হাওর বার্তা ডেস্কঃ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ভোলা-৩ আসনের সংসদ সদস্য হওয়ার পর প্রচুর অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। সংসদ সদস্য হওয়ার আগে বার্ষিক ১০ লাখ টাকা আয় করা শাওনের এখন বার্ষিক আয় ১০ কোটি টাকার ওপরে। রাজধানী ঢাকায় কিনেছেন একাধিক ফ্ল্যাট, অন্তত ১০ খণ্ড জমি। নিজের নির্বাচনী এলাকায় কিনেছেন পুকুর, বাগান, ভিটাসহ অন্তত ৭২৯ শতাংশ জমি। মালিক হয়েছেন তিনটি গাড়ি ও একাধিক আগ্নেয়াস্ত্রের। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, নিজ ও স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংকে ৪৪টি হিসাবে জমা আছে প্রায় ১৫ কোটি টাকা।
সিন্ডিকেট গড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ঠিকাদারি কাজ ভাগবাটোয়ারার মধ্য দিয়ে বেশির ভাগ অর্থ আয় করেছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। সূত্রগুলো বলছে, আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত এসব সম্পদের বাইরেও শাওনের আরো কয়েক শ কোটি টাকার সম্পদ আছে। যেগুলো তাঁর ঘনিষ্ঠদের নামে রয়েছে। তাঁর প্রদর্শিত সম্পদের তথ্যবিবরণী ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য কালের কণ্ঠ’র হাতে আছে। শাওন যুবলীগের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ নেতা হিসেবে পরিচিত। আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুদ্ধি অভিযান শুরুর পরে দুজনই কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। যুবলীগ নেতাদের সঙ্গে আজ রবিবার গণভবনের বৈঠকেও তাঁদের দুজনকে উপস্থিত থাকতে অনুমতি দেননি শেখ হাসিনা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে চিঠি দিয়ে দেশের সব ব্যাংকে শাওন ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী এবং তাঁদের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাংক হিসাবের তথ্য জানতে চাওয়া হয়।
একাধিক সূত্র কালের কণ্ঠকে জানায়, বিভিন্ন ব্যাংকে শাওনের ১২টি হিসাবের খোঁজ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাঁর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরীর নামে ১০টি, শাওনের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান নওয়াল কনস্ট্রাকশনের নামে ১৮টি ও ডিজিটাল টেকের নামে দুটি, স্ত্রীর মালিকানাধীন ফারজানাস ক্লোসেট লিমিটেডের নামে দুটি হিসাব রয়েছে। শাওনের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলোতে প্রায় এক কোটি টাকা রয়েছে। নওয়াল কনস্ট্রাকশনের ব্যাংক হিসাবে সাড়ে ১১ কোটি ও ডিজিটাল টেকের নামে ৭০ লাখ টাকা রয়েছে। ফারজানার ব্যাংক হিসাবে রয়েছে প্রায় এক কোটি টাকা।
২০০৯ সালে নবম জাতীয় সংসদের ভোলা-৩ আসনের উপনির্বাচনে জিতে প্রথম সংসদ সদস্য হন শাওন। ওই সময় নির্বাচন কমিশনে দাখিলকৃত হলফনামা অনুসারে শাওনের আয় ছিল ১০ লাখ ২৩ হাজার ৭৬০ টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর হিসাব বিবরণী (চলতি আয়কর বর্ষে দাখিল করা) অনুসারে শাওন আয় করেছেন ১০ কোটি ৩৬ লাখ ২২ হাজার ৮২৯ টাকা ৬৭ পয়সা। এ আয়ের বেশির ভাগই এসেছে তাঁর ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠান নওয়াল কনস্ট্রাকশন থেকে।
