ঢাকা ০৯:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

গেদুচাচা’ বিশ্বসাংবাদিকতায় এক ব্যতিক্রমী ও বিরল চরিত্র

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:৫৫:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১
  • ১৫৫ বার

রফিকুল ইসলামঃ আমি এখন বলব, /বলতে হবে এখনই /একজন সংশপ্তক কলমযোদ্ধার কথা।  /যে জানে নিশ্চিত পরাজয় সম্মুখে /তবুও সে পরাজিত নয় /যদিও এখন পর্যন্ত সে মৃত।’

আজ ২৯ জুন। গণমানুষের পথের দিশারি ‘গেদুচাচা’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সত্য ও সাহসিকতায় একনিষ্ঠ গেদুচাচা এক বিরল চরিত্র। ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র কালজয়ী কলাম লেখক হলেন আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক, যা অনেকেরই অজানা। গতবার ২০২০ সালের এ দিনে রাজধানী ঢাকার একটি প্রাইভেট হসপিটালে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে ৭০ বছর বয়সে মারা যান গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এই ক্ষণজন্মা।

নিভৃতচারী এই মিলিন্যান্ট প্রখ্যাত সম্পাদকের জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার গতিয়া পূর্ব সোনাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা এটিএম খোন্দকার ওবায়দুল হক এবং মাতা সৈয়দা আজিজুন নেছা খানম। তাঁর শিক্ষাবিদ পিতার পূর্বপুরুষ ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছিলেন লেখক ও কবি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও সমাজসংস্কারক, উনসত্তরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তুখোড় ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ধর্মীয় পন্ডিত। তাছাড়া অটুট স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও রণাঙ্গনে সম্মুখসমরে লড়াকু এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহসে নিজ জেলা ফেনীতে প্রথম উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

আপসহীন সংগ্রামী এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দুর্জয় সাহস, অমিত তেজ, সরল যুক্তি, কুশল-প্রকাশভঙ্গি এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা সবই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক আজকের সূর্যোদয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ছাড়াও ছিলেন জি-নিউজ ওয়ার্ল্ড এবং রূপসী বাংলা টিভির পরিচালক। ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিইও, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যস্ত সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী  সিনিয়র সদস্য, হিউম্যান রাইটস গ্রুপ- বাংলাদেশের মহাসচিব, চট্টগ্রাম বিভাগ সাংবাদিক ফোরাম- ঢাকার সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্ত্রীয় কমিটির সম্পাদক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান, কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের গুরুদায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এ সকল পরিচয় ছাপিয়ে বন্ধুর পরিবেশেও অক্লান্ত সারথির মতো লিখে হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার গেদুচাচা, সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সত্যনিষ্ঠ নির্লোভ নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি। সাংবাদিকতায় নবধারা সূচনা করে সততা ও নিয়মনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কালক্রমে নিজেকে পরিণত করেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে।

যাত্রালগ্নেই ‘গেদুচাচা’ ছদ্মনামের আড়ালে আজকের সূর্যোদয়ের পাতায় প্রকাশিত হয়ে সামরিক স্বৈরশাসক আর শোষকশ্রেণির মনে হৃদকম্পন জাগাত যেমন, তেমনি ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ ঘটিয়ে বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ী করে তুলতেন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিক্রমী সাংবাদিকতার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা এ-যুগে বিরল।

গেদুচাচার ছিল দৃষ্টির বৈভব আর ভাষার জাদু। কলামের বৈশিষ্ট্য ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ। তথ্যের ব্যাপৃত ছিল নিম্নবর্গ হতে উচ্চবর্গ, মেঠোপথ হতে রাজপথ, অজপাড়া হতে মন্ত্রীপাড়া, কুঁড়েঘর হতে গণভবন ও বঙ্গভবন পর্যন্ত। এতে সংখ্যাগুরু আঞ্চলিক ভাষাকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে নবতর ঢঙ্গে ভাষাশৈলীর মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাসহ লেখায় বৈপরীত্য বিষয়বস্তুতে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে অগণিত পাঠকের হৃদয়শীর্ষে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।

