলে দিয়ে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সে বছরই মাও সে তুং ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ প্রকল্পের ঘোষণার মাধ্যমে সরকারিভাবে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন।

আর এটাকে সফল করতে দেশব্যাপী কৃষিশিল্পকে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ের ক্ষুদ্র চাষাবাদকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কৃষি বিপ্লবকে সফল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিল চীনারা।

আর এরই অংশ হিসাবে মাও সে তুংয়ের নেয়া প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল ফসল রক্ষা করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাও সে তুংয়ের কাছে আসা রিপোর্টে বলা হয়েছিল, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলছে আমাদের চারপাশে বসবাসরত চড়ুই পাখির দল।

দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন

১৯৫৮ সালে মাও সে তুং চারটা প্রাণীকে চীনের উন্নয়নের জন্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই তালিকায় ছিল ইঁদুর, মশা, মাছি এবং চড়ুই। বিশেষ করে ইউরেশিয়ান গেছো চড়ুইকে মারার জন্য টার্গেট করে গণহারে শুরু হলো চড়ুই মারা।

কিন্তু প্রায় ৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল আয়তনের এই দেশটি থেকে রাতারাতি চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করে দেয়া তো খুব ছোট কোন বিষয় না। তাই চড়ুই পাখি নিধনের জন্য রীতিমতো গবেষণাও চালানো হয়েছিল। চড়ুই নিধনের জন্য শব্দকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো।

লোকে ড্রাম আর থালা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ত, চড়ুই পাখি দেখলেই বাজানো শুরু করতো। প্রবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দে ছোট পাখিগুলো ভীত হয়ে পালাতো, কিন্তু চারপাশের ক্রমাগত আওয়াজে একসময় দুর্বল হয়ে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতো ছোট্ট পাখিগুলোর।

যেভাবে সফল হয়েছিলো দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন

সেসময় চীনারা দেশপ্রেমের টানে দলে দলে চড়ুই নিধন করতে দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন -এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সাংহাইয়ের একটি পত্রিকার রিপোর্ট ছিলো ঠিক এইরকম, “১৩ই ডিসেম্বর সকালে, সবখানে বেজে উঠলো চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা। বড় ছোট সড়কগুলোতে দেখা গেল লাল পতাকা। চারিদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য কাকতাড়ুয়া, কুশপুত্তলিকা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারী অফিসের কর্মী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক, পিপলস লিবারেশন আর্মি সকলেই ছুটে চলেছে যুদ্ধের জয়গান গেয়ে।

জিনসেং জেলায়, রাতারাতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে ৮০ হাজার কাকতাড়ুয়া ও লক্ষাধিক রঙিন পতাকা। জিয়েতু সড়ক, জুহুই জেলা, ইয়াংপু সড়ক, ইউলিন জেলা সবখানেই দেখা গেছে কাকতাড়ুয়া।

মূলত, কম বয়সী মানুষের ঘাড়ে পড়েছে চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। আর বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হয়েছে প্রহরীর দায়িত্ব। শহরের কারখানাগুলোর শ্রমিকেরাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছে। এর আগে অবশ্যই তারা দিনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে নেবে বলেও নিশ্চয়তা দিয়েছে।

যেখানে মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, সেসব জায়গাতে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রায় দেড় শতাধিক ফ্রি ফায়ার জোন স্থাপন করা হয়েছিল। নানইয়াং গার্লস মিডল স্কুলের রাইফেল টিমকে পাখি শিকার করার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। গৃহিণীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন থালা, বাটি, হাড়ি, পাতিল নিয়ে। চামচ বা লাঠির আঘাতে সেগুলোকে ঢোল হিসেবে ব্যবহার করে নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন তারা।

চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করা, ডিম ভেঙে ফেলা, গুলি করা, বন্দী করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছিল সেদিনকার বীভৎস কর্মসূচীর মুখ্য অংশ। এভাবেই চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেমেছিল সাংহাই শহরের বাসিন্দারা। হিসেব মতে, রাত আটটা পর্যন্ত প্রায় ১,৯৪,৪৩২টি চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়েছে।”

চড়ুই নিধন সংক্রান্ত এক করুণ ঘটনার সাক্ষী ছিল বেজিংয়ে অবস্থিত পোলিশ দূতাবাস। শোনা যায় আশেপাশে লোকের আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রচুর চড়ুই পাখি দূতাবাসের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পোলিশ কর্তৃপক্ষ চিন সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও দূতাবাসের ভেতর চড়ুই নিধনকারীদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে মানবতার খাতিরে।

এতে ক্ষেপে গিয়ে এম্বেসি ঘিরে হাজার হাজার লোক রাতদিন ড্রাম বাজাতে থাকে। ড্রামের বিকট শব্দে হার্টফেল করে মারা যায় অনেক চড়ুই। এভাবে টানা দুইদিন বাজানোর পর লোকজন সরে গেলে দেখা যায় দূতাবাসের উঠানে এত পরিমাণ মরা চড়ুই পড়ে আছে যে তাদের লাশ সরানোর জন্য পোলিশদের বেলচা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিল।

