ঢাকা ১০:১৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০২ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশি সমাজে এসব কী চলছে ? অধ্যক্ষ আসাদুল হক

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:১৪:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫
  • ২৬৭ বার

Exif_JPEG_420

তিনি কৃতী ক্রিকেটার। কিন্তু তিনি কতটা মানুষ অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। অবাক হয়েছি কাগজগুলোতে খবর পড়ে। শিশু নির্যাতনের দায়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী শ্রীঘরে বিচারের অপেক্ষায়। বলা যেতে পারে, তাঁর ক্রিকেটজীবনের ইতি এখানেই, তবে সমাজটা যেহেতু বাংলাদেশের, তাই এ ‘সম্বন্ধে’ শেষ কথা খুব একটা সহজ নয়।

সচিত্র এ প্রতিবেদনে প্রকাশিত ঘটনার বিশদ বিবরণের বদলে একটুকুই বলা যায়, এরা কি মানুষ না আর কিছু? ১১ বছর বয়সী এ মেয়েটি হতে পারত তাদের কন্যা। মানুষের প্রতি মানুষের দুর্ব্যবহার ইদানীং সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ আর মানুষ নেই। অবশ্য সব মানুষের সম্পর্কে এক কথা না খাটলেও অনেকের সম্পর্কে খাটে।

বিশ্বসভ্যতা এগোচ্ছে, স্বভাবতই তার সংস্কৃতি, তার আচরণ ক্রমে সভ্যতর হবে- এমনটাই যুক্তিসংগত প্রত্যাশা। কিন্তু এ বিষয়ে পরিস্থিতি বা ঘটনা পিছন পায়ে হাঁটছে, অনেকটা ভূতের মতোই। এ ভূত অমানবিক, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। মানবিক বোধের লেশমাত্র এদের মধ্যে নেই। থাকলে শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতনের এত ঘটনা এই কিছুদিনের মধ্যে দেখা যেত না।

হঠাৎ করেই যেন শিশু নির্যাতনের ধুম পড়ে গেছে। কিন্তু এ-জাতীয় ঘটনা আজকের নয়। গৃহকর্মী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন মনে হয় এ দেশীয় সমাজে অনাচারী অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিচার, শাস্তি এ প্রবণতা দূর করতে পারছে না। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা যেন মানবস্বভাবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনাও আকসার ঘটছে।

বিগত সময়ের খতিয়ান নিলে এন্তার দেখা যাবে শিশু ও নর-নারী নির্যাতন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বিচার হচ্ছে, শাস্তি পাচ্ছে, তবু ঘটনা কমছে না। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারের নামে প্রহসন চলছে, ঝুলে থাকছে তদন্ত বছরের পর বছর। যেমন- নারায়ণগঞ্জের নিরপরাধ মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যাকাণ্ড।

এসব কী চলছে বাংলাদেশি সমাজে?ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ‘১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তারের পা এবং হাতের আঙুল ভেঙে দিয়েছেন ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন জাহান। শিশুটি যাতে বাসা থেকে পালাতে না পারে সে জন্য এক বছর ধরে তাকে বাথরুমে ঘুমাতে বাধ্য করেছেন তাঁরা। নির্যাতনের শিকার শিশুটি এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি রয়েছে।’

আসলে এ সবই সামাজিক দূষণের পরিণাম- দূষণ রাজনৈতিক, সামাজিক উভয় দিক থেকে। বিষয়টা কত দূর গড়িয়েছে তা বোঝা যায় যখন আইন প্রণেতা কোনো কোনো সংসদ সদস্য এ-জাতীয় অনাচারের ঘটক হয়ে দাঁড়ান। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, অকারণে শিশু শাহাদাত হোসেনকে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে। তেমনি স্বকৃত অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পলাতক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান রানা। স্বেচ্ছাচার আর কাকে বলে। অথচ তাঁরা দেশের আইন প্রণেতা, সমাজের অভিভাবক শ্রেণির মানুষ।

দুই.

