ঢাকা ০২:২৫ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হাওরের গ্রামগঞ্জের সাদির মিয়ার সর্বনাশের দিনরাত্রি

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০৫:০৬:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অগাস্ট ২০১৭
  • ৩৪৬ বার

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েন সাদির মিয়া। মাছ ধরতে চলে যান হাওরে। কাজ শেষে বাড়িতে ফেরেন বেলা একটায়। দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার ছোটেন হাওরে। সেখান থেকে রাত ১০টায় বাড়িতে ফেরা। কাঁটায় কাঁটায় সময় গুনে এভাবে চলছে সাদিরের জীবন।
সাদিরের বয়স ৪০। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার উজান আওয়াজ গ্রামের বাসিন্দা তিনি। প্রায় দিনই কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে যখন বের হতে যান, তখন স্ত্রী মাজারন্নেসার কাছ থেকে শুনতে হয়, ঘরে চাল নেই, তেল নেই। মহাজনে টাকা নিতে এসেছিল। সমিতির কিস্তির টাকা যেন রেখে যায়।

সাদির মিয়া যেখানে বাস করেন, তা ‘আটি’ হিসেবে পরিচিত। আটির নাম ‘ভাঙা আটি’। আটি বলতে বোঝায় হাওরের বিপুল জলরাশির মধ্যে ছোট্ট একটু ভূখণ্ড। সেখানে ৫ থেকে ২০টি পরিবার বসবাস করে। বর্ষাকালে হাওরের ঢেউয়ে তাদের আটি প্রতিবছর একটু একটু করে ভাঙছে, তাই নাম হয়েছে ভাঙা আটি। অনেকের জমি থাকলেও সাদির মিয়ার কোনো জমি নেই। মামার জমিতে ঘর তুলে তাঁর বসবাস।

গেল মাঘ মাসে সাদির মিয়া আটির এক মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন ৭০ হাজার টাকা। মাসে সুদ গুনতে হবে সাত হাজার টাকা। দুটো এনজিওর কাছ থেকে নেন আরও ৪০ হাজার টাকা। সপ্তাহে কিস্তি ১ হাজার ১০০ টাকা। ‘ছায়ার হাওরে’ জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষের জন্য কেনেন বীজ, প্রস্তুত করেন বীজতলা। ছয় বিঘা জমিতে লাগান ধান। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ধান উঠলে মহাজনের টাকা শোধ দেবেন। ধীরে ধীরে ধানগাছ বড় হতে থাকে। শক্তপোক্ত সবুজ গাছগুলোয় কচি দানা আসে। সাদির স্বপ্ন দেখেন, ধান উঠলে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। রেহাই মিলবে সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দেওয়ার যন্ত্রণা থেকেও।

কদিন পরে যখন ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর সাদির মিয়া, ঠিক তখনই তাঁর খেত ডুবে যায় উজান থেকে নেমে আসা পানিতে। চোখের সামনে সাদির মিয়াকে দেখতে হয় তাঁর সর্বনাশ। তাঁর ঋণ শোধের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। এরপর থেকে শুরু হয়ে গেছে সাদির মিয়ার বড় কষ্টের, বড় বেদনার কঠিন এক দিনরাত্রির জীবন। যে জীবনে কোনো আনন্দ নেই, শুধুই কষ্ট। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ঋণ। জানেন না কীভাবে, কত দিনে এই টাকা তিনি শোধ দিতে পারবেন?

সাদির মিয়া-মাজারন্নেসা দম্পতির বিয়ে হয় ১৮ বছর আগে। তাঁদের ঘরে এখন ছয় সন্তান। সবার বড় ছেলে, নাম পাপু মিয়া। বয়স ১৬ বছর ৪ মাস। জীবনে কোনো দিন পড়েনি অ, আ, ক, খ। কোনো দিন ছড়া শুনে ঘুম পড়া হয়নি তার। নিষ্পাপ সুন্দর চেহারার ছেলেটি জন্মের পর থেকে শিখেছে, কী করে মাছ ধরতে হয়? মাছের জাল বুনতে হয়?