গেদুচাচার কলামে থাকত গণমানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা, দাবি-দাওয়া এবং সমাজ ও সরকারসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের যতসব অনাচার-অসঙ্গতি, ভুল-ভ্রান্তি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারীর বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ এক গতি। দিব্যচোখে স্বচ্ছ-সে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সম্যক বৈষম্যের খুঁটিনাটি সামগ্রিক বিষয়। লেখনিতে কাল্পনিক তথ্যে ভর করে রূপগল্প ফেঁদে পাঠকের হাতের তালুতে বসতে চাননি কখনো, সর্বদা চেয়েছেন ‘খবর ভালো হোক মন্দ হোক আমরা সত্যকথা বলব’ সম্পাদকীয় নীতিতে পাঠকের আস্থার জায়গাটিতে বসতে। এতে হয়ে উঠেছিলেন ৬৮ হাজার গ্রামের মুখপাত্র ও অভিভাবক।

‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ শিরোনামে ‘আর্ট অব ব্লিঙ্কিং’ পদ্ধতি অনুসরণে সরস ভাষায় জনজীবনভিত্তিক কলাম লিখে দেশ-দুনিয়ায় পরিচিতি ‘গেদুচাচা’ হিসেবে। তাঁর ভাষায় — মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা, ‘আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আমাকে আপনার না চেনারই কথা। আমি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ১০ কোটি মানুষের একজন। থাকি অজপাড়া গাঁয়ে। সকলে আমারে গেদুচাচা বলিয়া ডাকে। পুতেও ডাকে চাচা, বাপেও ডাকে চাচা। মানে আমি সকলের চাচা। সেই মতে ভোটের লিস্টির মধ্যেও আমার নাম হইয়া গিয়াছে গেদুচাচা।’

ধীমান পাঠক ছাড়া অন্যরা জানতেনই না আদতে ‘কে’ এই গেদুচাচা! গ্রন্থনায় থাকতেন খ. ম. হ.। মহৎপ্রাণ এ যুগন্ধরই খোন্দকার মোজাম্মেল হক। আশির দশকে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে কঠিন খারাপ সময়ে ভিমরুলে ঢিল ছুড়তেই বজ্রশক্তিতে কলামটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল যখন দেশ চলছিল দুর্দান্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মুখোশে নির্ভেজাল ডিক্টেটরি স্টাইলে। তখন সাংবাদিকতাও ছিল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেরই অংশ। সে সময় অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদকদের হয়রানি ও ধরে ধরে জেলেপোরাসহ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল নির্বাসনে।

জেনারেল এরশাদের এই স্বৈরশাসনামলে এক বেয়াড়া সময়ে প্রবর্তন-করা সাপ্তাহিক সুগন্ধা সম্পাদনাকালীন ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ শিরোনামে চিরায়ত গেঁয়ো ভাষায় ব্যতিক্রমধর্মী সাড়া জাগানিয়া এই কলামটির যাত্রাতেই গন্তব্যের জানান দেন জাদুময়ী ব্যঞ্জনায় —

‘… গতকাইল আমাদের গেরামের চৌধুরী বাড়ির আবু চৌধুরী বাড়ি আসিয়াছে। তিনি বলিলেন, এই বছরই আবার নাকি একখান ভোট হইবে। সেই কথাখানা শুনিবার পর হইতে সারারাইত আমার ঘুম হয় নাই। … চাচা, আপনার আল্লার কসম লাগে আপনি আর ভোট দিয়েন না। এই বছরের পয়লা যেই দুইখানা ভোট দিয়াছেন, তাহাতেই সারাজনমের হাউস মিটিয়া গিয়াছে। সেই নির্বাচন দেখিয়া আমার ‘৪৭ সালের রায়টের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল। … শুনিতেছি আপনি নাকি ভোটের নিয়ম বদলাইয়া দিবার কথা ভাবিতেছেন। তাহাতে আমার এখখান পরামর্শ আছে। সেইটা হইলো, দশ বছরে একবার ভোট দিবেন। ভোটকেন্দ্রে আমরা যেতে চাই না। অবশ্য না গেলেও ঠিকমতো ভোট হইয়া যায়। এমনকি যাহারা বাঁচিয়া নাই, তাহারাও ভোট দিয়া যায়! খামোখা ভোটের দরকার কী?”

এভাবেই টক-ঝাল-মিষ্টি মিশিয়ে ও নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে উপস্থাপিত খোন্দকার মোজাম্মেল হক ‘গেদুচাচা’ হয়ে মানুষের মনের কথাকে দরদী ভাষায় তীর্যকভাবে উপস্থাপনার পাশাপাশি কলামে উপস্থাপন করতেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের স্বৈর রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের গঠনমূলক সমালোচনা এবং এর সঠিক  সমাধানও।