শাওনের আয়কর বিবরণীর তথ্যানুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৬ কোটি ৬৬ লাখ ৭১ হাজার ৯৪১ টাকা। এর আগের বছর তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল ২৩ কোটি ৫৩ লাখ ৩৭ হাজার ৮১৬ টাকা। অর্থাত্ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে শাওনের তিন কোটি ১৩ লাখ ৩৪ হাজার ১২৫ টাকার সম্পদ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু পরের বছর অর্থাত্ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে শাওনের আয় তিন গুণের বেশি বেড়েছে। এ বছর তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ৩৭ কোটি দুই লাখ ৯৪ হাজার ৭৭০ টাকা ৬৭ পয়সা। এই আয়কর বিবরণী অনুসারে একটি ৩২ বোরের পিস্তল ও একটি ২২ বোরের শটগান কিনেছেন শাওন।
আয়কর রিটার্নে দেওয়া তথ্যানুসারে শাওনের রাজধানীতে দুটি ফ্ল্যাট ও বেশ কয়েকটি জমি কেনার তথ্য পাওয়া যায়। তিনি বাড্ডায় আড়াই কাঠা জমি কেনা, স্ট্যাম্প ও দলিল খরচ দেখিয়েছেন সাত লাখ ৫৩ হাজার ৬১০ টাকা। গাজীপুরের জামনগরে ৪ শতাংশ জমি কেনা, স্ট্যাম্প, দলিলসহ খরচ হয়েছে মাত্র চার লাখ ৪২ হাজার টাকা। মধুবাগের ৩৫৮/১ নয়াটোলায় এক হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও জায়গা কেনায় মোট খরচ দেখিয়েছেন এক কোটি ৮৭ লাখ টাকা। পূর্বাচলে সাড়ে সাত কাঠার প্লটের দাম সাড়ে সাত লাখ টাকা। রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী এলাকায় দশমিক ০১৮৯ অযুতাংশ জায়গা কিনতে মোট খরচ করেছেন ২৬ লাখ ৭০ হাজার টাকা। একই এলাকায় দশমিক ০৪২৫ অযুতাংশ জায়গার মালিক হতে মোট খরচ করেছেন ১৮ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। বড় মগবাজারের ৫৩ নয়াটোলায় এক হাজার পাঁচ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ও ১২০ বর্গফুটের কার পার্কিং কিনতে মোট খরচ দেখিয়েছেন ৫২ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা। বনানী এলাকায় দশমিক ০৮৯৬ অযুতাংশ জায়গা কিনতে মোট খরচ দেখিয়েছেন চার কোটি ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। জোয়ারসাহারার খিলক্ষেতে ৭.৩৯ কাঠা জায়গা কিনতে মোট খরচ দেখিয়েছেন চার কোটি ৯৯ লাখ ৩৩ হাজার ১২৫ টাকা।
নিজের নির্বাচনী এলাকা ভোলার লালমোহন উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় সংসদ সদস্য শাওন ১৯টি দলিলে জমি, ভিটা, বাগান, পুকুরসহ অন্তত ৭২৯ শতাংশ জমি কিনেছেন। উপজেলার মেহেরগঞ্জ মৌজায় ৬ শতাংশ জমি ও পুকুর কিনেছেন তিনি, দলিল করাসহ তাঁর খরচ হয়েছে ২৮ হাজার ৭৩০ টাকা। মুন্সি হাওলায় ১০ শতাংশ জমি ও ভিটাবাড়ি কিনতে ১১ লাখ পাঁচ হাজার, মেহেরগঞ্জে ৪২ শতাংশ ভিটাবাড়িসহ জমি কিনতে ২২ লাখ ১০ হাজার, ফরাজগঞ্জে ৪৮ শতাংশ কিনতে তিন লাখ ৩১ হাজার ৫০০ টাকা, একই মৌজায় ৩৭ শতাংশের একটি জমি, পুকুর ও বাগান কিনতে দুই লাখ ৪৮ হাজার ৬২৫ টাকা, ৪৫ শতাংশের আরেকটি জমি কিনতে দুই লাখ ২১ হাজার টাকা খরচ দেখিয়েছেন শাওন।