ক্যাম্পেইন পরবর্তী অবস্থা

চিনাদের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগলো না। ধেয়ে এলো প্রকৃতির নির্মম আঘাত। প্রথমত, শস্য দানার পাশাপাশি চড়ুই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা।

পঙ্গপাল সহ ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে লাগলো ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়লো কোটি কোটি মানুষ।

‘দি গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে সরকারের হিসেবে প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে অনুমান করা হয় এ সংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটি ৩০ লক্ষের মধ্যে। শেষমেশ চিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করতে বাধ্য হয়।

এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ চড়ুইপাখি আমদানি করার মত অদ্ভুত আরেক রেকর্ডেরও জন্ম দেয় মাও সে তুংয়ের চীন!

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

‘দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন’ ও প্রকৃতির প্রতিশোধ

আপডেট টাইম : ০৫:৫৩:৪৫ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মার্চ ২০২২

হাওর বার্তা ডেস্কঃ প্রকৃতির বিরুদ্ধচারণ করে টিকে থাকার চিন্তা করাও বোকামী। আর সেই কাজটি করেছিলেন চীনের কমিউনিষ্ট নেতা মাও সে তুং। যা দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন নামে পরিচিত। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের জনক মাও সে তুং একদিন সিদ্ধান্ত নিলেন পরিবেশ থেকে চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করার।

সে আদেশ যথাযথভাবে পালন করতে প্রায় ৬৫ কোটি চড়ুই পাখি নিধন করা হয়েছিলো। কিন্তু এমন অন্যায় সহ্য করেনি প্রকৃতি, কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়। যে বিপর্যয়ের ফলে পরবর্তী তিন বছরের মাথায় চীনে প্রাণহানির সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় ৪৫ মিলিয়নে।

দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড

এসব কিছুর শুরুটা হয়েছিল নয় বছর আগে। ১৯৪৯ সালে ক্ষমতায় আসে কমিউনিস্ট পার্টি। অর্থনীতিকে অতি দ্রুত বদলে দিয়ে এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যে সে বছরই মাও সে তুং ‘দ্য গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ প্রকল্পের ঘোষণার মাধ্যমে সরকারিভাবে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেন।

আর এটাকে সফল করতে দেশব্যাপী কৃষিশিল্পকে পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ব্যক্তিপর্যায়ের ক্ষুদ্র চাষাবাদকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কৃষি বিপ্লবকে সফল করতে সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছিল চীনারা।

আর এরই অংশ হিসাবে মাও সে তুংয়ের নেয়া প্রাথমিক পদক্ষেপগুলোর একটি ছিল ফসল রক্ষা করা। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মাও সে তুংয়ের কাছে আসা রিপোর্টে বলা হয়েছিল, উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ফসল খেয়ে ফেলছে আমাদের চারপাশে বসবাসরত চড়ুই পাখির দল।

দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন

১৯৫৮ সালে মাও সে তুং চারটা প্রাণীকে চীনের উন্নয়নের জন্য বাধা হিসেবে চিহ্নিত করেন। এই তালিকায় ছিল ইঁদুর, মশা, মাছি এবং চড়ুই। বিশেষ করে ইউরেশিয়ান গেছো চড়ুইকে মারার জন্য টার্গেট করে গণহারে শুরু হলো চড়ুই মারা।

কিন্তু প্রায় ৯৬ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের বিশাল আয়তনের এই দেশটি থেকে রাতারাতি চড়ুই পাখি বিলুপ্ত করে দেয়া তো খুব ছোট কোন বিষয় না। তাই চড়ুই পাখি নিধনের জন্য রীতিমতো গবেষণাও চালানো হয়েছিল। চড়ুই নিধনের জন্য শব্দকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিলো।

লোকে ড্রাম আর থালা হাতে রাস্তায় নেমে পড়ত, চড়ুই পাখি দেখলেই বাজানো শুরু করতো। প্রবল বাদ্যযন্ত্রের শব্দে ছোট পাখিগুলো ভীত হয়ে পালাতো, কিন্তু চারপাশের ক্রমাগত আওয়াজে একসময় দুর্বল হয়ে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মৃত্যু হতো ছোট্ট পাখিগুলোর।

যেভাবে সফল হয়েছিলো দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন

সেসময় চীনারা দেশপ্রেমের টানে দলে দলে চড়ুই নিধন করতে দ্য গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন -এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো। সাংহাইয়ের একটি পত্রিকার রিপোর্ট ছিলো ঠিক এইরকম, “১৩ই ডিসেম্বর সকালে, সবখানে বেজে উঠলো চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধের দামামা। বড় ছোট সড়কগুলোতে দেখা গেল লাল পতাকা। চারিদিকে উঠে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য কাকতাড়ুয়া, কুশপুত্তলিকা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী, সরকারী অফিসের কর্মী, কারখানার শ্রমিক, কৃষক, পিপলস লিবারেশন আর্মি সকলেই ছুটে চলেছে যুদ্ধের জয়গান গেয়ে।