গেদুচাচার খোলাচিঠিতে থাকত আদরণীয় যতসব সম্বোধন — মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা। তাছাড়া প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তখন সম্বোধনে লিখে দিলেন — ‘মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কডু চাচা’। ৬৮ হাজার গ্রামেই ছিল গেদুচাচার বিশ্বস্ত সোর্স। জেনে নিয়েছিলেন কডু মিয়া ছিল শাহাবুদ্দীন আহমেদের পারিবারিক নাম — ব্যাস্! এমনিভাবেই লিখতেন — মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা বিবি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর চাচা /ফখরুদ্দীন চাচা, মাননীয় বিরোধীনেতা হাছিনা বিবি /মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাছিনা বিবি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক খালেদা-হাসিনা শাসনামলেও সমাজে, রাষ্ট্রে ও সরকারে ঘটে যাওয়া চুম্বকাংশ তৃতীয় নয়নে গেদুচাচার মুখেই যেন নিজের মতামত ও পরামর্শ এক অভিনব কায়দায় বলে যেতেন। যা লিখতেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য করে খোলাখুলিভাবেই লিখতেন। পরিমিত কিন্তু চৌকস ভাষায় ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের অনিয়ম-অসঙ্গতি-দুর্নীতি তুলে ধরার মেধাবী বিশ্লেষণ ও সমাধানই ছিল তাঁর শক্তির উৎস।

নব্বই দশকের গোড়াতে ‘সুগন্ধা’ পত্রিকা ছেড়ে প্রথমে ‘সূর্যোদয়’ এবং পরে ‘আজকের সূর্যোদয়’ পত্রিকা প্রকাশ করে এ এযাবৎকাল লাভ করেন জনমতকে প্রভাবিত করার দুর্লভ ক্ষমতা। জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবিচল ও দায়িত্বশীল থেকে যুক্তির ভাষায় প্রতিটি ইস্যু গণতান্ত্রিক ফয়সালার দিকনির্দেশনা দিতেন। কারোর প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ বা বিদ্বেষ নয়, জনসাধারণের প্রতি অগাধ ভালোবাসার উম্মুখে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্যক দৃশ্যপট উম্মোচনে প্রয়াস পেতেন তিনি।

রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাঁদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গেদুচাচার খোলাচিঠিকে কীভাবে মূল্যায়নে নিতেন তা তো ছিলই, তার চেয়েও বড় কথা গেদুচাচাতে আসক্ত থাকতেন পাঠককুল। শাসকগোষ্ঠীসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থক আর সাধারণ পাঠক সবাই গভীর আগ্রহে প্রহর গুনতেন পত্রিকা প্রকাশের প্রত্যুষের ক্ষণটিতে — ‘গেদুচাচা’ কী লিখেছেন তা জানতে। এখানেই গেদুচাচা একটি প্রজন্মের নেতা।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক-সৃষ্ট গেদুচাচা চরিত্রটি সত্যিই অনবদ্য-অনন্য সৃষ্টি। সত্য ও ন্যায়ের বিক্রমী সাংবাদিকতার মূর্ত প্রতীক। সৃষ্ট গেদুচাচাই হয়ে উঠেন ‘স্টেটসম্যান’ — ‘টেন আউট অব টেন’। তাঁর পরিচয় একজন কলাম লেখক ও সাংবাদিক-সম্পাদক হলেও তাঁর ভূমিকা ছিল একজন ‘স্টেটসম্যান’ – এর মতোই অসামান্য। একজন স্টেটসম্যান যেমন জাতীয় দুর্দিনে জাতিকে দিশা ও সঠিক পরামর্শ দেন এবং জাতি তা নিঃসঙ্কোচে পালন করে, তেমনি গেদুচাচার আহ্বান বা পরামর্শ জাতি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছে।

কর্তৃপক্ষীয় সমাধান যে আসত না তা কিন্তু নয়। গেদুচাচা মুত্যুর বছরখানেক আগে ২৩ জুন স্বনামে খোন্দকার মোজাম্মেল হকের লেখা ‘সু-সংবাদ দুঃসংবাদ’ কলামে উল্লেখ করে গেছেন গেদুচাচার প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চিরকুটের বিষয়টি। তাতে এরশাদ লেখেন, ‘আপনি অত্যন্ত পন্ডিত ব্যক্তি। আপনার জ্ঞান-গরিমা এবং মূল্যবান পরামর্শের প্রতি আমার যথাযথ সম্মানবোধ রয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে লেখা আপনার খোলাচিঠি আমি সর্বাত্মক গুরুত্বসহকারে পাঠ করেছি। বুঝার চেষ্টা করেছি এবং উপদেশাবলি গ্রহণের চেষ্টা করেছি।’

‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ পাঠকনন্দিত কলামের পাশাপাশি একই পত্রিকায় ‘সিদ্ধিবাবার উপলব্ধি’, ‘ক্রসকানেকশন’, ‘স্বর্গ-নরকসহ একটি ধর্মীয় কলামে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় নিজেকে ব্যতিক্রমী দক্ষ সাংবাদিক হিসেবেই শুধু নয়, দেশের অন্যতম সেরা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; অর্জন করেছিলেন শ্যামল বাংলার জনপদের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষের অনুপম শ্রদ্ধা আর অতল ভালোবাসা।

ব্যতিক্রম তিনি অন্যদিক থেকেও। কেবল সেলিব্রিট সাংবাদিক ছিলেন না, সেলিব্রিটদের সেলিব্রিটি ছিলেন। ছিলেন অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের গুরুও। তথ্যনির্ভর ক্ষুরধার অথচ রসাত্মক উপস্থাপনায় কলামে থাকত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরের সম্মোহনী শক্তি। যাতে পাঠক পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতেন তাঁর কলামের সঙ্গে।

উজানস্রোতে চলার পথ কিন্তু মসৃণ ছিল না মোটেও। সত্যের পথে হাঁটতে হয়েছে ৬৬ মামলা ও হুলিয়া খেয়ে। অধিকাংশ মামলা লড়েছেন নিজে আইনজীবী হয়ে। সহধর্মিণী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফারজানা মোজাম্মেল হক পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখতেন সিদ্ধহস্তে। প্রচারসংখ্যার বিচারে কাগজের কোটা বরাদ্দ মিলত না, না মিলত বিজ্ঞাপন। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধ ‘তৈল’ মাখতে পারতেন না বলে পাঠকই ছিল লক্ষ্মী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও ছিল না কোনো উচ্চাভিলাষ। লোভনীয় টোপের পাশাপাশি ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী সম্পাদক হয়ে পাহাড়সম সম্পদ গড়ার অপার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দৈন্যতাকে বেছে সততাই ছিল নীতি। এ কারণেই সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। তিনি আমাদের শুনাতেন, ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু সবকিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’

সেই সত্যকে খুঁজে ফিরি এখন। তুমি তোমার বিখ্যাত কলাম ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র ইতিতে সম্বোধনকারীকে লিখতে — আপনারই ৬৮ হাজার গেরামের নালায়েক নাখান্দা অধম ‘গেদুচাচা’।

গেদুচাচা তুমি মোটেও তা নও। অকুতোভয় আত্মত্যাগের লড়াইয়ে প্রেরণার বলিষ্ঠ স্বচ্ছ চিন্তার মহানায়ক তুমি। জাতির মনন তৈরিতে তোমার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। রাষ্ট্রীয় পদ-পদবির পথ মাড়াওনি, গেদুচাচাই ছিল অভিধা।

তুমি সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবনার সেতুবন্ধন রচনা করায় বাংলার মানুষের হৃদয়ে রবে অবিনশ্বর। ছিলে ‘ফেইলিওর ইজ দ্যা পিলার অব সাকসেস’ — যা মিস করি। প্রার্থনা, লাভ করো খোদার দিদার।  #

রফিকুল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

গেদুচাচা’ বিশ্বসাংবাদিকতায় এক ব্যতিক্রমী ও বিরল চরিত্র

আপডেট টাইম : ১২:৫৫:৪১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৯ জুন ২০২১

রফিকুল ইসলামঃ আমি এখন বলব, /বলতে হবে এখনই /একজন সংশপ্তক কলমযোদ্ধার কথা।  /যে জানে নিশ্চিত পরাজয় সম্মুখে /তবুও সে পরাজিত নয় /যদিও এখন পর্যন্ত সে মৃত।’

আজ ২৯ জুন। গণমানুষের পথের দিশারি ‘গেদুচাচা’র প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। সত্য ও সাহসিকতায় একনিষ্ঠ গেদুচাচা এক বিরল চরিত্র। ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র কালজয়ী কলাম লেখক হলেন আজকের সূর্যোদয় পত্রিকার প্রধান সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক, যা অনেকেরই অজানা। গতবার ২০২০ সালের এ দিনে রাজধানী ঢাকার একটি প্রাইভেট হসপিটালে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে ৭০ বছর বয়সে মারা যান গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃৎ এই ক্ষণজন্মা।