শিশু নির্যাতন ও শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন ও নারী হত্যাসহ গুম-খুনের লাগাতার ঘটনায় বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। স্থানীয় নর-নারী খুনে বোধ হয় তৃষ্ণা মিটছে না ঘাতক গোষ্ঠীর। এখন শুরু হয়েছে পরিকল্পিতভাবে বিদেশি নাগরিক খুন। এর আগে চাপাতির আঘাতে খুন হয়েছেন একাধিক ব্লগার। বাদ যাচ্ছে না পুলিশ সদস্যও।

অবস্থাদৃষ্টে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘আইনশৃঙ্খলায় ধস’। তাতে বলা হয়েছে, পুলিশ দপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের গত ৯ মাসে সারা দেশে দুই হাজার ৮০ জন খুন হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। গত ৯ মাসে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনাও। চলন্ত গাড়িতেও ঘটেছে ধর্ষণের ঘটনা।

এই যদি হয় আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি, তাহলে মানুষ তার নিরাপত্তা নিয়ে ভীত, শঙ্কিত, আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। এ সম্পর্কে বড় কথা হলো, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী ধরা পড়ছে না, বিচার তো দূরের কথা। অভিজিৎ ও পরবর্তী ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা ও বিচার এখনো হয়নি। কবে হবে তা কেউ জানে না। আদৌ হবে কি না তা-ও জানা নেই।

এর মধ্যে বড় দুঃসংবাদ দুই বিদেশি হত্যা, যার কোনো হদিস মেলেনি এ তাবৎ। আর এ ঘটনায় বিচলিত দেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহল। গভীর দুশ্চিন্তায় সচেতন বাংলাদেশি নাগরিকরা। এ ব্যাপারে ‘সাবেক আইজিপি এম এ কাইয়ুম বলেছেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও পেশাদারির অভাবের কারণে অপরাধ বাড়ছে।’ এ ক্ষেত্রে সর্বত্র দলীয়করণ করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দিলে পুলিশ তাদের সক্ষমতা দেখাতে পারত।’

হয়তো পারত। তবে বহু কথিত পুলিশি দুর্নীতির অনেক ঘটনা তো আমাদের এখনো স্মরণে। তার কিছু কিছু এতটা অমানবিক যে ভাবা যায় না। এ পরিস্থিতি বজায় আছে এ কারণে যে পুলিশের অন্যায়, অপরাধের বিচার প্রচলিত আইনের মাপকাঠিতে হয় না। তারা বড়জোর ক্লোজড হয়, মহা আরামে দিনকয় ছুটিসদৃশ সময় কাটায়, তারপর একসময় কাজে বহাল। যে বেড়া ক্ষেত খায় তার যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে ক্ষেত খাওয়ার ঘটনা চলতেই থাকবে। এ বিষয়টা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আমলে আনা দরকার, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করা দরকার, যাতে অপরাধী পুলিশ যথাযথ শাস্তি পায়।

তিন.

সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে বলতে হচ্ছে, এ কী অবস্থা বাংলাদেশি সমাজের। দূষিত সমাজে দুর্নীতি আর অপরাধ তার সর্বাঙ্গ পুঁজরক্তে ক্ষতে একাকার করে ফেলেছে। বিশ্বের দরবারে পরিচ্ছন্ন সুশ্রী ভাবমূর্তি নিয়ে দাঁড়ানোর উপায় থাকছে না। সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে সামাজিক স্বেচ্ছাচার ও অপরাধমূলক ঘটনাবলি।

সংসদ সদস্য থেকে ক্রিকেটার, আমলা থেকে পেশাজীবী চিকিৎসক বা আইনজীবী এ-জাতীয় অপরাধের তালিকাভুক্ত। গত এক বছরের দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে এমনই এক অস্বাভাবিক অপরাধপ্রবণতার সামাজিক চিত্র, যেখানে মানবিক মূল্যবোধের নিতান্ত অভাব। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তা সত্ত্বেও সমাজের সচেতন অংশ নড়েচড়ে বসছে না, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে নিতান্তই গতানুগতিক এবং তা তাৎপর্যপূর্ণ নয়, সমাজে পরিবর্তন আনার পক্ষে যথেষ্ট নয়।

কেন এমন অবস্থা? সমাজবিজ্ঞানী বা সমাজ সচেতন লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মতে, প্রকৃত সুশাসন তথা দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে ঘাটতি- এসব অনাচার ও অপরাধপ্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ। একই সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত বাহিনীর প্রয়োজনীয় তৎপরতার অভাব ও দুর্নীতির মতো ঘটনাবলি, যা প্রতিকারহীন পরাভবে নিমজ্জিত। অংশত এ অভিযোগে সায় দিয়েছেন সাবেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা।

স্বভাবতই অপরাধ ভুবন উদ্দীপ্ত তাদের অপকর্ম লাগাতার পরিচালনায়। লক্ষ করার বিষয় যে খবরে প্রকাশ, নিষ্ঠুরভাবে শিশু রাজন হত্যার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামকে যদিও বা আনার চেষ্টা চলছে, নারায়ণগঞ্জের পৈশাচিক সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফেরত আনার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।

অথচ মাঝখানে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। নূর হোসেন ভারতে বেশ বহাল তবিয়তে আছেন। আরো কয়েক বছর এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে চাই কি সব অপরাধ ধুলায় ঢাকা পড়ে যাবে। গত কয়েক মাসে সংঘটিত শিশুহত্যার ঘটনাগুলোর তদন্ত কেমন যেন থিতিয়ে পড়ছে, উদাসীনতার ধুলোবালিতে সব কিছু ঢাকা পড়ে যাবে না তো?

