সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বাতিলে দায়ের করা রিট খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট।
ফলে ২৮ বছর আগে দায়ের হওয়া রিটটি খারিজ হওয়ায় সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলামই থাকছে।
রিট খারিজের আগে থেকেই এ নিয়ে দেশে আলোচনা চলে আসছিল। কিছুটা উত্তেজনাও ছিল। হেফাজতে ইসলাম ও জামায়াতে ইসলাম প্রকাশ্যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখার দাবিতে বিভিন্ন কর্মসূচী দিয়ে আসছিল।
রিট খারিজের পর পূর্বপশ্চিম প্রতিক্রিয়া জানতে কথা বলে দেশের তিন বিশিষ্ট্ নাগরিকের সঙ্গে। তারা এ ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। কেউ বলেছেন, দেশে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসেবে একটি ‘ধর্ম’ থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। আবার কারো মতে, রাষ্ট্রে নিজের ধর্ম সঠিকভাবে পালন করার স্বীকৃতি থাকতে হবে। আবার কেউ বলছেন, পৃথিবীতে কোথাও ধর্মহীন রাষ্ট্র নেই।
সোমবার বিচারপতি নাঈমা হায়দার নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহ্ত্তর বেঞ্চ রুল নিষ্পত্তি করে এই রায় দেয়। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল।
মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ, চেয়ারম্যান, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম
‘১৯৭১ সালে আমরা সবাই মিলে যুদ্ধ করেছি। তাই দেশটা সবার। ওই সময় কেউ ধর্ম নিয়ে যুদ্ধ করে নাই। দেশ স্বাধীন হওয়া্র পেছনে সবার অবদান আছে। রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে কোনো কথা বলতে চাই না। শুধু এটুকু বলব দেশ স্বাধীন ও গড়ার পিছনে সব ধর্মের অবদান আছে। একাত্তরে মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল। সেই তুলনায় অন্য ধর্মের মানুষ কম ছিলেন। কিন্তু তাদের অবদান আছে। যখন কোনো একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয় তখন অন্য সবাই নিজের ধর্ম ঠিকভাবে পালন করতে পারবে কি না এ প্রশ্ন থেকে যায়। তাই রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে বহাল রাখা ঠিক না বেঠিক হয়েছে এ প্রশ্নে না গিয়ে বলব- এতে অন্য ধর্মের মানুষ খুশি হবে কি না তা ভাবনার বিষয়। আসলে নিজের ধর্ম সঠিকভাবে পালন করার স্বীকৃতি থাকতে হবে।’
অধ্যাপক এমাজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য়
‘হাইকোর্টের এ রায় অভিনন্দনযোগ্য। কতিপয় পরিচয়হীন লোকের করা রিট খারিজ হওয়া ঠিক হয়েছে। যাদের দ্বারা এ রিট তারা কে, কোথায়, কখন, কী করেন তা মানুষ জানতে চান। তাই হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত সঠিক। সংবিধানের কোথাও লেখা থাক বা না থাক ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ লোকের ধর্মকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। ধর্মহীন রাষ্ট্র পৃথিবীর কোথাও নেই। প্রতিবেশি দেশগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যাবে ওগুলো ধর্মহীন রাষ্ট্র নয়। ৭২ সালে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ছিল না মানে এই নয় যে, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্মকে শ্রদ্ধা জানানো যাবে না।’
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো রাষ্ট্রধর্ম ছিল না, এর মানে পরে হবে না এমন নয়। একটা জিনিস লক্ষণীয় মুক্তিযুদ্ধের সময় কোনো স্লোগান ছিল না। আমরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম অধিকার রক্ষায়। তখন ইসলাম থাকবে না- এর পক্ষে কোনো বক্তব্য ছিল না।’
‘পৃথিবীর বড় কোনো রাষ্ট্রই ধর্মহীন নয়। হয়তো কোথাও সংবিধানে লেখা নেই। অধিকাংশ বড় দেশে ধর্ম আছে। ধর্ম মেনে ওই দেশ চলে। ব্রিটেন, সুইডেন ও এমনতর অনেক দেশে বাইবেলে হাত রেখে শপথ করা হয়।’
‘ধর্ম একটা মানবিক বিষয়। অতি প্রগতিশীল অনেকে এ ধরণের রিট করেছে। হাইকোর্ট যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। যাদের কোনো পরিচয় নেই তারা এটা রিট করে বসে থাকল আর রাষ্ট্রধর্ম পাল্টে গেল এমনটা হবে না, হওয়া উচিত না। হাইকোর্ট সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে।’
ড. গীতি আরা নাসরীন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হওয়া মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান থেকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মুক্তি নেওয়া বাংলাদেশে রাষ্ট্রধর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়নি। সুতরাং বাংলাদেশের আত্মপরিচয়, উন্নয়ন, কিম্বা মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসেবে একটি ‘ধর্ম’ থাকার কোন প্রয়োজন ছিল না। সামরিক শাসনামলে বাংলাদেশে সংবিধানে সংশোধনী এনে ইসলাম ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম করার সিদ্ধান্ত যখন নেওয়া হয়েছে, তখন তা ক্ষমতা রক্ষার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে করা হয়েছিল। পরবর্তীতে ‘গণতান্ত্রিক’ দলগুলি ক্ষমতায় আসার পর, এবং সংবিধানে আরও নানাবিধ সংশোধনী এলেও সংবিধানে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ এতদিন ধরেই বহাল আছে। সুতরাং রাষ্ট্রধর্মকে চ্যালেঞ্জ করে করা রীট ২৮ বছর পরে খারিজ হলে, তা নতুন কোনো বার্তা দেয় বা জনমানসে নতুন কোনো পরিবর্তন বয়ে নিয়ে আসে বলে আমার মনে হয় না। এই রায়ের মাধ্যমে শুধু স্থিতাবস্থাই (Status quo) রক্ষিত হয়েছে।’
প্রসঙ্গত, সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনকালে কার্যত বিরোধী দলবিহীন চতুর্থ জাতীয় সংসদে ১৯৮৮ সালের ৫ জুন সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী অনুমোদন হয়।
এর মাধ্যমে সংবিধানে অনুচ্ছেদ ২-এর পর ২ (ক) যুক্ত হয়, যাতে বলা হয়, ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম হবে ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্মও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে’।
ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ১৯৭১ সালে যাত্রা শুরু করা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে এই পরিবর্তনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তখনই ‘স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতা প্রতিরোধ কমিটির’ পক্ষে সাবেক প্রধান বিচারপতি কামালউদ্দিন হোসেন, কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীসহ ১৫ বিশিষ্ট নাগরিক হাই কোর্টে এই রিট আবেদন করেন।