নিভৃতচারী এই মিলিন্যান্ট প্রখ্যাত সম্পাদকের জন্ম ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার গতিয়া পূর্ব সোনাপুর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে। পিতা এটিএম খোন্দকার ওবায়দুল হক এবং মাতা সৈয়দা আজিজুন নেছা খানম। তাঁর শিক্ষাবিদ পিতার পূর্বপুরুষ ছিলেন বাগদাদের অধিবাসী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। ছিলেন লেখক ও কবি এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা ও শিক্ষক-শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও সমাজসংস্কারক, উনসত্তরে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের তুখোড় ছাত্রনেতা, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ধর্মীয় পন্ডিত। তাছাড়া অটুট স্বদেশপ্রেমে উজ্জীবিত মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও রণাঙ্গনে সম্মুখসমরে লড়াকু এই বীর মুক্তিযোদ্ধা অসীম সাহসে নিজ জেলা ফেনীতে প্রথম উড়িয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা।

আপসহীন সংগ্রামী এই প্রবাদপ্রতিম পুরুষটি বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। দুর্জয় সাহস, অমিত তেজ, সরল যুক্তি, কুশল-প্রকাশভঙ্গি এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতা সবই আয়ত্ত করেছিলেন তিনি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক আজকের সূর্যোদয় গ্রুপের চেয়ারম্যান ছাড়াও ছিলেন জি-নিউজ ওয়ার্ল্ড এবং রূপসী বাংলা টিভির পরিচালক। ওয়ার্ল্ডওয়াইড অনলাইন জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিইও, তথ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যস্ত সম্পাদক, জাতীয় প্রেসক্লাবের নির্বাহী  সিনিয়র সদস্য, হিউম্যান রাইটস গ্রুপ- বাংলাদেশের মহাসচিব, চট্টগ্রাম বিভাগ সাংবাদিক ফোরাম- ঢাকার সভাপতি, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন্ত্রীয় কমিটির সম্পাদক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার কল্যাণ পরিষদের চেয়ারম্যান, কয়েকটি বিদেশি গণমাধ্যমের বাংলাদেশ প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনের গুরুদায়িত্বে ছিলেন তিনি।

এ সকল পরিচয় ছাপিয়ে বন্ধুর পরিবেশেও অক্লান্ত সারথির মতো লিখে হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার গেদুচাচা, সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় কলাম লেখক এবং মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার সত্যনিষ্ঠ নির্লোভ নির্ভীক সাংবাদিকতার কিংবদন্তি। সাংবাদিকতায় নবধারা সূচনা করে সততা ও নিয়মনিষ্ঠার মধ্য দিয়ে কালক্রমে নিজেকে পরিণত করেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠানে।

যাত্রালগ্নেই ‘গেদুচাচা’ ছদ্মনামের আড়ালে আজকের সূর্যোদয়ের পাতায় প্রকাশিত হয়ে সামরিক স্বৈরশাসক আর শোষকশ্রেণির মনে হৃদকম্পন জাগাত যেমন, তেমনি ৫৬ হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডের অধিবাসীদের জাতীয়তাবোধের স্ফুরণ ঘটিয়ে বৈষম্যহীন ও দুর্নীতিমুক্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ী করে তুলতেন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে বিক্রমী সাংবাদিকতার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা এ-যুগে বিরল।

গেদুচাচার ছিল দৃষ্টির বৈভব আর ভাষার জাদু। কলামের বৈশিষ্ট্য ছিল বঞ্চিত মানুষের অধিকার প্রশ্নে উচ্চকণ্ঠ। তথ্যের ব্যাপৃত ছিল নিম্নবর্গ হতে উচ্চবর্গ, মেঠোপথ হতে রাজপথ, অজপাড়া হতে মন্ত্রীপাড়া, কুঁড়েঘর হতে গণভবন ও বঙ্গভবন পর্যন্ত। এতে সংখ্যাগুরু আঞ্চলিক ভাষাকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে নবতর ঢঙ্গে ভাষাশৈলীর মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করাসহ লেখায় বৈপরীত্য বিষয়বস্তুতে অন্তর্দৃষ্টি ফেলে অগণিত পাঠকের হৃদয়শীর্ষে ঠাঁই করে নিয়েছিলেন।

