বোশেখ মাসের নানা ডং তামাশার সব ফর্দেই সবাই মোহাবিস্ট হয়। আবেগ উদ্বেলের কোন কমতি থাকে না। আমাদের কল্পনায় রংগীন পোশাকে মোড়া কৈশোর উত্তীর্ণ মনকে বশে আনা যেমন সহজ হয় না। তেমনি প্রিয়জনকে
কেহ সাদামাটা দেখতে চায় না। গ্রামীন আদল জানা চিত্রকরের আঁকায় লাল হলুদের ছাপ ছাপ শাডীতে প্রেমিকাকে দেখে ভাললাগাটাই বৈশাখী অনুভব।
সে অনুভবের তালিকা ক্রমশ বাড়তেই থাকে বাদ্য বাজনা হাসি,আপনাকে খুঁজে নেবার গান, সবই তালিকার অন্তর্ভূক্ত।
লেখক: ইশতিয়াক রুপু
লেখক: ইশতিয়াক রুপু
তারপরও একটি জায়গায় মনটি অশান্ত, ভীরু চিত্তে ভয়ার্থ। তিন তিনটি মাসের উদায়স্ত কস্টের বোনা স্বপ্ন যে হাওরে দোল খেলে যায়। আর কয়টি দিন পর সে আসবে সুখের বেশে গৃহিনীর চুলে সুভাশিত মাথার সুগন্ধি তেল হয়ে। এ যেন স্বপ্ন মেলায় নাগরদোলা চড়ার বালকের আনন্দের ফিরিস্তি ।
চৈত্র মাসের এ সময়ে বেলা আধবেলা বৃস্টি সবাই মেনে নেয়। অবিরাম প্রার্থনা চলে শক্তিমান আল্লাহর কাছে মায়া ও নেক নজর পাবার আশায়।নদীর কাছাকাছি হেঁটে বেডায় কৃষক। চোখের আন্দাজে নদী মেপে নেয়। নিজে নিজে বলে কোন ব্যতিক্রম ত দেখি না। মনে হয় সব ঠিকই আছে । ডলের পানিতে স্বপ্ন বিকাবে না। এবার সব ঋণ শোধ হবে। চালে নূতন টিন উঠবে। সব আশা পূর্ণ হবে ইনশাল্লাহ।
গৃহিনীর শুন্য হাত জোডার বন্ধকী সোনার বালা জোঁডা ফেরত আসবে। আদর সোহাগে স্বাক্ষী হবে। কয়টি বছর পর সে জোঁডা খানা জ্বলজ্বল করবে পুত্র বধুর ফর্সা হাত জোডায়।অবেলায় নচ্ছার বৃস্টির খামাকা জ্বালাতন। রাজ্যের কাম কাজ গুছাতে হবে। কামলা কামীনদের পছন্দের খাবার তেতুল গুলায় চাকা গুড সাথে ভাজা তিসির গুঁডো।
মাচাং থেকে নামতে হবে বাডতি মাঠির হানখ।সংগে বিরাট ২/৩ টি গামলা। সব বোশেখের ফসল তোলার আগাম কাজ । তা কে করবে এ কাজগুলি ? শুনি একটু। কেউ না শুনলে বারান্দার খাছায় ময়না পাখি ঠিকই শুনে।
তাই বুঝি বার বার ডাকে, বউ বউ ও বউ।
পাকের ঘরের কোনায় সফুর মা গোবর গুটো ঠেলে ঠুলে বৃস্টি ভেজা শেষ বেলার দুপুরে কয়টি লাল চালের মোটা ভাত ফুঠায়ে নিল। তারই সাথে লম্বা আলু পোড়া খান কতক। সজনে আর ধনে পাতার ঝাল ঝাল চাটনি।
খাবার দাবার শেষ করতেই বেলা ডুবো ডুবো। এঁটো থালা বাসন নিয়ে নদীর ঘাটে এসে বার বার মনে হল নদী কি বেডে গেল? ঢল এল ? দূর ছাই কি অলুক্ষণে চিন্তা মাথায় আসল।হাঁটা পথে নেমে দেখল না গো পানি বাডেনি।তবে যে ঘাটলার দুই ধাপ ডুবে গেল ।
মাগরিবের কালে অন্ধকার করে বৃস্টি ।গৃহিনী বললেন সফুর মা ভিজে বাড়ি যাসনে।অসুখ হলে কিন্তু রক্ষা নাই। বোশেখের ঝাপটা সামলাবে কে?
এক নামাজী কামলা বলল, মসজিদের বারান্দায় গ্রামের সব মুরুব্বী দানাগন বসে শলাপরামর্শ করছেন । ২/৩ জনকে পাঠানো হল ওয়াপাদার বাঁধে।
বৃস্টি থামছেই না। ছাতা মাথায় গ্রামের মেম্বার এসে ছাতা ঝাডতে ঝাডতে বললে নদীর গতিসুবিধে নয়। কথা টি শুনে সবাই কেমন জানি মনে হল ক্ষানিক থমকে গেলেন । মেম্বার সাহেবের আরও কিছু কথা বৃস্টির আওয়াজে স্পস্ট না হলেও যখন জিজ্ঞেস করলেন, ইমাম সাব মাইক ঠিক আছে ত? তার সে জিজ্ঞাসায় কেউ কেউ উঠে দাঁড়ালেন ।
তখনই সন্ধায় বাঁধে পাঠানো দুজন হুড়মুড় করে আধ ভেজা হয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে মসজিদে ঢুকে বললেন, বিপদ বিপদ মহা বিপদ। ওয়াপাদার বাঁধে বিরাট ফাটল। সবাই চলেন। দেরী হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
হাওর ডুবে যাবে।
দেরী না করে মেম্বার সাহেব মাইক হাতে নিয়ে জোরে জোরে দুইটি ফু দিয়ে বলতে লাগলেন, ভাইসব কোদাল টুকরী যার যা আছে তাই নিয়ে তাড়াতাড়ি ওয়াপদা বাঁধে চলে আস। দেরী করবা না। তা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।
ভাইসব, ভাইসব!! অসময়ে এই সর্বনাশা ডাক শুনে সফুর মা চাটাই হতে উঠতে গিয়ে বামহাতের উপরে সুচালো কিছুর ঘা খেয়ে দেখল তার অনেক পুরানো শাডীটি লেবু গাছের যে কাঁটা দিয়ে জোঁডা ছিল সেই কাঁটার খোঁছা।
গৃহিনী খাটের কোনায় হেলান দিয়ে এক দৃষ্টিতে দেখছেন তার হাতের সখের বালা জোঁডা স্বর্নকারের মালসার আগুনে গলে গলে সোনার চাকতি হয়ে যাচ্ছে। আর তার পূত্র বধুর ফর্সা হাত জোঁডা শূন্যই রয়ে গেল। শুধু মৃদু আওয়াজ করে বললেন সফুর মা খাটের উপর বিছানায় চ্যাপটা মুখো হাড়িটি দাও না হলে বৃষ্টির ফোটায় বিছানা ভিজে যাবে।
বাইরে শংকিত ভয়ার্ত গ্রামবাসীরা সমস্বরে আওয়াজ তুলছে, আল্লাহ আমাদের ফসল রক্ষা কর। আমাদের বাঁচাও মওলা। আমাদের মায়া কর হে দয়াবান ।