পাপুর পরেরজন পাপিয়া। ওর বয়স ১৫ বছর। স্কুলে যায়নি এই মেয়েটি কোনো দিন। কেবল ঘরে বসে জাল বোনো, মাকে গৃহস্থালির কাজে সহযোগিতা করাই তার কাজ। পাপিয়ার পরের জন আফিয়া। তার বয়স ১১ বছর। তার অবস্থাও পাপিয়ার মতো। একবার এক ভ্রাম্যমাণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আর যাওয়া হয়নি। আফিয়ার পরে মোরছালিন। বয়স সাত বছর। এরপর মোতালিব। বয়স পাঁচ বছর। এরপর জিসান। দেড় বছরের ছোট্ট শিশু মায়ের কোলে কোলে থাকে। আটখানা মুখ ফসলহারা সাদির মিয়াকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কীভাবে এতগুলো মানুষের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেবেন?

শাল্লা উপজেলার পুরোটাই হাওরের মধ্যে পড়েছে। তাই বর্ষাকালে হাওরজুড়ে কেবলই পানি। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই পানি। ঠিক সমুদ্রের মতো। শো শো করে ঢেউয়ের শব্দ। স্থানীয় লোকে ঢেউকে ‘আফাল’ বলে। একমাত্র ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়া এসব গ্রামে যাওয়ার রাস্তা নেই। বর্ষাকালে হাওরে মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। তাও নির্দিষ্ট এলাকায়। হাওরের ভেতরে মাছ ধরায় নিষেধ আছে। কেবল হাওরের তীরবর্তী (স্থানীয় ভাষায় ভাসান জল) এলাকায় মাছ ধরতে পারেন।

তবে শাল্লার ভাঙা আটির বাসিন্দা সাদির মিয়া হাওরে মাছ ধরছেন। কিন্তু তাঁর মতো অনেক জেলেরই ভাষ্য, এবার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা হাওরে পড়ে থেকেও ১০০ থেকে ২০০ টাকার মাছ মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো দিন পাওয়া যায়, আবার কোনো দিন খালি হাতে ফিরে আসতে হয়। এমন আয় দিয়ে কীভাবে চলবেন? চিন্তিত সাদির মিয়া শুনেছেন, সরকার থেকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ এর কোনো কিছুই তিনি পাননি। সাদির মিয়ার ভাষায়, ‘হাওরে ইবার মাছটাছ খুব কম। আবার জায়গায় জায়গায় মানা আছে। এক-দুশ টাকার মাছ পাই। চলমু কেমনে? সরকারের কোনো চালও পাইনি, টাকাও পাইনি।’

সাদির মিয়ার আটজনের সংসারে প্রতিদিন চাল লাগে চার কেজি। চালের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। প্রায় প্রতিদিন তাঁকে চাল কিনতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০ টাকার। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। মহাজনের সুদ মাসে সাত হাজার টাকা। এই খরচ কীভাবে মেটাবেন তিনি? তাঁর আয় মাত্র তিন হাজার থেকে ছয় হাজারের মধ্যে। তাই স্ত্রী-সন্তানদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে আবার নতুন করে ঋণে জড়িয়েছেন সাদির। ১০০ গ্রাম সয়াবিন তেল, ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ, ১০০ গ্রাম হলুদ—এমন করে বাজার-সদাই করতে হয়।

সাদির মিয়ার ভাষ্য, আর কত দিন এভাবে চলতে হবে? আর কত ঋণ করতে হবে? সাদির বললেন, ‘রেনের (ঋণ) যন্ত্রণা পাগল করে ফেলছে।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরের গ্রামগঞ্জের সাদির মিয়ার সর্বনাশের দিনরাত্রি

আপডেট টাইম : ০৫:০৬:২৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ৫ অগাস্ট ২০১৭

