হাওর বার্তা ডেস্কঃ পাঁচ বছর আগের কথা। অভাব ছিল কামরুন নাহারের সংসারে নিত্যদিনের সঙ্গী। এখন শ্রাবণ ধারার মতোই সুখের ধারা বইছে তার সংসারে। একটি মাত্র সংকল্পই বদলে দেয় অজপাড়াগাঁয়ের এ গৃহবধূর জীবন। অভাব মুছে ফেলার দৃঢ় সংকল্প নিয়ে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কায়েতপাড়া ইউনিয়নের ইছাখালী গ্রামের বিল্লাল হোসেনের স্ত্রী কামরুন নাহার ‘ব্র্যাকের ইকোনমিক ইমপাওয়ারমেন্ট ফর পুওর অ্যান্ড ভলনারেবল উইমেন ইন বাংলাদেশ (ইইপি)’ প্রকল্পের অধীনে গবাদি পশু পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন গাভী পালন।
এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। পূরণ হয় তার স্বপ্ন। একটি গাভী দিয়ে যাত্রা শুরু করলেও বর্তমানে তার রয়েছে পাঁচটি দুধেল গাভী ও তিনটি বাছুর। আর গাভীর দুধ বিক্রির আয় দিয়ে পাকাবাড়ি তৈরিসহ কিনেছেন টেলিভিশন, সেলাই মেশিন, রেফ্রিজারেটরসহ দামি আসবাবপত্র। তিন সন্তান লেখাপাড়া করাচ্ছেন ভালো স্কুলে। দরিদ্র বাবার সংসারে অনেক কিছু থেকে বঞ্চিত কামরুন নাহার যখন জানতে পারলেন এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে- তখন এটা সেটা করবেন ভেবে কতই না রঙিন স্বপ্নে বিভোর থাকতেন এ পল্লীবালা।
বিয়ের প্রথম দিনেই তার দেখা স্বপ্ন ফানুস হয়ে উড়ে যায় যখন স্বামী বিল্লাল নববধূকে দুইটি মোটা কাপড় এনে দেয়া থেকে বঞ্চিত করেন। সংসার জীবনে প্রবেশ করে তিনি দেখেন তরকারির বড় ব্যবসায়ী তার স্বামী বিল্লাল হোসেনের সংসারের চারদিকে দাপাদাপি করছে অভাব।
ঋণের বোঝা নিয়ে লোকজন থেকে নিজেকে সারাক্ষণ আড়াল করে রাখে বিল্লাল। অভাবের কারণে সংসারেও লেগে থাকে ঝগড়াঝাটি। এরই মধ্যে জন্ম হতে থাকে একের পর এক সন্তান। বিয়ের মাত্র ৫ বছরের মাথায় যখন তিন সন্তানের মা হলেন তিনি, তখন সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় মুষড়ে পড়েন কামরুন নাহার। অভাব আর অপুষ্টিতে বেড়ে উঠা সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তায় পাগলপ্রায় মা কামরুন নাহারের ভেতরে জাগ্রত হয় ‘অভাব মুছে ফেলার’ দৃঢ় সংকল্প। এরপর থেকেই শ্রাবণ ধারার মতো তার সংসারে শুরু হয় সুখের বৃষ্টিপাত।
২০১২ সালে সাবিলা আফরোজ আর আতিক নামে দুই এনজিও কর্মীর পরামর্শ ও অনুপ্রেরণায় ব্র্যাকের ‘ইকোনমিক ইমপাওয়ারমেন্ট ফর পুওর অ্যান্ড ভলনারেবল উইমেন ইন বাংলাদেশ (ইইপি)’ প্রকল্পের অধীনে গবাদি পশু পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নেন কামরুন নাহার। এরপর ধারদেনা করে একটি গাভী কেনেন। সন্তানের মতোই পরম মমতা আর যত্ন দিয়ে শুরু করেন গাভী পালন। তার যত্নে গাভীটিও তাকে বঞ্চিত করল না। প্রত্যাশীত দুধ দেয়া শুরু করল নিয়মিত। মাত্র ১ বছর পরে ব্র্যাকের ইইপি প্রকল্পের অধীনে দরিদ্র নারী হিসেবে কমিউনিটি ইমপাওয়ারমেন্ট গ্রুপের সদস্যও নির্বাচিত হয়ে গেলেন কামরুন নাহার।
২০১৩ সালে ১ বছরের দুধ বিক্রির সঞ্চিত টাকা, কিছু এনজিও ঋণ আর কিছু ধারদেনা করে গড়ে তুলেন একটি খামার। সেখানে দুইটি অস্ট্রেলিয়া প্রজাতির দুধের গাভী লালন-পালন শুরু করেন তিনি। বছর ঘুরতেই দুইটি গাভী জন্ম দেয় দুইটি বাছুর। এতে তার খামারে গরুর সংখ্যা চারটি হয়ে যায়। আর দৈনিক ৪০ থেকে ৪৫ লিটার দুধ পাওয়া শুরু করেন তিনি। প্রতিদিন সব খরচ বাদে দুধ বিক্রি থেকে ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় হতে থাকে। এবার তিনি স্বামীকে প্রস্তাব দেন তরকারির ব্যবসা ছেড়ে তার সঙ্গে খামার দেখাশোনার জন্য। গরু পালনে লাভ দেখে স্বামী বিল্লালও অমত করলেন না আর। এরপর স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে শুরু করেন খামারের দেখাশোনা। বর্তমানে কামরুন নাহারের খামারে পাঁচটি দুধেল গাভী ও তিনটি বাছুর রয়েছে। এর সবই অস্ট্রেলিয়ান প্রজাতির। প্রতিদিন ৭০ থেকে ৮০ লিটার দুধ পাচ্ছেন কামরুন নাহার। মাসে আয় লাখ টাকার ঊর্ধ্বে। এর মধ্যে ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন’ প্রবাদ সত্য করেছেন কামরুন নাহার। ঋণমুক্ত হওয়ার পর আয়ের টাকা দিয়ে পাকাবাড়ি তৈরিসহ কেনেন টেলিভিশন, সেলাই মেশিন, রেফ্রিজারেটরসহ দামি সব আসবাবপত্র। তার তিন সন্তান লেখাপাড়া করে যাচ্ছেন ভালো স্কুলে। প্রাইভেট শিক্ষক বাড়ি এসে পড়াচ্ছেন সন্তানদের। অভাবের জন্য করতে হয় না ঝগড়া। সংসারে এখন কামরুন নাহারের মতামতের বেশ গুরুত্ব।