জায়গা নির্বাচন: বাড়ি করার আগে জায়গা নির্বাচন জরুরি। পশ্চিম দিকে মুখ করে বাড়ি না বানানোই ভাল। এতে আপনার ঘর থাকবে ঠা-া। দ্বিতীয়ত, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, বন্যার ভয়াবহ ঝুঁকি আছে এমন এলাকায় বা জায়গায় বাড়ি বানালে বিপদ বাড়বে। প্রতিকূল পরিবেশের শিকার এলাকায় বাড়ি বানালে ঘন ঘন দুর্যোগের আঘাত সইতে হবে আপনাকে। তৃতীয়ত, যাতায়াত সহজ এবং অহরহ গণপরিবহন পাওয়া যায় এমন জায়গায় বাড়ি করলে আপনার সময় বাঁচবে। এছাড়া কাছে ধারে মুদি দোকান আছে, এমন পরিবেশও বাড়ি বানানোর জন্য ভালো। এতে সময় যেমন বাঁচবে তেমনি হাতের কাছে চটজলদি প্রয়োজনীয় জিনিসও মিলবে।
ছোটই ভালো: বড়র চেয়ে ছোটাই ভাল। পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তিতে তৈরি ছোট বাড়ি ঢাউস আকারের বাড়ির চেয়ে ভালো। বড় বাড়িতে গরম এবং ঠা-া দুটোই বেশি হয়। খরচও বাগে। যে কারণে, অপচয় কম হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণ সহজ এই চিন্তা মাথায় রেখে ছোট ও পরিকল্পিত বাড়িই ভালো। তবে যদি আপনি চান পরিবারের আকার বাড়াতে, আত্মীয়-স্বজনকেও সঙ্গে রাখতে চান তাহলে সার্বিক সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও নিশ্চিত করা দরকার।
জ্বালানি সাশ্রয়ী যন্ত্রাংশ: জ্বালানি সাশ্রয়ী বাতি, ফ্যান ইত্যাদি জিনিসপত্র ব্যবহার বাড়াতে হবে। একটি বাতি লাগানোর আগেই এর জ্বালানি খরচ চিন্তা করা উচিত। একইভাবে চুলো থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো আগেভাগেই ঠিক করে নিলে পরে আর সমস্যা হবে না। সবুজ বাড়ি গড়ে তোলার এটাও একটি অংশ।
যথাযথ ইনস্যুলেশন: বাড়ির তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের জন্য ইনস্যুলেশন (তাপ নিয়ন্ত্রণে বিশেষ পদার্থ) বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি জিনিস। তাপ ও ঠা-া নিয়ন্ত্রণেও এটা খুব কার্যকরী। এতে ঘরের অর্ধেক জ্বালানি খরচ কমে আসবে। ঘরের দরজা-জানালা এবং ডাক্ট ইনস্যুলেশন দিয়ে মুড়ে দিলে ভেতরে তাপ ঢুকতে পারে না। এতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র বেশি চালানোর প্রয়োজন হয় না বলে বিদ্যুতের সাশ্রয় হয়।
পুরোনো, ফেলে দেয়া জিনিসপত্রের ব্যবহার: পরিবেশ বান্ধব নয় এমন জিনিসপত্র কেনা থেকে বিরত থাকুন। এতে ব্যয়ও কমে আসবে। পুরোনো কাঠের মেঝে, দরজা, জানলা আপনার পরবর্তী বাড়ির জন্য ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া ফেলে দেয়া গ্লাস, অ্যালুমিনিয়াম, টাইলস, প্লাস্টিকের পণ্যও ব্যবহার করতে পারেন সবুজ ঘর নির্মাণে। পছন্দ সই জায়গায় এগুলোর ব্যবহার নান্দনিকতার ছোঁয়া দেবে আপন ঘরে।
টেকসই নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার: যদি লক্ষ্য হয় বাড়ির সবুজায়ন তাহলে শুরু থেকেই বাড়ি তৈরিতে বেছে নিতে হবে টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব নির্মাণ সামগ্রী। যা আপনার নির্মাণের ক্ষতিকর প্রভাবও কমিয়ে আনবে, কমবে পরিবেশ দূষণ। বাড়ির ছাদ, মেঝে, কেবিনেটসহ ঘরের প্রতিটি অংশই হতে হবে ইকো ফ্রেন্ডলি। ধ্বংসযোগ্য প্লাস্টিকের ব্যবহারও হতে পারে কমবেশি। তবে সবুজ বান্ধব ও নাবায়নযোগ্য সামগ্রীর ব্যাপারে যতœবান হতে হবে।
সৌর বিদ্যুতের ব্যবহার: সৌরশক্তি পরিষ্কার এবং নবায়ন যোগ্য বিদ্যুতের উৎস। প্রকৃতির শক্তি যে ব্যবহার করতে চায় তার জন্য সৌরশক্তি একটা অত্যন্ত কার্যকরী উপায়। সূর্যের আলো ও তাপ থেকে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। প্রথমত সৌর বিদ্যুৎ ব্যয় বহুল হলেও দীর্ঘ মেয়াদি চিন্তায় এটা খুবই লাভজনক। কারণ, দীর্ঘমেয়াদে এটা টাকা বাঁচাতে সহায়তা করবে। পাশাপাশি নাগরিকায়নের এই যুগে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবে সবুজের দিকে। বাড়ি করার জায়গার ওপর নির্ভর করবে আপনি কী পরিমাণ সুবিধা সৌর বিদ্যুৎ থেকে পাবেন। বিদ্যুৎ সরবরাহের জটিলতাও কমবে। সরকার তরফে প্রণোদনাও বেশ পাবেন।
বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী জানালা: বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী জানালা এখন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। বিশেষ এই জানালাগুলো দিনের বেলায় বন্ধ থাকলেও আলোর পর্যাপ্ত জোগান দেবে। বাইরের আলো ভেতরে ঢুকতে বাধা হবে না। এজন্য এটাকে এনার্জি স্টার উইন্ডোও বলা হয়। এই বিশেষ জানালা দিয়ে পর্যাপ্ত আলো ঘরের ভেতরে ঢুকতে পারায় বিদ্যুতের অপচয় কম হয়। বিদ্যুৎ সাশ্রয় হয়। এই জানালার খরচও যে খুব বেশি তা নয়।
ছোটখাটো গাছ: স্থান ভেদে টবে লাগাতে পারেন ছোট ছোট গাছ। পাতা বাহারি থেকে শুরু করে সুগন্ধী ফুল গাছের উপস্থিতিও থাকতে পারে কম বেশি। পড়ার টেবিল, শোবার ঘরের টেবিল, জানালা, বেলকুনিতেও জায়গা পেতে পারে গাছ। এতে ঘরে অক্সিজেনের সরবরাহ বাড়বে, শুষে নেবে কার্বন-ডাই অক্সাইড। ঘরেও শোভাও বাড়াবে বহুত গুণ। তবে টব ও গাছের নিয়মিত পরিচর্চা করতে হবে। অতিরিক্ত পাতা ছেটে দেয়া, গোড়ার মাটি আলগা করে দেয়া এবং নিয়মিত পানি দেওয়াও জরুরি। মাঝে মধ্যে রোদেও দিতে হবে গাছ। তারও তো পুষ্টির প্রয়োজন আছে, তাই না?
বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ট্যাঙ্ক ছাড়া পানি গরমের যন্ত্র: বৃষ্টি পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা অনেক দিক থেকে সুফল দেবে আপনাকে। বৃষ্টির পানি ঘরের ছাদ গড়িয়ে পড়বে এসে ট্যাঙ্কে। সেখান থেকে এই পানি ব্যবহার করা যাবে শৌচাগার কিংবা অন্যান্য কাজে। বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে পারলে আপনার পানি সমস্যাও অনেকটা দূর হবে। মাটির নিচ থেকে পাম্পের মাধ্যমে পানি তুলতে গেলে যে বিদ্যুতের খরচ হয় বৃষ্টির পানি ধরে রাখার সুব্যবস্থা করা গেলে সেই বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।
অন্যদিকে ট্যাঙ্ক ছাড়াই পানি গরম করা সম্ভব। বিশেষ একটি বৈদ্যুতিক কয়েলের মধ্য দিয়ে পানি পার হওয়ার সময় এটি গরম হয়ে পড়বে। এতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত পানি গরমের প্রয়োজন হবে না। এতে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে গরম পানির ট্যাঙ্ক বসানোর জন্য জায়গারও প্রয়োজন হবে না। জায়গাও বেঁচে যাবে। বৃষ্টির পানি এবং পানি গরমের বিশেষ বৈদ্যুতিক কয়েলের ব্যবহার সবুজ বাসস্থান বান্ধবও বটে। এর মাধ্যমে প্রকৃতির সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারও নিশ্চিত করা যাবে।
পরিবেশ বান্ধব আলোকসজ্জা: সবুজায়নের জন্য পরিবেশ বান্ধব আলোকসজ্জার প্রতিও গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন। সাধারণ বাতির চেয়ে এনার্জি সেভিং এলইডি এবং ফিএফএল প্রযুক্তিতে তৈরি বাতি টেকসই এবং খরচও কম। এর মাধ্যমে অধিক আলো পাওয়া যাবে কিন্তু বিদ্যুৎ খরচ হবে খুবই কম। যা আপনার সবুজ ঘরের জন্য বেশ উপযোগী।
পানির খরচ কমানো: সাধারণ নল, শৌচাগার ও শাওয়ারের কলের গতি কমিয়ে দিলে পানির অপচয় কমে আসবে। ধীরে ধীরে পানি পড়ার ব্যবস্থা পানির খরচ কেটে অর্ধেকে নামিয়ে আনবে। পাশাপাশি সুবজগৃহ বান্ধব পরিবেশও উপহার দেবে আপনাকে। তাছাড়া ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার আপনাকে পরিষ্কার কাপড়-চোপড় দেবে। এতে পানি ও বিদ্যুৎ দুটোই বাঁচবে।
আড়াআড়ি বাড়ি: আড়াআড়ি জায়গায় বাড়ি বানালে গরম ও শীত দুই কালেই সমানভাবে সুবিধা পাবেন। গরমের দিনে সূর্যের আলো সরাসরি ঢুকতে পারবে না ঘরে। আর শীতে সূর্যের আলো যাবে ঘরে। ভাবছেন কীভাবে? বাড়ির দক্ষিণ এবং পশ্চিম দিকে গাছ লাগাতে হবে। গরমের দিনে গাছের পত্রপল্লব জানালা দিলে সূর্যের তাপ ও আলো ঘরে পৌঁছতে দেবে না। আর শীতে ঝড়ে পড়বে গাছের পাতা। তখন সহসাই ঘরে আসবে সূর্যের আলো। ফলে গরমে আপনার ঘর থাকবে ঠা-া। আর শীতে থাকবে উষ্ণতা। প্রকৃতির এই সুবিধা পেতে হলে বাড়িটা বানানো চাই আড়াআড়ি জায়গায়। এ কথা ভুলে গেলে কিন্তু চলবে না। বাসগৃহে সবুজায়নের জন্য এটা খুবই উপকারী একটা পরামর্শ।