ঢাকা ০২:৪২ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
ইটনায় সরকারি বিদ্যমান সেবা বিষয়ে অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত মদনে সংবাদ প্রকাশের পর স্কুল কর্তৃপক্ষের ঘুম ভাঙ্গল বিদ্যালয় প্রাঙ্গন দখল করে ঘর নির্মাণ করছেন শিক্ষক রাজধানীতে পার্বত্য জেলার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বিপনী বিতান উদ্বোধন করেন: পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী সীমান্ত সড়ক পশ্চাদপদ পার্বত্য অঞ্চলকে উন্নয়নের স্রোতধারায় একীভূত করেছে মদন উপজেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদের সভাপতি সায়েম সাধারণ সম্পাদক আরিফ মদনে ফের বয়রাহালা ব্রীজের এপ্রোচ দখল করে ঘর নির্মাণ মদনে জমি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কৃষককে হত্যার চেষ্টা মদনের এ.ইউ.খান উচ্চ বিদ্যালয়কে কারণ দর্শানোর নোটিশ মদনে এক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী উপস্থিতি শূন্য

মন্ত্রীরা যখন কাঠগড়ায়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১২:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০১৬
  • ৩২১ বার

আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিন মন্ত্রী। সরকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে। এর মধ্যে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দুর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে হাইকোর্টে পুনঃশুনানিতে যেতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রায় বহাল থাকলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তাকে যেতে হবে কারাগারে। আর আদালত অবমাননার মামলায় দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা দিয়েছেন। কিন্তু আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বাধা না থাকায় বহাল আছেন মন্ত্রিত্বে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পর্যন্ত থাকছে দোদুল্যমানতা। পূর্ণাঙ্গ রায়ে মন্ত্রীদের শপথভঙ্গের বিষয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য বা পর্যবেক্ষণ আসে কিনা, এ নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে প্রবল আগ্রহ। শপথভঙ্গের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণ আরেক দফায় কাঠগড়ায় নিয়ে যেতে পারে দুই মন্ত্রীকে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের এভাবে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের আলোচনারই জন্ম দিয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ একে বিচার বিভাগের স্বাধীন সত্তার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করার উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, সরকারে থাকলেও কেউ যে জবাবদিহির বাইরে নয় এরই প্রমাণ মন্ত্রীদের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আইনজীবীদের আরেক অংশ দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও মন্ত্রিত্ব বহাল থাকায় হতাশ। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আইন বা সংবিধানে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হলে মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে নেই। তবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে নৈতিকভাবে দুই মন্ত্রী পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন। তাদের নেওয়া শপথ রক্ষার খাতিরে দ্রুত তাদের পদত্যাগ করা উচিত।

জানা যায়, ৫ মার্চ রাজধানীতে এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক। প্রধান বিচারপতি তার আসনে থাকতে চাইলে ‘অতিকথন’ বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন এক মন্ত্রী। একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর মামলায় আপিল বিভাগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি যেসব মন্তব্য করেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে ওই মামলায় পুনরায় শুনানি করার আহ্বান জানান দুই মন্ত্রী। ওই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার দায়ে ২৬ মার্চ দোষী সাব্যস্ত হন এই দুই মন্ত্রী। এ জন্য তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে সাত দিনের কারাদণ্ড দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চলতি মাসেই জরিমানার ওই অর্থ পরিশোধ করেছেন দুই মন্ত্রী। অন্যদিকে ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রাপুর থানায় তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে ২৯ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ এনে মামলা করে। পরের বছর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত দুটি ধারায় মায়াকে মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। সেই সঙ্গে তাকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। আপিলের শুনানি শেষে তাকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে দুদক। শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর মন্ত্রী মায়া আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেন। কিন্তু গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রিভিউ আবেদনটি উত্থাপন হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। ফলে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির আদেশ বহাল থাকে। একই সঙ্গে বহাল থাকে মন্ত্রী মায়ার ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা। সংবিধানপ্রণেতা ও প্রবীণ আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের এসব রায়কে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। এর মাধ্যম বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে মন্তব্য করে ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মামলা দুর্নীতির। এর পুনঃশুনানি ও আপিলসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে আইন ও সাংবিধানিকভাবেই তার মন্ত্রিত্ব চলে যাবে। শুধু তা-ই নয়, প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে তাকে সরাসরি আদালত থেকে কারাগারেও যেতে হতে পারে। আর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তো কোনো কথা থাকবে না। আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর পদে থাকা সংবিধান ও আইন অনুসারে বৈধ। তবে সুস্থ বিচার-বুদ্ধির বিবেচনায় দোষী প্রমাণিত ব্যক্তিদের সুবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। যেহেতু নৈতিকতা আইন দ্বারা সিদ্ধ নয়, তাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে পদত্যাগ করলে মর্যাদা কমত না বরং বাড়ত। জানা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২-এর ঘ-তে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনও ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে। এবং ৬৬ (২)(ঙ) অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনও অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া থাকেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আদালতের আদেশে তারা জরিমানা দিয়েছেন। সংবিধান ও আইন তাদের পদ ছাড়া বা শপথভঙ্গের কোনো কথা বলেনি। এ কারণেই তারা মন্ত্রী আছেন। এটি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। আর ত্রাণমন্ত্রীর বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ত্রাণমন্ত্রীর বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন। আদালতই তার দণ্ড নির্ধারণ করবেন। আর খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন।

