১০ই জানুয়ারী বাঙালির জাতীয় জীবনে অবস্মরণীয় দিন

গোলসান আরা বেগমঃ বিজয়ের বেশে জাতির পিতা,হাজার বছরের শ্রেষ্ট বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১০ জানুয়ারী ১৯৭২ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এসেছিলেন। বাঙালি এ দিবসটিকে বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস হিসেবে প্রতিবৎসর বিভিন্ন কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে বেশ গুরুত্বের সাথে উদযাপন করে। সেই ১০ জানুয়ারী লক্ষ লক্ষ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য ঢাকার রাজপথে ও সহোরাওয়ার্দি উদ্দ্যানের জনসভায় অপেক্ষা করছিল।

১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলেও কান্ডারি বিহিন অবস্থায় ২৬ দিন বাঙালিরা প্রহর গুনছিলো, কবে বঙ্গবন্ধু, মক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বাংলার মাটিতে ফিরে আসবেন।মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নদ্রষ্ট্রা, মাটি ও মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু ফিরে না এলে, মুক্তিযুদ্ধে ভঙ্গুর ধ্বংসস্তুুপের উপর দাঁড়ানো দেশটির উপায় কি হতো, তা নিয়ে অনেকেই ছিলো শংকিত।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে বঙ্গবন্ধু ছিলেন পাকিস্তানের কারাগাড়ে অন্ধকার প্রকোষ্টে আবদ্ধ।তিনি বাংলাদেশে কি হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে, কিছুই জানতেন না। কারাগারের ভেতরে কবর খুড়া হয়েছিলো, তাঁকে ফাঁসিতে ঝুলানোর চক্রান্তও করা হয়েছিলো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানীদের কাছে মাথা নত করেননি।বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন — মুসলমান একবারই মরে।আমি জীবন দিতে প্রস্তুত। তোমরা আমার লাশটা আমার জনগনের কাছে পাঠিয়ে দিও। তোমরা বাঙালিকে দাবায়ে রাখতে পারবে না। সারা জীবন বাঙালির মুক্তির লক্ষে শেখ মুজিব জীবন দিতে এভাবেই প্রস্তুত ছিলেন।

৮জানুয়ারী মুক্তি পেয়ে একই বিমানে বর্বিয়ান নেতা ড. কামাল হোসেনের সাথে ফিরছিলেন দেশে। যাত্রাপথে যা অবহিত হয়েছিলেন, তা তুলে ধরেন লন্ডনে সাংবাদিক সন্মেলনে। লন্ডনের হিথ্রোবিমান বন্দরে যখন মাটি স্পর্শ করছিলো বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী বিমানটি, তখন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ছুটে এসেছিলেন বাংলাদেশের প্রথম রাস্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের গাড়ীর দরজা খুলে অভ্যর্থনা জানাতে। বিশ্ববাসি সে বন্ধুত্বপূর্ণ বিরল মহূর্ত দেখে অভিভুত ও অবাক হয়েছিলো।

ছোট বেলা থেকেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন অতিশয় মহামানব। কারো মহানুভবতার প্রতি কৃতঞ্জতা স্বীকার করতে কৃপনতা করেননি।তিনি ছুটে যান ভারতে,সে দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি ও ভারতকে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে যে সহায়তা করেছেন, তার প্রতি গভীর কৃতঞ্জতা জ্ঞাপন করেন। তা ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করার জন্য রাশিয়া,ফ্রান্স, বৃটেন,পোলেন্ড কে ধন্যবাদ জানান। বিশ্ব বাসির কাছে আবেদন রাখেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে। ভুটান ও ভারত ইতিমধ্যে বাংলাদেশ কে স্বীকৃতি প্রদান করেছিলো।

ভারত থেকে এসে বিমান বন্দর হয়ে সরাসরি চলে যান জনগণের জন্য নির্ধারিত জনসভায়। পরিবার পরিজনের কাছে গিয়ে বিশ্রাম নিয়ে, দুই/ এক দিন পরে জনসভা করতে পারতেন,কিন্তু তিনি তা করেননি। জনগণের প্রতি এতো ভালোবাসার নজির পৃথিবীর ইতিহাসে কারো এর আগে ছিলো কি না সন্দেহ।

তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে উদ্দেশ্য করে বলেন আবেগ আপ্লুত ভাষায় -হে কবি গুরু এসে দেখে যান, আমার সাত কোটি বাঙালি আজ মানুষ হয়েছে। তিনি আরো বলেছিলেন -আমাদের সাধারন মানুষ যদি আশ্রয় না পায়,খাবার না পায়, যুবকরা যদি চাকুরি বা কাজ না পায়, তা হলে আমাদের এ স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে। অতঃপর দেশ গড়ার কাজে মনযোগ দেন।প্রথমেই মুক্তিবাহিনী,মুজিব বাহিনী, উগ্রচিনপন্থী, স্বাধীনতা বিরুধী চক্রান্তকারী,সাধারন মানুষ যাদের হাতে অস্ত্র ছিলো,তাদের অস্ত্র উদ্ধার করেন। মিত্র বাহিনীর অন্তভুক্ত ভারতীয় সৈন্যদের তাদের দেশে ফেরৎ পাঠান। আত্মসর্ম্পনকারী পাকিস্তানী নব্বই হাজার সৈন্যকে পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন।

১৯৭২ সালে ১২জানুয়ারী শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহন করে বাংলাদেশ পুর্নগঠনে সর্বক্ষেত্রে মনযোগ প্রয়োগ করেন।মনে রাখা দরকার- যোদ্ধ পরিচালা ও স্বাধীনতা প্রাপ্তি অবশ্যই বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামীলীগের  নেতৃত্বে হয়েছে।অতএব দেশও পরিচালিত হবে বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শে – এটাই স্বাভাবিক।কিন্তু কেউ কেউ তা মেনে নিতে পারছিলো না। বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসার পূর্বেই নানা বিভ্রান্তি, বিশৃঙ্ক্ষলা চড়িয়ে দেয় বহু কুচক্রি মহল। কারন বঙ্গবন্ধু কোথায় আছে, কেমন আছে, আদৌ দেশে ফিরে আসতে পারবে কি না, কেউ জানতো না।সেনা বাহিনীর মধ্যে উপদলীয় কোন্দল,মুসলিম বাংলা স্লোগান দিয়েস্বাধীনতা বিরুধী চক্র বিভিন্ন ধরনের প্রচার প্রোপাগান্ডা ছড়াতে শুরু করে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-১০ জানুয়ারী ১৯৭২ পর্যন্ত দেশে চেন অফ কমান্ড ছিলো নড়েবড়ে।

সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ৮ই জানুয়ারী সন্ধ্যায় বেতারে খবর ভেসে আসলো বঙ্গবন্ধু বিশেষ বিমানে  অজানার পথে যাত্রা।ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারাবিশ্বব্যাপি বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য এমন কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়েছিলেন, যার ফলশ্রুতিতে পাকিস্তান সরকার বাধ্য হয়েছিলো বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে। বঙ্গবন্ধু ফিরে অাসেন তার প্রানপ্রিয় দেশ বাংলাদেশে।এভাবে লাল সবুজের পতাকা ও আমার সোনার বাংলা জাতীয় সঙ্গীত সম্বলিত বাংলাদেশ পায় বাঙালি অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে। এ কারনেই বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তন দিবস বাঙালির জীবনে অবিস্মরণীয় দিন।

 

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর