ঢাকা ০১:৩৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম
ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার ফ্যাসিস্ট হাসিনার দোসর শামীম ওসমানের দাঁড়ি-গোফ যুক্ত ছবি ভাইরাল, যা বলছে ফ্যাক্টচেক ঢাকায় যানজট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপের নির্দেশ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা চার-ছক্কা হাঁকানো ভুলে যাননি সাব্বির হজযাত্রীর সর্বনিম্ন কোটা নির্ধারণে মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টতা নেই : ধর্ম উপদেষ্টা একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা না চেয়ে জামায়াত উল্টো জাস্টিফাই করছে: মেজর হাফিজ ‘আল্লাহকে ধন্যবাদ’ পিএইচডি করে ১৯ সন্তানের মা শমী কায়সারের ব্যাংক হিসাব তলব আগামী মাসের মধ্যে পাঠ্যপুস্তক সবাই হাতে পাবে : প্রেস সচিব নিক্কেই এশিয়াকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিন মেয়াদে ভুয়া নির্বাচন মঞ্চস্থ করেছেন হাসিনা

ঘাস চাষ ও একজন গফুরের দারিদ্রজয়

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:৫২:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০১৬
  • ৭২১ বার

একসময় অর্থাভাবে কাজের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। সে সময় অনাহার-অর্ধাহার ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

পরে বাধ্য হয়ে দিনমজুরি করেছেন গফুর, টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে চলেছে তার ছয় সদস্যের পরিবার। কিন্তু গফুর স্বপ্ন দেখতেন সোনালি দিনের, দারিদ্রজয় করা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

গফুরের সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর অক্লান্ত পরিশ্রমে তার অনেকদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

নেপিয়ার জাতের ঘাসের চাষ করে গফুর হয়ে উঠেছেন একজন দারিদ্রজয়ী সফল চাষি। হয়ে উঠেছেন অনেকের জন্য উদাহরণ। এমনকি কৃষিতে জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার।

ঘাষচাষি আব্দুল গফুর মিয়া গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের সুলতানপুর বাড়াইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

একসময় দুইবেলা ঠিকমতো খাবার না জোটা গফুর এখন ঘাস বিক্রি করে মাসে আয় করেন প্রায় দেড় লাখ টাকা। পাশাপাশি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করে বর্তমানে তিনি কোটি টাকার মালিক। কৃষিতে অনন্য ভূমিকার জন্য অর্জন করেছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।

সরেজমিনে গফুরের দারিদ্রজয়ের গল্প শুনতে যায় গফুরের বাড়িতে। পরিচয় পেয়ে গফুর ঘুরে দেখান তার ঘাস খেত ও গরুর খামার।

স্বপ্নজয়ী গফুর শোনান তার সংগ্রাম আর সাধনার গল্প। জানান, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। সহায়-সম্বল হিসেবে পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আড়াই বিঘা জমি। বিদেশ গিয়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সে লক্ষে বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে ২০০৩ সালে সবটুকু জমি বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা তুলে দেন এক দালালের হাতে।

পরে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি। উপায় না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার যোগাতে শুরু করেন অন্যের জমিতে দিনমজুরি। গাছ কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন শ্রম দিয়ে পেয়েছেন ১০০-১৫০ টাকা। সেই টাকা দিয়েই কোনমতে চলেছে তার ৬ সদস্যের সংসার।

ওই বছরের শেষদিকে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাভী কেনেন। পরে এলাকার এক খামারির পরামর্শে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় থেকে নেপিয়ার জাতের ঘাসের চারা সংগ্রহ করে ১০ শতক বসতভিটার অর্ধেক জমিতে ওই চারা রোপণ করেন।

সেই তার পথচলার শুরু। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঘাস চাষ ও গবাদি পশুর সংখ্যা। বর্তমানে তিনি ঘাস চাষ করছেন ১৬ বিঘা জমিতে।

ঘাষ চাষ পদ্ধতি ও খরচ সম্পর্কে গফুর মিয়া জানান, জমি তৈরির পর নেপিয়ার ঘাসের চারা রোপণ করতে হয়। একমাস পরপর টানা তিন বছর এ ঘাস কাটা যায়। একবিঘা জমিতে ঘাস রোপণে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। এরপর পানি সেচ ও সার বাবদ প্রতিবিঘা জমিতে প্রতিমাস খরচ হয় ২ হাজার টাকা।