গেদুচাচার কলামে থাকত গণমানুষের অভাব-অভিযোগ, দুঃখ-বেদনা, দাবি-দাওয়া এবং সমাজ ও সরকারসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের যতসব অনাচার-অসঙ্গতি, ভুল-ভ্রান্তি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারীর বিরুদ্ধে অনিরুদ্ধ এক গতি। দিব্যচোখে স্বচ্ছ-সে দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ সম্যক বৈষম্যের খুঁটিনাটি সামগ্রিক বিষয়। লেখনিতে কাল্পনিক তথ্যে ভর করে রূপগল্প ফেঁদে পাঠকের হাতের তালুতে বসতে চাননি কখনো, সর্বদা চেয়েছেন ‘খবর ভালো হোক মন্দ হোক আমরা সত্যকথা বলব’ সম্পাদকীয় নীতিতে পাঠকের আস্থার জায়গাটিতে বসতে। এতে হয়ে উঠেছিলেন ৬৮ হাজার গ্রামের মুখপাত্র ও অভিভাবক।

‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ শিরোনামে ‘আর্ট অব ব্লিঙ্কিং’ পদ্ধতি অনুসরণে সরস ভাষায় জনজীবনভিত্তিক কলাম লিখে দেশ-দুনিয়ায় পরিচিতি ‘গেদুচাচা’ হিসেবে। তাঁর ভাষায় — মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা, ‘আমার সালাম গ্রহণ করিবেন। আমাকে আপনার না চেনারই কথা। আমি বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের ১০ কোটি মানুষের একজন। থাকি অজপাড়া গাঁয়ে। সকলে আমারে গেদুচাচা বলিয়া ডাকে। পুতেও ডাকে চাচা, বাপেও ডাকে চাচা। মানে আমি সকলের চাচা। সেই মতে ভোটের লিস্টির মধ্যেও আমার নাম হইয়া গিয়াছে গেদুচাচা।’

ধীমান পাঠক ছাড়া অন্যরা জানতেনই না আদতে ‘কে’ এই গেদুচাচা! গ্রন্থনায় থাকতেন খ. ম. হ.। মহৎপ্রাণ এ যুগন্ধরই খোন্দকার মোজাম্মেল হক। আশির দশকে জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে কঠিন খারাপ সময়ে ভিমরুলে ঢিল ছুড়তেই বজ্রশক্তিতে কলামটির আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল যখন দেশ চলছিল দুর্দান্ড প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পাকিস্তানের ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের মুখোশে নির্ভেজাল ডিক্টেটরি স্টাইলে। তখন সাংবাদিকতাও ছিল গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামেরই অংশ। সে সময় অনেক প্রথিতযশা সাংবাদিক ও সম্পাদকদের হয়রানি ও ধরে ধরে জেলেপোরাসহ পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল নির্বাসনে।

জেনারেল এরশাদের এই স্বৈরশাসনামলে এক বেয়াড়া সময়ে প্রবর্তন-করা সাপ্তাহিক সুগন্ধা সম্পাদনাকালীন ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ শিরোনামে চিরায়ত গেঁয়ো ভাষায় ব্যতিক্রমধর্মী সাড়া জাগানিয়া এই কলামটির যাত্রাতেই গন্তব্যের জানান দেন জাদুময়ী ব্যঞ্জনায় —

‘… গতকাইল আমাদের গেরামের চৌধুরী বাড়ির আবু চৌধুরী বাড়ি আসিয়াছে। তিনি বলিলেন, এই বছরই আবার নাকি একখান ভোট হইবে। সেই কথাখানা শুনিবার পর হইতে সারারাইত আমার ঘুম হয় নাই। … চাচা, আপনার আল্লার কসম লাগে আপনি আর ভোট দিয়েন না। এই বছরের পয়লা যেই দুইখানা ভোট দিয়াছেন, তাহাতেই সারাজনমের হাউস মিটিয়া গিয়াছে। সেই নির্বাচন দেখিয়া আমার ‘৪৭ সালের রায়টের কথা মনে পড়িয়া গিয়াছিল। … শুনিতেছি আপনি নাকি ভোটের নিয়ম বদলাইয়া দিবার কথা ভাবিতেছেন। তাহাতে আমার এখখান পরামর্শ আছে। সেইটা হইলো, দশ বছরে একবার ভোট দিবেন। ভোটকেন্দ্রে আমরা যেতে চাই না। অবশ্য না গেলেও ঠিকমতো ভোট হইয়া যায়। এমনকি যাহারা বাঁচিয়া নাই, তাহারাও ভোট দিয়া যায়! খামোখা ভোটের দরকার কী?”