জিনসেং জেলায়, রাতারাতি তৈরি করে ফেলা হয়েছে ৮০ হাজার কাকতাড়ুয়া ও লক্ষাধিক রঙিন পতাকা। জিয়েতু সড়ক, জুহুই জেলা, ইয়াংপু সড়ক, ইউলিন জেলা সবখানেই দেখা গেছে কাকতাড়ুয়া।

মূলত, কম বয়সী মানুষের ঘাড়ে পড়েছে চড়ুই পাখি ধরা, তাড়া করা, বিষ দিয়ে মারার মতো কাজগুলো। আর বৃদ্ধ ও শিশুদের দেয়া হয়েছে প্রহরীর দায়িত্ব। শহরের কারখানাগুলোর শ্রমিকেরাও এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছে। এর আগে অবশ্যই তারা দিনের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে নেবে বলেও নিশ্চয়তা দিয়েছে।

যেখানে মানুষের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম, সেসব জায়গাতে সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য প্রায় দেড় শতাধিক ফ্রি ফায়ার জোন স্থাপন করা হয়েছিল। নানইয়াং গার্লস মিডল স্কুলের রাইফেল টিমকে পাখি শিকার করার উপর বিশেষ প্রশিক্ষণও দেয়া হয়েছে। গৃহিণীরা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন থালা, বাটি, হাড়ি, পাতিল নিয়ে। চামচ বা লাঠির আঘাতে সেগুলোকে ঢোল হিসেবে ব্যবহার করে নাগরিক দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছিলেন তারা।

চড়ুই পাখির বাসা নষ্ট করা, ডিম ভেঙে ফেলা, গুলি করা, বন্দী করে বিষ দিয়ে মেরে ফেলা ছিল সেদিনকার বীভৎস কর্মসূচীর মুখ্য অংশ। এভাবেই চড়ুই পাখির বিরুদ্ধে যুদ্ধ নেমেছিল সাংহাই শহরের বাসিন্দারা। হিসেব মতে, রাত আটটা পর্যন্ত প্রায় ১,৯৪,৪৩২টি চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়েছে।”

চড়ুই নিধন সংক্রান্ত এক করুণ ঘটনার সাক্ষী ছিল বেজিংয়ে অবস্থিত পোলিশ দূতাবাস। শোনা যায় আশেপাশে লোকের আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রচুর চড়ুই পাখি দূতাবাসের ভেতরে আশ্রয় নেয়। কিন্তু পোলিশ কর্তৃপক্ষ চিন সরকারের অনুরোধ সত্ত্বেও দূতাবাসের ভেতর চড়ুই নিধনকারীদের ঢোকা নিষিদ্ধ করে মানবতার খাতিরে।

এতে ক্ষেপে গিয়ে এম্বেসি ঘিরে হাজার হাজার লোক রাতদিন ড্রাম বাজাতে থাকে। ড্রামের বিকট শব্দে হার্টফেল করে মারা যায় অনেক চড়ুই। এভাবে টানা দুইদিন বাজানোর পর লোকজন সরে গেলে দেখা যায় দূতাবাসের উঠানে এত পরিমাণ মরা চড়ুই পড়ে আছে যে তাদের লাশ সরানোর জন্য পোলিশদের বেলচা পর্যন্ত ব্যবহার করতে হয়েছিল।

ক্যাম্পেইন পরবর্তী অবস্থা

চিনাদের এমন নির্বোধ কর্মকাণ্ডের খেসারত দিতেও বেশি সময় লাগলো না। ধেয়ে এলো প্রকৃতির নির্মম আঘাত। প্রথমত, শস্য দানার পাশাপাশি চড়ুই পাখি নানা ধরনের পোকামাকড়ও খায়। চড়ুই পাখি বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ায় জ্যামিতিক হারে বেড়ে গেল সেসব পোকামাকড়ের সংখ্যা।

পঙ্গপাল সহ ফসলের ক্ষেত ছেয়ে যেতে লাগলো ক্ষতিকর পোকামাকড়ে। ফলস্বরূপ যে শস্য বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল, সেই শস্য গেল পোকামাকড়ের পেটে। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই শস্যভাণ্ডার খালি হয়ে গেল। খাদ্য সংকটের মুখে পড়লো কোটি কোটি মানুষ।

‘দি গ্রেট চাইনিজ ফ্যামিন’ নামে পরিচিত এই দুর্ভিক্ষে সরকারের হিসেবে প্রাণ হারান প্রায় দেড় কোটি মানুষ। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক হিসাবে অনুমান করা হয় এ সংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটি ৩০ লক্ষের মধ্যে। শেষমেশ চিন সরকার সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে কয়েক লাখ চড়ুই আমদানি করতে বাধ্য হয়।

এই চড়ুই সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়ে চীন আস্তে আস্তে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় সামাল দিতে সক্ষম হয়। সেই সঙ্গে বিদেশ থেকে সর্বোচ্চ চড়ুইপাখি আমদানি করার মত অদ্ভুত আরেক রেকর্ডেরও জন্ম দেয় মাও সে তুংয়ের চীন!