ঘাস বাজারজাত ও মুনাফা সম্পর্কে তিনি জানান, জমি থেকে ঘাস কেটে ভ্যানে করে পলাশবাড়ী, ঢোলভাঙ্গা, ধাপেরহাট, মাঠেরহাট ও গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন তিনি। ৪ কেজি ওজনের প্রতি আটি ঘাস ১০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি হয় তার। ফলে খরচ বাদে মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয় তার।

গরুর খামার সম্পর্কে তিনি জানান, বর্তমানে তার খামারে ফ্রিজিয়ান জাতের ১৩টি গাভী রয়েছে। গাভীগুলো থেকে দৈনিক ৫০ কেজি দুধ পান। ৪০ টাকা কেজি দরে দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন তার আয় হয় ২ হাজার টাকা। এ টাকার অধিকাংশ ব্যয় হয় গরুর খাদ্যের পেছনে। তবে বছর বছর বাছুরগুলোই তার লাভ।

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়ে এ কৃষক বলেন, ঘাস চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করে কৃষিতে উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে রৌপ্যপদক ও সনদপত্র তুলে দেন।

গফুর মিয়ার বিষয়ে স্থানীয় কিশোরগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম রিন্টু জানান, গফুর মিয়া উপজেলায় এখন একজন অনুকরণীয় কৃষক। তার সাফল্যে উদ্বুব্ধ হয়ে সুলতানপুর বড়ইপাড়া এবং আশপাশের গ্রামের অর্ধশতাধিক কৃষক ঘাস চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম আকন্দ জানান, গফুর মিয়া একজন আদর্শ কৃষক। বাণিজ্যিকভাবে ঘাস চাষ করে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। তার এ কাজে প্রাণি সম্পদ বিভাগ থেকে সার্বিক পরামর্শ-সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

ফেক ছবি শনাক্তে হোয়াটসঅ্যাপের নতুন ফিচার

ঘাস চাষ ও একজন গফুরের দারিদ্রজয়

আপডেট টাইম : ০১:৫২:৩২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ মার্চ ২০১৬

একসময় অর্থাভাবে কাজের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন তিনি। সে সময় অনাহার-অর্ধাহার ছিল তার নিত্যসঙ্গী।

পরে বাধ্য হয়ে দিনমজুরি করেছেন গফুর, টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে চলেছে তার ছয় সদস্যের পরিবার। কিন্তু গফুর স্বপ্ন দেখতেন সোনালি দিনের, দারিদ্রজয় করা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

গফুরের সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি আর অক্লান্ত পরিশ্রমে তার অনেকদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছে।

নেপিয়ার জাতের ঘাসের চাষ করে গফুর হয়ে উঠেছেন একজন দারিদ্রজয়ী সফল চাষি। হয়ে উঠেছেন অনেকের জন্য উদাহরণ। এমনকি কৃষিতে জিতেছেন জাতীয় পুরস্কার।

ঘাষচাষি আব্দুল গফুর মিয়া গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার কিশোরগাড়ী ইউনিয়নের সুলতানপুর বাড়াইপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।

একসময় দুইবেলা ঠিকমতো খাবার না জোটা গফুর এখন ঘাস বিক্রি করে মাসে আয় করেন প্রায় দেড় লাখ টাকা। পাশাপাশি গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করে বর্তমানে তিনি কোটি টাকার মালিক। কৃষিতে অনন্য ভূমিকার জন্য অর্জন করেছেন বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার।

সরেজমিনে গফুরের দারিদ্রজয়ের গল্প শুনতে যায় গফুরের বাড়িতে। পরিচয় পেয়ে গফুর ঘুরে দেখান তার ঘাস খেত ও গরুর খামার।

স্বপ্নজয়ী গফুর শোনান তার সংগ্রাম আর সাধনার গল্প। জানান, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম তার। সহায়-সম্বল হিসেবে পেয়েছেন পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া আড়াই বিঘা জমি। বিদেশ গিয়ে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সে লক্ষে বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠাতে ২০০৩ সালে সবটুকু জমি বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা তুলে দেন এক দালালের হাতে।