এভাবেই টক-ঝাল-মিষ্টি মিশিয়ে ও নিজস্ব ভাষাভঙ্গিতে উপস্থাপিত খোন্দকার মোজাম্মেল হক ‘গেদুচাচা’ হয়ে মানুষের মনের কথাকে দরদী ভাষায় তীর্যকভাবে উপস্থাপনার পাশাপাশি কলামে উপস্থাপন করতেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদের স্বৈর রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের গঠনমূলক সমালোচনা এবং এর সঠিক  সমাধানও।

গেদুচাচার খোলাচিঠিতে থাকত আদরণীয় যতসব সম্বোধন — মাননীয় প্রেসিডেন্ট এরশাদ চাচা। তাছাড়া প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দীন আহমেদ যখন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তখন সম্বোধনে লিখে দিলেন — ‘মাননীয় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি কডু চাচা’। ৬৮ হাজার গ্রামেই ছিল গেদুচাচার বিশ্বস্ত সোর্স। জেনে নিয়েছিলেন কডু মিয়া ছিল শাহাবুদ্দীন আহমেদের পারিবারিক নাম — ব্যাস্! এমনিভাবেই লিখতেন — মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খালেদা বিবি, মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর চাচা /ফখরুদ্দীন চাচা, মাননীয় বিরোধীনেতা হাছিনা বিবি /মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাছিনা বিবি।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক খালেদা-হাসিনা শাসনামলেও সমাজে, রাষ্ট্রে ও সরকারে ঘটে যাওয়া চুম্বকাংশ তৃতীয় নয়নে গেদুচাচার মুখেই যেন নিজের মতামত ও পরামর্শ এক অভিনব কায়দায় বলে যেতেন। যা লিখতেন, তা যুক্তিগ্রাহ্য করে খোলাখুলিভাবেই লিখতেন। পরিমিত কিন্তু চৌকস ভাষায় ক্ষয়িষ্ণু সমাজ, সরকার ও রাষ্ট্রের অনিয়ম-অসঙ্গতি-দুর্নীতি তুলে ধরার মেধাবী বিশ্লেষণ ও সমাধানই ছিল তাঁর শক্তির উৎস।

নব্বই দশকের গোড়াতে ‘সুগন্ধা’ পত্রিকা ছেড়ে প্রথমে ‘সূর্যোদয়’ এবং পরে ‘আজকের সূর্যোদয়’ পত্রিকা প্রকাশ করে এ এযাবৎকাল লাভ করেন জনমতকে প্রভাবিত করার দুর্লভ ক্ষমতা। জাতীয় স্বার্থের প্রতি অবিচল ও দায়িত্বশীল থেকে যুক্তির ভাষায় প্রতিটি ইস্যু গণতান্ত্রিক ফয়সালার দিকনির্দেশনা দিতেন। কারোর প্রতি ব্যক্তিগত বিরাগ বা বিদ্বেষ নয়, জনসাধারণের প্রতি অগাধ ভালোবাসার উম্মুখে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সম্যক দৃশ্যপট উম্মোচনে প্রয়াস পেতেন তিনি।

রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান তাঁদের দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে গেদুচাচার খোলাচিঠিকে কীভাবে মূল্যায়নে নিতেন তা তো ছিলই, তার চেয়েও বড় কথা গেদুচাচাতে আসক্ত থাকতেন পাঠককুল। শাসকগোষ্ঠীসহ রাজনৈতিক নেতাকর্মী-সমর্থক আর সাধারণ পাঠক সবাই গভীর আগ্রহে প্রহর গুনতেন পত্রিকা প্রকাশের প্রত্যুষের ক্ষণটিতে — ‘গেদুচাচা’ কী লিখেছেন তা জানতে। এখানেই গেদুচাচা একটি প্রজন্মের নেতা।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক-সৃষ্ট গেদুচাচা চরিত্রটি সত্যিই অনবদ্য-অনন্য সৃষ্টি। সত্য ও ন্যায়ের বিক্রমী সাংবাদিকতার মূর্ত প্রতীক। সৃষ্ট গেদুচাচাই হয়ে উঠেন ‘স্টেটসম্যান’ — ‘টেন আউট অব টেন’। তাঁর পরিচয় একজন কলাম লেখক ও সাংবাদিক-সম্পাদক হলেও তাঁর ভূমিকা ছিল একজন ‘স্টেটসম্যান’ – এর মতোই অসামান্য। একজন স্টেটসম্যান যেমন জাতীয় দুর্দিনে জাতিকে দিশা ও সঠিক পরামর্শ দেন এবং জাতি তা নিঃসঙ্কোচে পালন করে, তেমনি গেদুচাচার আহ্বান বা পরামর্শ জাতি ঠিক সেভাবেই গ্রহণ করেছে।