পরিস্থিতি বিচারে আমাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশি সমাজের এ দূষিত অবস্থা কবে কাটবে, কিভাবে কাটতে পারে, তা নিয়ে ভাবনা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি শুধু বিদেশে ভাবমূর্তিরই নয়, এখানে প্রশ্ন একটি সমাজের সুস্থ অস্তিত্ব রক্ষার। এ কাজে সমাজের আপাত সচেতন অংশ কবে মাথা তুলে দাঁড়াবে সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়। আজ যখন এ লেখাটি শেষ করছি তখনো পড়তে হচ্ছে একটি খবর, ‘হাত-পা বেঁধে ও ছ্যাঁকা দিয়ে শিশু নির্যাতন’! জানতে পারি, শিশু বা গৃহকর্মী নির্যাতন আর কতকাল চলবে?

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

বাংলাদেশি সমাজে এসব কী চলছে ? অধ্যক্ষ আসাদুল হক

আপডেট টাইম : ১২:১৪:০৬ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৫

তিনি কৃতী ক্রিকেটার। কিন্তু তিনি কতটা মানুষ অর্থাৎ মানবিক গুণসম্পন্ন তা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে। অবাক হয়েছি কাগজগুলোতে খবর পড়ে। শিশু নির্যাতনের দায়ে তিনি ও তাঁর স্ত্রী শ্রীঘরে বিচারের অপেক্ষায়। বলা যেতে পারে, তাঁর ক্রিকেটজীবনের ইতি এখানেই, তবে সমাজটা যেহেতু বাংলাদেশের, তাই এ ‘সম্বন্ধে’ শেষ কথা খুব একটা সহজ নয়।

সচিত্র এ প্রতিবেদনে প্রকাশিত ঘটনার বিশদ বিবরণের বদলে একটুকুই বলা যায়, এরা কি মানুষ না আর কিছু? ১১ বছর বয়সী এ মেয়েটি হতে পারত তাদের কন্যা। মানুষের প্রতি মানুষের দুর্ব্যবহার ইদানীং সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। মানুষ আর মানুষ নেই। অবশ্য সব মানুষের সম্পর্কে এক কথা না খাটলেও অনেকের সম্পর্কে খাটে।

বিশ্বসভ্যতা এগোচ্ছে, স্বভাবতই তার সংস্কৃতি, তার আচরণ ক্রমে সভ্যতর হবে- এমনটাই যুক্তিসংগত প্রত্যাশা। কিন্তু এ বিষয়ে পরিস্থিতি বা ঘটনা পিছন পায়ে হাঁটছে, অনেকটা ভূতের মতোই। এ ভূত অমানবিক, নিষ্ঠুর, হৃদয়হীন। মানবিক বোধের লেশমাত্র এদের মধ্যে নেই। থাকলে শিশুহত্যা, শিশু নির্যাতনের এত ঘটনা এই কিছুদিনের মধ্যে দেখা যেত না।

হঠাৎ করেই যেন শিশু নির্যাতনের ধুম পড়ে গেছে। কিন্তু এ-জাতীয় ঘটনা আজকের নয়। গৃহকর্মী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন মনে হয় এ দেশীয় সমাজে অনাচারী অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বিচার, শাস্তি এ প্রবণতা দূর করতে পারছে না। নিষ্ঠুরতা, নির্মমতা যেন মানবস্বভাবের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেখা যাচ্ছে নির্যাতন করে হত্যার ঘটনাও আকসার ঘটছে।

বিগত সময়ের খতিয়ান নিলে এন্তার দেখা যাবে শিশু ও নর-নারী নির্যাতন, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড। বিচার হচ্ছে, শাস্তি পাচ্ছে, তবু ঘটনা কমছে না। অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিচারের নামে প্রহসন চলছে, ঝুলে থাকছে তদন্ত বছরের পর বছর। যেমন- নারায়ণগঞ্জের নিরপরাধ মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যাকাণ্ড।