পরে প্রতারিত হয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন তিনি। উপায় না পেয়ে স্ত্রী-সন্তানদের মুখে খাবার যোগাতে শুরু করেন অন্যের জমিতে দিনমজুরি। গাছ কাটা শ্রমিকদের সঙ্গে সারাদিন শ্রম দিয়ে পেয়েছেন ১০০-১৫০ টাকা। সেই টাকা দিয়েই কোনমতে চলেছে তার ৬ সদস্যের সংসার।

ওই বছরের শেষদিকে স্থানীয় একটি সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে একটি গাভী কেনেন। পরে এলাকার এক খামারির পরামর্শে উপজেলা প্রাণি সম্পদ কার্যালয় থেকে নেপিয়ার জাতের ঘাসের চারা সংগ্রহ করে ১০ শতক বসতভিটার অর্ধেক জমিতে ওই চারা রোপণ করেন।

সেই তার পথচলার শুরু। ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে ঘাস চাষ ও গবাদি পশুর সংখ্যা। বর্তমানে তিনি ঘাস চাষ করছেন ১৬ বিঘা জমিতে।

ঘাষ চাষ পদ্ধতি ও খরচ সম্পর্কে গফুর মিয়া জানান, জমি তৈরির পর নেপিয়ার ঘাসের চারা রোপণ করতে হয়। একমাস পরপর টানা তিন বছর এ ঘাস কাটা যায়। একবিঘা জমিতে ঘাস রোপণে খরচ হয় ১০ হাজার টাকা। এরপর পানি সেচ ও সার বাবদ প্রতিবিঘা জমিতে প্রতিমাস খরচ হয় ২ হাজার টাকা।

ঘাস বাজারজাত ও মুনাফা সম্পর্কে তিনি জানান, জমি থেকে ঘাস কেটে ভ্যানে করে পলাশবাড়ী, ঢোলভাঙ্গা, ধাপেরহাট, মাঠেরহাট ও গাইবান্ধা শহরের বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করেন তিনি। ৪ কেজি ওজনের প্রতি আটি ঘাস ১০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়। সে হিসেবে প্রতিদিন ৪ থেকে ৫ হাজার টাকার ঘাস বিক্রি হয় তার। ফলে খরচ বাদে মাসে ১ থেকে দেড় লাখ টাকা আয় হয় তার।

গরুর খামার সম্পর্কে তিনি জানান, বর্তমানে তার খামারে ফ্রিজিয়ান জাতের ১৩টি গাভী রয়েছে। গাভীগুলো থেকে দৈনিক ৫০ কেজি দুধ পান। ৪০ টাকা কেজি দরে দুধ বিক্রি করে প্রতিদিন তার আয় হয় ২ হাজার টাকা। এ টাকার অধিকাংশ ব্যয় হয় গরুর খাদ্যের পেছনে। তবে বছর বছর বাছুরগুলোই তার লাভ।

জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তির বিষয়ে এ কৃষক বলেন, ঘাস চাষের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগি পালন করে কৃষিতে উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপনের জন্য ২০১৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কারে ভূষিত হন। ওই বছরের ১৩ ডিসেম্বর ঢাকায় ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার হাতে রৌপ্যপদক ও সনদপত্র তুলে দেন।

গফুর মিয়ার বিষয়ে স্থানীয় কিশোরগাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম রিন্টু জানান, গফুর মিয়া উপজেলায় এখন একজন অনুকরণীয় কৃষক। তার সাফল্যে উদ্বুব্ধ হয়ে সুলতানপুর বড়ইপাড়া এবং আশপাশের গ্রামের অর্ধশতাধিক কৃষক ঘাস চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

উপজেলা প্রাণি সম্পদ কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম আকন্দ জানান, গফুর মিয়া একজন আদর্শ কৃষক। বাণিজ্যিকভাবে ঘাস চাষ করে তিনি আলোড়ন সৃষ্টি করছেন। তার এ কাজে প্রাণি সম্পদ বিভাগ থেকে সার্বিক পরামর্শ-সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।