কর্তৃপক্ষীয় সমাধান যে আসত না তা কিন্তু নয়। গেদুচাচা মুত্যুর বছরখানেক আগে ২৩ জুন স্বনামে খোন্দকার মোজাম্মেল হকের লেখা ‘সু-সংবাদ দুঃসংবাদ’ কলামে উল্লেখ করে গেছেন গেদুচাচার প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের চিরকুটের বিষয়টি। তাতে এরশাদ লেখেন, ‘আপনি অত্যন্ত পন্ডিত ব্যক্তি। আপনার জ্ঞান-গরিমা এবং মূল্যবান পরামর্শের প্রতি আমার যথাযথ সম্মানবোধ রয়েছে। আমার উদ্দেশ্যে লেখা আপনার খোলাচিঠি আমি সর্বাত্মক গুরুত্বসহকারে পাঠ করেছি। বুঝার চেষ্টা করেছি এবং উপদেশাবলি গ্রহণের চেষ্টা করেছি।’

‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’ পাঠকনন্দিত কলামের পাশাপাশি একই পত্রিকায় ‘সিদ্ধিবাবার উপলব্ধি’, ‘ক্রসকানেকশন’, ‘স্বর্গ-নরকসহ একটি ধর্মীয় কলামে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনায় নিজেকে ব্যতিক্রমী দক্ষ সাংবাদিক হিসেবেই শুধু নয়, দেশের অন্যতম সেরা সম্পাদক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন; অর্জন করেছিলেন শ্যামল বাংলার জনপদের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষের অনুপম শ্রদ্ধা আর অতল ভালোবাসা।

ব্যতিক্রম তিনি অন্যদিক থেকেও। কেবল সেলিব্রিট সাংবাদিক ছিলেন না, সেলিব্রিটদের সেলিব্রিটি ছিলেন। ছিলেন অনেক খ্যাতিমান সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতাদের গুরুও। তথ্যনির্ভর ক্ষুরধার অথচ রসাত্মক উপস্থাপনায় কলামে থাকত হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার সুরের সম্মোহনী শক্তি। যাতে পাঠক পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতেন তাঁর কলামের সঙ্গে।

উজানস্রোতে চলার পথ কিন্তু মসৃণ ছিল না মোটেও। সত্যের পথে হাঁটতে হয়েছে ৬৬ মামলা ও হুলিয়া খেয়ে। অধিকাংশ মামলা লড়েছেন নিজে আইনজীবী হয়ে। সহধর্মিণী ব্যবস্থাপনা সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফারজানা মোজাম্মেল হক পত্রিকার প্রকাশনা অব্যাহত রাখতেন সিদ্ধহস্তে। প্রচারসংখ্যার বিচারে কাগজের কোটা বরাদ্দ মিলত না, না মিলত বিজ্ঞাপন। বেসরকারি বিজ্ঞাপনের ক্ষেত্রেও হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রবন্ধ ‘তৈল’ মাখতে পারতেন না বলে পাঠকই ছিল লক্ষ্মী।

খোন্দকার মোজাম্মেল হক একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও ছিল না কোনো উচ্চাভিলাষ। লোভনীয় টোপের পাশাপাশি ক্ষমতাধর ও প্রভাবশালী সম্পাদক হয়ে পাহাড়সম সম্পদ গড়ার অপার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও দৈন্যতাকে বেছে সততাই ছিল নীতি। এ কারণেই সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। তিনি আমাদের শুনাতেন, ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায় কিন্তু সবকিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’

সেই সত্যকে খুঁজে ফিরি এখন। তুমি তোমার বিখ্যাত কলাম ‘গেদুচাচার খোলাচিঠি’র ইতিতে সম্বোধনকারীকে লিখতে — আপনারই ৬৮ হাজার গেরামের নালায়েক নাখান্দা অধম ‘গেদুচাচা’।

গেদুচাচা তুমি মোটেও তা নও। অকুতোভয় আত্মত্যাগের লড়াইয়ে প্রেরণার বলিষ্ঠ স্বচ্ছ চিন্তার মহানায়ক তুমি। জাতির মনন তৈরিতে তোমার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। রাষ্ট্রীয় পদ-পদবির পথ মাড়াওনি, গেদুচাচাই ছিল অভিধা।

তুমি সরকার ও জনগণের মধ্যে ভাবনার সেতুবন্ধন রচনা করায় বাংলার মানুষের হৃদয়ে রবে অবিনশ্বর। ছিলে ‘ফেইলিওর ইজ দ্যা পিলার অব সাকসেস’ — যা মিস করি। প্রার্থনা, লাভ করো খোদার দিদার।  #

রফিকুল ইসলাম: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়, ঢাকা।