হাওর বার্তা ডেস্কঃ  রাত তিনটায় ঘুম থেকে উঠে পড়েন সাদির মিয়া। মাছ ধরতে চলে যান হাওরে। কাজ শেষে বাড়িতে ফেরেন বেলা একটায়। দুই ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে আবার ছোটেন হাওরে। সেখান থেকে রাত ১০টায় বাড়িতে ফেরা। কাঁটায় কাঁটায় সময় গুনে এভাবে চলছে সাদিরের জীবন।
সাদিরের বয়স ৪০। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার উজান আওয়াজ গ্রামের বাসিন্দা তিনি। প্রায় দিনই কাজের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে যখন বের হতে যান, তখন স্ত্রী মাজারন্নেসার কাছ থেকে শুনতে হয়, ঘরে চাল নেই, তেল নেই। মহাজনে টাকা নিতে এসেছিল। সমিতির কিস্তির টাকা যেন রেখে যায়।

সাদির মিয়া যেখানে বাস করেন, তা ‘আটি’ হিসেবে পরিচিত। আটির নাম ‘ভাঙা আটি’। আটি বলতে বোঝায় হাওরের বিপুল জলরাশির মধ্যে ছোট্ট একটু ভূখণ্ড। সেখানে ৫ থেকে ২০টি পরিবার বসবাস করে। বর্ষাকালে হাওরের ঢেউয়ে তাদের আটি প্রতিবছর একটু একটু করে ভাঙছে, তাই নাম হয়েছে ভাঙা আটি। অনেকের জমি থাকলেও সাদির মিয়ার কোনো জমি নেই। মামার জমিতে ঘর তুলে তাঁর বসবাস।

গেল মাঘ মাসে সাদির মিয়া আটির এক মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেন ৭০ হাজার টাকা। মাসে সুদ গুনতে হবে সাত হাজার টাকা। দুটো এনজিওর কাছ থেকে নেন আরও ৪০ হাজার টাকা। সপ্তাহে কিস্তি ১ হাজার ১০০ টাকা। ‘ছায়ার হাওরে’ জমি বর্গা নিয়ে ধান চাষের জন্য কেনেন বীজ, প্রস্তুত করেন বীজতলা। ছয় বিঘা জমিতে লাগান ধান। তাঁর স্বপ্ন ছিল, ধান উঠলে মহাজনের টাকা শোধ দেবেন। ধীরে ধীরে ধানগাছ বড় হতে থাকে। শক্তপোক্ত সবুজ গাছগুলোয় কচি দানা আসে। সাদির স্বপ্ন দেখেন, ধান উঠলে মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে পারবেন। রেহাই মিলবে সপ্তাহে সপ্তাহে কিস্তি দেওয়ার যন্ত্রণা থেকেও।

কদিন পরে যখন ধান ঘরে তোলার স্বপ্নে বিভোর সাদির মিয়া, ঠিক তখনই তাঁর খেত ডুবে যায় উজান থেকে নেমে আসা পানিতে। চোখের সামনে সাদির মিয়াকে দেখতে হয় তাঁর সর্বনাশ। তাঁর ঋণ শোধের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। এরপর থেকে শুরু হয়ে গেছে সাদির মিয়ার বড় কষ্টের, বড় বেদনার কঠিন এক দিনরাত্রির জীবন। যে জীবনে কোনো আনন্দ নেই, শুধুই কষ্ট। মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ১ লাখ ১০ হাজার টাকার ঋণ। জানেন না কীভাবে, কত দিনে এই টাকা তিনি শোধ দিতে পারবেন?

সাদির মিয়া-মাজারন্নেসা দম্পতির বিয়ে হয় ১৮ বছর আগে। তাঁদের ঘরে এখন ছয় সন্তান। সবার বড় ছেলে, নাম পাপু মিয়া। বয়স ১৬ বছর ৪ মাস। জীবনে কোনো দিন পড়েনি অ, আ, ক, খ। কোনো দিন ছড়া শুনে ঘুম পড়া হয়নি তার। নিষ্পাপ সুন্দর চেহারার ছেলেটি জন্মের পর থেকে শিখেছে, কী করে মাছ ধরতে হয়? মাছের জাল বুনতে হয়?