তবে এখন পর্যন্ত সংবিধানে এরূপ পরিস্থিতিতে তাদের মন্ত্রী পদে বহাল থাকাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। অবশ্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুই মন্ত্রী শপথভঙ্গ করেছেন মর্মে উল্লেখ করা হলে, আইনের সূক্ষ্ম বিচারে সরকারপ্রধান কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সামগ্রিকভাবে তিন মন্ত্রীর বিষয়ে আপিল বিভাগের দুই রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শেষেরটা দুর্নীতির। এর চেয়ে আগে দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার বিষয়ে দেওয়া রায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে কোনো ধরনের মন্তব্য করে এসেছেন। তখন উচ্চ আদালত তাদের কিছু বলেননি। উচ্চ আদালত যদি শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের কিছু না বলেন, তখন অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ কমে আসে। এবারের এ রায় সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটাল। তিনি বলেন, আইনগত দিক থেকে বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে আদালত অবমাননার কারণে শাস্তি হলে কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় না। তবে উচ্চ আদালত যেহেতু দুই মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ করার কথা বলেছেন, তাই কেউ যদি এখন উচ্চ আদালতে তাদের মন্ত্রিত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে যে কোনো সিদ্ধান্তই আসতে পারে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে যে-কেউ এখন চ্যালেঞ্জ করে আদালতের কাছে জানতে চাইতেই পারেন। তখন এই দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব আইনগতভাবে জটিলতার মুখে পড়তে পারে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ইটনায় সরকারি বিদ্যমান সেবা বিষয়ে অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত

মন্ত্রীরা যখন কাঠগড়ায়

আপডেট টাইম : ১২:১২:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল ২০১৬

আইনি প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন তিন মন্ত্রী। সরকারের দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে। এর মধ্যে মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়াকে দুর্নীতির মামলায় ১৩ বছরের কারাদণ্ড মাথায় নিয়ে হাইকোর্টে পুনঃশুনানিতে যেতে হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত রায় বহাল থাকলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে তাকে যেতে হবে কারাগারে। আর আদালত অবমাননার মামলায় দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক ইতিমধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তিস্বরূপ জরিমানা দিয়েছেন। কিন্তু আইনি ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় বাধা না থাকায় বহাল আছেন মন্ত্রিত্বে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পর্যন্ত থাকছে দোদুল্যমানতা। পূর্ণাঙ্গ রায়ে মন্ত্রীদের শপথভঙ্গের বিষয়ে কোনো ধরনের বক্তব্য বা পর্যবেক্ষণ আসে কিনা, এ নিয়ে আইনজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে প্রবল আগ্রহ। শপথভঙ্গের বিষয়ে রায়ের পর্যবেক্ষণ আরেক দফায় কাঠগড়ায় নিয়ে যেতে পারে দুই মন্ত্রীকে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রীদের এভাবে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় ধরনের আলোচনারই জন্ম দিয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী ও বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ একে বিচার বিভাগের স্বাধীন সত্তার ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ না করার উদাহরণ হিসেবে দেখছেন। তাদের মতে, সরকারে থাকলেও কেউ যে জবাবদিহির বাইরে নয় এরই প্রমাণ মন্ত্রীদের কাঠগড়ায় দাঁড়ানো। আইনজীবীদের আরেক অংশ দোষী প্রমাণিত হওয়ার পরও মন্ত্রিত্ব বহাল থাকায় হতাশ। তাদের মতে, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের আইন বা সংবিধানে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী হলে মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার কোনো নির্দেশনা সুস্পষ্টভাবে নেই। তবে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে নৈতিকভাবে দুই মন্ত্রী পদে থাকার অধিকার হারিয়েছেন। তাদের নেওয়া শপথ রক্ষার খাতিরে দ্রুত তাদের পদত্যাগ করা উচিত।