এসব কী চলছে বাংলাদেশি সমাজে?ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, ‘১১ বছর বয়সী গৃহকর্মী মাহফুজা আক্তারের পা এবং হাতের আঙুল ভেঙে দিয়েছেন ক্রিকেটার শাহাদাত হোসেন ও তাঁর স্ত্রী জেসমিন জাহান। শিশুটি যাতে বাসা থেকে পালাতে না পারে সে জন্য এক বছর ধরে তাকে বাথরুমে ঘুমাতে বাধ্য করেছেন তাঁরা। নির্যাতনের শিকার শিশুটি এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি রয়েছে।’

আসলে এ সবই সামাজিক দূষণের পরিণাম- দূষণ রাজনৈতিক, সামাজিক উভয় দিক থেকে। বিষয়টা কত দূর গড়িয়েছে তা বোঝা যায় যখন আইন প্রণেতা কোনো কোনো সংসদ সদস্য এ-জাতীয় অনাচারের ঘটক হয়ে দাঁড়ান। সংবাদপত্রের খবরে প্রকাশ, অকারণে শিশু শাহাদাত হোসেনকে গুলি করার অভিযোগ উঠেছে সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনকে। তেমনি স্বকৃত অপরাধের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পলাতক সংসদ সদস্য আমানুর রহমান রানা। স্বেচ্ছাচার আর কাকে বলে। অথচ তাঁরা দেশের আইন প্রণেতা, সমাজের অভিভাবক শ্রেণির মানুষ।

দুই.

শিশু নির্যাতন ও শিশুহত্যা, নারী নির্যাতন ও নারী হত্যাসহ গুম-খুনের লাগাতার ঘটনায় বিপর্যস্ত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। স্থানীয় নর-নারী খুনে বোধ হয় তৃষ্ণা মিটছে না ঘাতক গোষ্ঠীর। এখন শুরু হয়েছে পরিকল্পিতভাবে বিদেশি নাগরিক খুন। এর আগে চাপাতির আঘাতে খুন হয়েছেন একাধিক ব্লগার। বাদ যাচ্ছে না পুলিশ সদস্যও।

অবস্থাদৃষ্টে একটি দৈনিকের শিরোনাম : ‘আইনশৃঙ্খলায় ধস’। তাতে বলা হয়েছে, পুলিশ দপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, চলতি বছরের গত ৯ মাসে সারা দেশে দুই হাজার ৮০ জন খুন হয়েছে। তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় তিন হাজার। গত ৯ মাসে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ধর্ষণের ঘটনাও। চলন্ত গাড়িতেও ঘটেছে ধর্ষণের ঘটনা।

এই যদি হয় আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি, তাহলে মানুষ তার নিরাপত্তা নিয়ে ভীত, শঙ্কিত, আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। এ সম্পর্কে বড় কথা হলো, অনেক ক্ষেত্রে অপরাধী ধরা পড়ছে না, বিচার তো দূরের কথা। অভিজিৎ ও পরবর্তী ব্লগার হত্যাকাণ্ডের মীমাংসা ও বিচার এখনো হয়নি। কবে হবে তা কেউ জানে না। আদৌ হবে কি না তা-ও জানা নেই।

এর মধ্যে বড় দুঃসংবাদ দুই বিদেশি হত্যা, যার কোনো হদিস মেলেনি এ তাবৎ। আর এ ঘটনায় বিচলিত দেশে অবস্থিত বিদেশি কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক মহল। গভীর দুশ্চিন্তায় সচেতন বাংলাদেশি নাগরিকরা। এ ব্যাপারে ‘সাবেক আইজিপি এম এ কাইয়ুম বলেছেন, মাঠপর্যায়ে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা ও পেশাদারির অভাবের কারণে অপরাধ বাড়ছে।’ এ ক্ষেত্রে সর্বত্র দলীয়করণ করার বিষয়টি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে দিলে পুলিশ তাদের সক্ষমতা দেখাতে পারত।’

হয়তো পারত। তবে বহু কথিত পুলিশি দুর্নীতির অনেক ঘটনা তো আমাদের এখনো স্মরণে। তার কিছু কিছু এতটা অমানবিক যে ভাবা যায় না। এ পরিস্থিতি বজায় আছে এ কারণে যে পুলিশের অন্যায়, অপরাধের বিচার প্রচলিত আইনের মাপকাঠিতে হয় না। তারা বড়জোর ক্লোজড হয়, মহা আরামে দিনকয় ছুটিসদৃশ সময় কাটায়, তারপর একসময় কাজে বহাল। যে বেড়া ক্ষেত খায় তার যদি দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হয়, তাহলে ক্ষেত খাওয়ার ঘটনা চলতেই থাকবে। এ বিষয়টা পুলিশের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের আমলে আনা দরকার, প্রয়োজনে আইন প্রণয়ন করা দরকার, যাতে অপরাধী পুলিশ যথাযথ শাস্তি পায়।

তিন.