এ ছাড়া সংসদ সদস্য শাওন লালমোহনের ফরাসগঞ্জ মৌজায় দশমিক ০৭ একর জমি কিনতে মোট খরচ দেখিয়েছেন ১৩ লাখ ২৬ হাজার টাকা। মেহেরগঞ্জে ২৯ লাখ ৭০ হাজার টাকায় ৪২ শতাংশ, তিন লাখ ৪৪ হাজার ৩০০ টাকায় ৫ শতাংশ, মুন্সি হাওলায় ১৫ লাখ ১৮ হাজার টাকায় ২৯ শতাংশ, বালুর চরে দুই লাখ ৫৭ হাজার ৬০০ টাকায় ৪১ শতাংশ ও দুই লাখ ৬৮ হাজার ৮০০ টাকায় ৪৩ শতাংশ জমি কিনেছেন তিনি।
শাওন মুন্সি হাওলায় ৬ শতাংশ জমির মালিক হতে মোট খরচ করেছেন তিন লাখ ৩০ হাজার টাকা। মেহেরগঞ্জে ১৬ শতাংশ জমির মালিক হয়েছেন তিনি ১১ লাখ টাকায়। পাশকার হাওলা মৌজায় ৫৬ শতাংশ জমি কিনতে তাঁর মোট খরচ হয়েছে ১০ লাখ আট হাজার টাকা।
লালমোহন ছাড়াও তাঁর নির্বাচনী এলাকা তজিমুদ্দিন উপজেলায়ও জমি কিনেছেন শাওন। এর মধ্যে শশীগঞ্জ মৌজায় ৮ শতাংশ জমি কিনতে তিনি মোট খরচ করেছেন এক লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকা। একই মৌজায় তিনি আরো ২০ শতাংশ জমি কিনেছেন এক লাখ ১২ হাজার টাকায়।
শাওনের বাড়ি লালমোহন উপজেলায়। ওই উপজেলার ভূমি কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা ও কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন জমি ক্রয়, স্ট্যাম্প ও নিবন্ধনের যে খরচ দেখিয়েছেন তা প্রকৃত বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক কম। জমিগুলোর প্রকৃত মূল্য কয়েক গুণ বেশি।
২০০২ সালে প্রথম আয়কর দেন শাওন। ঢাকা উপকর কমিশনারের কার্যালয়ের সার্কেল-৬, কর অঞ্চল-১-এ মো. নুর নবী নামে তিনি আয়কর দেন। সে সময় তাঁর টিআইএন নম্বর ছিল ০১৩১০৩৭৯৬২/সা-৬ এবং ঠিকানা—১বি, মিরবাগ, ঢাকা। সে বছর তাঁর হাতে গচ্ছিত অর্থ, স্বর্ণ, ফার্নিচারসহ যাবতীয় সম্পদের মূল্য দেখানো হয় পাঁচ লাখ ২১ হাজার ১৭০ টাকা।
ফারজানা চৌধুরী তাঁর স্বামী শাওন সংসদ সদস্য হওয়ার পরে কোটিপতি হয়েছেন। তিনি প্রথম আয়কর দেন ২০০৮-২০০৯ অর্থবছরে। সে বছর তাঁর নিট সম্পদ ছিল আট লাখ ৫৪ হাজার ৭৫১ টাকা। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় দুই কোটি ১৫ লাখ ৯৬ হাজার ৪০৩ টাকা। এর আগের বছর তাঁর নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল এক কোটি ৮২ লাখ ৫৩ হাজার ৯০৩ টাকা।
বিপুল সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সংসদ সদস্য শাওন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি ১৭ বছর ধরে ব্যবসা করছি। বৈধভাবে ব্যবসা করে, সরকারকে ট্যাক্স দিয়েই এই সম্পদের মালিক হয়েছি। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টসহ সম্পদের বিষয়ে যাঁরা তদন্ত করছেন তাঁরা যদি অন্যায় কিছু পান তখন ব্যবস্থা নিক। আমি কোনো দিনও ক্যাসিনো পরিচালনা বা জুয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না। এমপি হওয়ার পর থেকে যুবলীগের কর্মসূচিতেও যেতাম না। আমি লালমোহন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও এমপির দায়িত্ব পালনকেই বেশি গুরুত্ব দিতাম। ফলে ঢাকার যুবলীগের নেতাদের আমাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার কিছু ছিল না।’
জানা যায়, ঢাকার অপরাধ জগতে শাওনের প্রভাব রয়েছে। ২০১০ সালে জাতীয় সংসদ এলাকায় শাওনের গাড়িতে তাঁর লাইসেন্স করা অস্ত্রের গুলিতে নিহত হন যুবলীগকর্মী ইব্রাহিম।
ঘটনাটিকে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হলেও ইব্রাহিমের পরিবার শাওনকে অভিযুক্ত করে আদালতে মামলা করেছিলেন।
কালের কণ্ঠ