হাওর বার্তা ডেস্কঃ যেন হলুদ স্বপ্ন নিয়ে মিষ্টি রোদে মুখ তুলে তাকিয়ে আছে। কখনো মনে হবে, হাজারো হলুদের প্রাণবন্ত মিছিল। দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল হলুদ গালিচা। আবার কাছে এসে ফুলের গভীরে দৃষ্টিতে ভাসবে গায়ে হলুদের কনে। সারাগায়ে সবুজ রঙের শাড়ি, আর মাঝে হলুদ মুখখানি উঁকি দিচ্ছে। চারদিকে পাপড়ি মেলে সূর্যের দিকে মুখ, তাইতো সূর্যমুখী।
দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ফুলগুলো বাতাসে দোল খেয়ে আমন্ত্রণ জানায় সৌন্দর্য উপভোগ করার। আর তখন হলুদ সূর্যমুখীর মিছিলে যোগ দেয় শত শত প্রকৃতিপ্রেমী। কেউ ছবি তুলছেন, কেউবা আবার পরিবার পরিজন নিয়ে বাগানে এসে সৌন্দর্য উপভোগ করছেন। ফুলের মনোমুগ্ধকর এমন দৃশ্য বর্তমানে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় চোখে পড়ার মতো।
কিশোরগঞ্জের হাওর বেষ্টিত মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রাম। কেবল সৌন্দর্যের জন্য নয়, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সেখানে ১০০ বিঘা জমিতে চাষ হয়েছে এই ফুল। যেখানে বর্ষায় হাওরের অথৈ জলরাশি, আর শুকনো মৌসুমে হাওরের বুকে সবুজ ধানের সমরোহ, সেখানে প্রতিকূল পরিবেশে সূর্যমুখী ফলিয়ে তাক লাগিয়েছেন স্থানীয় কৃষকরা। মাঠে বপন করা হয়েছে কয়েক হাজার সূর্যমুখী ফুলের বীজ। বর্তমানে বীজ থেকে প্রতিটি গাছে ফুল ফুটেছে। রূপ আর তেল দুই ঢেলে দিচ্ছে সূর্যমুখী।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, সূর্যমুখী ফুল চাষে প্রণোদনা আর পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এখানকার কৃষকদের। সরকার কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ দেওয়ায় সূর্যমুখী চাষের আগ্রহ বেড়েছে তাদের। সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে তেল ও খৈল হয়। ফুলের ক্ষেতে মৌচাক বসিয়ে বাণিজ্যিকভাবে মধুও সংগ্রহ করা যায়। এছাড়া শুকিয়ে যাওয়া গাছ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এই বীজ বপনের ৯০-১০৫ দিনের মধ্যেই কৃষকরা ফুল থেকে বীজ ঘরে তুলতে পারেন। এক বিঘা জমি থেকে প্রায় সাত মণ বীজ পাওয়া যায়। আর বিক্রি হয় ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। সূর্যমুখীর তেলের বাজার বড় হওয়ার পাশাপাশি এর চাহিদাও বাড়ছে।
মিঠামইন উপজেলার ঘাগড়া ইউনিয়নের হোসেনপুর গ্রামের সূর্যমুখী ফুলচাষী জানান, কৃষি অফিস থেকে বিনামূল্যে বীজ ও সার সংগ্রহ করে চাষ শুরু করেন তারা। ৯০ থেকে ১১০ সেন্টিমিটার পরিণত গাছগুলোতে এরই মধ্যে ফুলে ফুলে বীজ আসতে শুরু করেছে। আর কিছুদিন পরই সেগুলো সংগ্রহ করা হবে। সূর্যমুখী বীজ একটি লাভজনক শস্য। কম পরিশ্রমে ও কম খরচে চাষ করে অন্য ফসলের চেয়ে অধিক লাভবান হওয়া যায়। তাই এমন সময়ে সূর্যমুখীর চাষ করাটাই ভালো।
প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে আধা লিটার তেল উৎপাদন করা যায়। শতক প্রতি জমিতে আট কেজি বীজ উৎপাদন করা সম্ভব। এতে তেল উৎপাদন হবে সাড়ে তিন থেকে চার লিটার। প্রতি লিটার তেলের সর্বনিম্ন বাজার মূল্য ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা। প্রতি শতক জমিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ২০০ টাকা।
হাওরের বুকে হলুদের মিছিলে প্রতিদিনই যোগ দিচ্ছেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। হরেক রকমের ছবি তুলছেন, আর সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরছেন। তাদের একজন এমদাদুল হক।
তিনি বলেন, বর্ষায় হাওরের সৌন্দর্য দেখতে প্রতিবারই আসি। কিন্তু এবারের সৌন্দর্যটা উঁকি দিয়ে ডাকছিল। তাই পরিবার-পরিজন নিয়ে ছুটে এসেছি। এখন শুকনো হাওর, আর তারই মাঝে হাজারো সূর্যমুখীর সারিবদ্ধ প্রাণবন্ত হাসি। খুব ভালো একটা সময় কেটেছে।
তবে একটি ব্যাপারে আক্ষেপ করে তিনি জানান, কৃষকের তৈরি ফসল-তার ভবিষ্যত। আর সেদিকে খেয়াল রেখে কোনোভাবেই ফসল নষ্ট করা যাবে না। যারা আসবেন, ছবি তুলবেন, তারা কোনোভাবেই ফসল নষ্ট করবেন না।
মিঠামইন উপজেলা কৃষি অফিসার বলেন, অন্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী ফুল চাষে খরচ কম। এতে সার ও ওষুধ কম লাগে। খুব বেশি পরিচর্যাও করতে হয় না। তাছাড়া অন্যান্য তেলবীজের তুলনায় বেশি তেল পাওয়া যায়। প্রতি তিন বিঘা জমিতে সূর্যমুখী ফুলচাষে খরচ হয় ১২ হাজার টাকা। কৃষকদের প্রণোদনা হিসেবে সূর্যমুখী ফুলের বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। এখন অনেক কৃষক এই ফুলের চাষ পদ্ধতি সম্পর্কেও জানতে আসছেন।
সূর্যমুখী ফুলের বীজ থেকে তৈরি তেল বাজারের অন্য তেলের চেয়ে ভালো মানের। কোলেস্টেরল মুক্ত হওয়ায় এর পুষ্টিগুণও বেশি। এ ফুল থেকে উৎপাদিত তেলের দাম বেশি হওয়ায় কৃষকরা লাভের মুখ দেখছেন। ফলে অন্য রবি শস্যের তুলনায় সময় ও ব্যয়সাশ্রয়ী এ ফুল আবাদে জেলার কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে চলতি বছর জেলায় সূর্যমুখী ফুলের বীজের ভালো ফলন হবে বলে আশা করছেন কৃষি সংশ্লিষ্টরা।