পাপুর পরেরজন পাপিয়া। ওর বয়স ১৫ বছর। স্কুলে যায়নি এই মেয়েটি কোনো দিন। কেবল ঘরে বসে জাল বোনো, মাকে গৃহস্থালির কাজে সহযোগিতা করাই তার কাজ। পাপিয়ার পরের জন আফিয়া। তার বয়স ১১ বছর। তার অবস্থাও পাপিয়ার মতো। একবার এক ভ্রাম্যমাণ স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর আর যাওয়া হয়নি। আফিয়ার পরে মোরছালিন। বয়স সাত বছর। এরপর মোতালিব। বয়স পাঁচ বছর। এরপর জিসান। দেড় বছরের ছোট্ট শিশু মায়ের কোলে কোলে থাকে। আটখানা মুখ ফসলহারা সাদির মিয়াকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। কীভাবে এতগুলো মানুষের মুখে তিনবেলা খাবার তুলে দেবেন?

শাল্লা উপজেলার পুরোটাই হাওরের মধ্যে পড়েছে। তাই বর্ষাকালে হাওরজুড়ে কেবলই পানি। যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই পানি। ঠিক সমুদ্রের মতো। শো শো করে ঢেউয়ের শব্দ। স্থানীয় লোকে ঢেউকে ‘আফাল’ বলে। একমাত্র ইঞ্জিনচালিত নৌকা ছাড়া এসব গ্রামে যাওয়ার রাস্তা নেই। বর্ষাকালে হাওরে মাছ ধরা ছাড়া আর কোনো কাজ থাকে না। তাও নির্দিষ্ট এলাকায়। হাওরের ভেতরে মাছ ধরায় নিষেধ আছে। কেবল হাওরের তীরবর্তী (স্থানীয় ভাষায় ভাসান জল) এলাকায় মাছ ধরতে পারেন।

তবে শাল্লার ভাঙা আটির বাসিন্দা সাদির মিয়া হাওরে মাছ ধরছেন। কিন্তু তাঁর মতো অনেক জেলেরই ভাষ্য, এবার দিনরাত ২৪ ঘণ্টা হাওরে পড়ে থেকেও ১০০ থেকে ২০০ টাকার মাছ মেলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। কোনো দিন পাওয়া যায়, আবার কোনো দিন খালি হাতে ফিরে আসতে হয়। এমন আয় দিয়ে কীভাবে চলবেন? চিন্তিত সাদির মিয়া শুনেছেন, সরকার থেকে প্রতি মাসে ৩০ কেজি চাল আর ৫০০ টাকা সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। অথচ এর কোনো কিছুই তিনি পাননি। সাদির মিয়ার ভাষায়, ‘হাওরে ইবার মাছটাছ খুব কম। আবার জায়গায় জায়গায় মানা আছে। এক-দুশ টাকার মাছ পাই। চলমু কেমনে? সরকারের কোনো চালও পাইনি, টাকাও পাইনি।’

সাদির মিয়ার আটজনের সংসারে প্রতিদিন চাল লাগে চার কেজি। চালের কেজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা। প্রায় প্রতিদিন তাঁকে চাল কিনতে হচ্ছে ১২০ থেকে ১৬০ টাকার। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ১০০ টাকা। মহাজনের সুদ মাসে সাত হাজার টাকা। এই খরচ কীভাবে মেটাবেন তিনি? তাঁর আয় মাত্র তিন হাজার থেকে ছয় হাজারের মধ্যে। তাই স্ত্রী-সন্তানদের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দিতে আবার নতুন করে ঋণে জড়িয়েছেন সাদির। ১০০ গ্রাম সয়াবিন তেল, ১০০ গ্রাম কাঁচামরিচ, ১০০ গ্রাম হলুদ—এমন করে বাজার-সদাই করতে হয়।

সাদির মিয়ার ভাষ্য, আর কত দিন এভাবে চলতে হবে? আর কত ঋণ করতে হবে? সাদির বললেন, ‘রেনের (ঋণ) যন্ত্রণা পাগল করে ফেলছে।