জানা যায়, ৫ মার্চ রাজধানীতে এক সেমিনারে প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন দুই মন্ত্রী কামরুল ইসলাম এবং আ ক ম মোজাম্মেল হক। প্রধান বিচারপতি তার আসনে থাকতে চাইলে ‘অতিকথন’ বন্ধ করা উচিত বলে মন্তব্য করেন এক মন্ত্রী। একই সঙ্গে মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া মীর কাসেম আলীর মামলায় আপিল বিভাগের শুনানিতে প্রধান বিচারপতি যেসব মন্তব্য করেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে ওই মামলায় পুনরায় শুনানি করার আহ্বান জানান দুই মন্ত্রী। ওই মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার দায়ে ২৬ মার্চ দোষী সাব্যস্ত হন এই দুই মন্ত্রী। এ জন্য তাদের ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে সাত দিনের কারাদণ্ড দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চলতি মাসেই জরিমানার ওই অর্থ পরিশোধ করেছেন দুই মন্ত্রী। অন্যদিকে ২০০৭ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রাপুর থানায় তত্কালীন আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে ২৯ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগ এনে মামলা করে। পরের বছর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত দুটি ধারায় মায়াকে মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। সেই সঙ্গে তাকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়। আপিলের শুনানি শেষে তাকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এর বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল করে দুদক। শুনানি শেষে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এরপর মন্ত্রী মায়া আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেন। কিন্তু গতকাল প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ রিভিউ আবেদনটি উত্থাপন হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন। ফলে হাইকোর্টের খালাসের রায় বাতিল করে পুনঃশুনানির আদেশ বহাল থাকে। একই সঙ্গে বহাল থাকে মন্ত্রী মায়ার ১৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ কোটি টাকা জরিমানা। সংবিধানপ্রণেতা ও প্রবীণ আইনজ্ঞ ড. কামাল হোসেন দায়িত্বে থাকা মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের এসব রায়কে বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত বলে মনে করেন। এর মাধ্যম বিচার বিভাগের প্রতি মানুষের আস্থা আরও বৃদ্ধি পাবে মন্তব্য করে ড. কামাল হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়ার মামলা দুর্নীতির। এর পুনঃশুনানি ও আপিলসহ অন্যান্য প্রক্রিয়া শেষে তিনি যদি দোষী সাব্যস্ত হন, তাহলে আইন ও সাংবিধানিকভাবেই তার মন্ত্রিত্ব চলে যাবে। শুধু তা-ই নয়, প্রক্রিয়ার শেষ পর্যায়ে তাকে সরাসরি আদালত থেকে কারাগারেও যেতে হতে পারে। আর নির্দোষ প্রমাণিত হলে তো কোনো কথা থাকবে না। আদালত অবমাননায় দোষী সাব্যস্ত খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর পদে থাকা সংবিধান ও আইন অনুসারে বৈধ। তবে সুস্থ বিচার-বুদ্ধির বিবেচনায় দোষী প্রমাণিত ব্যক্তিদের সুবুদ্ধি কাজে লাগিয়ে সরে দাঁড়ানো উচিত ছিল। যেহেতু নৈতিকতা আইন দ্বারা সিদ্ধ নয়, তাই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে পদত্যাগ করলে মর্যাদা কমত না বরং বাড়ত। জানা যায়, বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের ২-এর ঘ-তে বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনও ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে। এবং ৬৬ (২)(ঙ) অনুযায়ী, কোনও ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ-সদস্য থাকিবার যোগ্য হইবেন না, যদি তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীন যে কোনও অপরাধের জন্য দণ্ডিত হইয়া থাকেন। সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। আদালতের আদেশে তারা জরিমানা দিয়েছেন। সংবিধান ও আইন তাদের পদ ছাড়া বা শপথভঙ্গের কোনো কথা বলেনি। এ কারণেই তারা মন্ত্রী আছেন। এটি নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। আর ত্রাণমন্ত্রীর বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করার সময় আসেনি। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, ত্রাণমন্ত্রীর বিষয়টি এখনো আদালতে বিচারাধীন। আদালতই তার দণ্ড নির্ধারণ করবেন। আর খাদ্যমন্ত্রী ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী সর্বোচ্চ আদালতে দণ্ডিত হয়েছেন।

তবে এখন পর্যন্ত সংবিধানে এরূপ পরিস্থিতিতে তাদের মন্ত্রী পদে বহাল থাকাকে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়নি। অবশ্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে দুই মন্ত্রী শপথভঙ্গ করেছেন মর্মে উল্লেখ করা হলে, আইনের সূক্ষ্ম বিচারে সরকারপ্রধান কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়টি সামনে আসবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, সামগ্রিকভাবে তিন মন্ত্রীর বিষয়ে আপিল বিভাগের দুই রায় উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। শেষেরটা দুর্নীতির। এর চেয়ে আগে দুই মন্ত্রীর আদালত অবমাননার বিষয়ে দেওয়া রায় বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মন্ত্রীরা বিভিন্ন সময় বিচার বিভাগ সম্পর্কে যে কোনো ধরনের মন্তব্য করে এসেছেন। তখন উচ্চ আদালত তাদের কিছু বলেননি। উচ্চ আদালত যদি শপথ নেওয়া মন্ত্রীদের কিছু না বলেন, তখন অন্য কাউকে শাস্তি দেওয়ার সুযোগ কমে আসে। এবারের এ রায় সেই পরিস্থিতির অবসান ঘটাল। তিনি বলেন, আইনগত দিক থেকে বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে আদালত অবমাননার কারণে শাস্তি হলে কোনো মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলে যায় না। তবে উচ্চ আদালত যেহেতু দুই মন্ত্রীর শপথ ভঙ্গ করার কথা বলেছেন, তাই কেউ যদি এখন উচ্চ আদালতে তাদের মন্ত্রিত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করেন, তাহলে যে কোনো সিদ্ধান্তই আসতে পারে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীনে যে-কেউ এখন চ্যালেঞ্জ করে আদালতের কাছে জানতে চাইতেই পারেন। তখন এই দুই মন্ত্রীর মন্ত্রিত্ব আইনগতভাবে জটিলতার মুখে পড়তে পারে।