সব কিছু মিলিয়ে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে বলতে হচ্ছে, এ কী অবস্থা বাংলাদেশি সমাজের। দূষিত সমাজে দুর্নীতি আর অপরাধ তার সর্বাঙ্গ পুঁজরক্তে ক্ষতে একাকার করে ফেলেছে। বিশ্বের দরবারে পরিচ্ছন্ন সুশ্রী ভাবমূর্তি নিয়ে দাঁড়ানোর উপায় থাকছে না। সব কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে সামাজিক স্বেচ্ছাচার ও অপরাধমূলক ঘটনাবলি।

সংসদ সদস্য থেকে ক্রিকেটার, আমলা থেকে পেশাজীবী চিকিৎসক বা আইনজীবী এ-জাতীয় অপরাধের তালিকাভুক্ত। গত এক বছরের দৈনিক পত্রিকার প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে এমনই এক অস্বাভাবিক অপরাধপ্রবণতার সামাজিক চিত্র, যেখানে মানবিক মূল্যবোধের নিতান্ত অভাব। কিন্তু বড় দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, তা সত্ত্বেও সমাজের সচেতন অংশ নড়েচড়ে বসছে না, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে নিতান্তই গতানুগতিক এবং তা তাৎপর্যপূর্ণ নয়, সমাজে পরিবর্তন আনার পক্ষে যথেষ্ট নয়।

কেন এমন অবস্থা? সমাজবিজ্ঞানী বা সমাজ সচেতন লেখক-বুদ্ধিজীবীদের মতে, প্রকৃত সুশাসন তথা দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালনে ঘাটতি- এসব অনাচার ও অপরাধপ্রবণতার অন্যতম প্রধান কারণ। একই সঙ্গে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিযুক্ত বাহিনীর প্রয়োজনীয় তৎপরতার অভাব ও দুর্নীতির মতো ঘটনাবলি, যা প্রতিকারহীন পরাভবে নিমজ্জিত। অংশত এ অভিযোগে সায় দিয়েছেন সাবেক শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা।

স্বভাবতই অপরাধ ভুবন উদ্দীপ্ত তাদের অপকর্ম লাগাতার পরিচালনায়। লক্ষ করার বিষয় যে খবরে প্রকাশ, নিষ্ঠুরভাবে শিশু রাজন হত্যার প্রধান আসামি কামরুল ইসলামকে যদিও বা আনার চেষ্টা চলছে, নারায়ণগঞ্জের পৈশাচিক সাত খুন মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেনকে ভারত থেকে ফেরত আনার বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি নেই।

অথচ মাঝখানে দীর্ঘ সময় কেটে গেছে। নূর হোসেন ভারতে বেশ বহাল তবিয়তে আছেন। আরো কয়েক বছর এভাবে কাটিয়ে দিতে পারলে চাই কি সব অপরাধ ধুলায় ঢাকা পড়ে যাবে। গত কয়েক মাসে সংঘটিত শিশুহত্যার ঘটনাগুলোর তদন্ত কেমন যেন থিতিয়ে পড়ছে, উদাসীনতার ধুলোবালিতে সব কিছু ঢাকা পড়ে যাবে না তো?

পরিস্থিতি বিচারে আমাদের প্রশ্ন, বাংলাদেশি সমাজের এ দূষিত অবস্থা কবে কাটবে, কিভাবে কাটতে পারে, তা নিয়ে ভাবনা ও প্রতিকারের ব্যবস্থা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি শুধু বিদেশে ভাবমূর্তিরই নয়, এখানে প্রশ্ন একটি সমাজের সুস্থ অস্তিত্ব রক্ষার। এ কাজে সমাজের আপাত সচেতন অংশ কবে মাথা তুলে দাঁড়াবে সেটাই বড় বিবেচ্য বিষয়। আজ যখন এ লেখাটি শেষ করছি তখনো পড়তে হচ্ছে একটি খবর, ‘হাত-পা বেঁধে ও ছ্যাঁকা দিয়ে শিশু নির্যাতন’! জানতে পারি, শিশু বা গৃহকর্মী নির্যাতন আর কতকাল চলবে?