মধুমতি নদী থিকা বালু তুলায় যে ভাঙন শুরু হইছ, সেই কারণে আমরা অনেক বড় বিপদে আছি। নদী থিকা বালু তোলার কারণে আমাগো জমি আর সম্পত্তি সব নদীতে গেল। আমি অন্তত ১৫ থেকে ২০ একর হারাইছি, সেই জমি গুলো ছিল আমার বাপ-দাদার। অনেক বড় বড় গাছ ছিল, সেগুলো ও নদীতে চলে গেছে। এখন যে টুক আছে, সেটাও নদীর কূলে, সব সময় মনে হয় নদী কখন যে হেঁটে আসবে?’
গত মঙ্গলবার (২২ এপ্রিল) দুপুরে কথাগুলো বলছিলেন কাশিপুর ইউনিয়নের মাকড়াইল গ্রামের সত্তরোর্ধ্ব মতিউর রহমান। তার মত ওই এলাকার প্রায় শতাধিক পরিবার তাদের বাড়ি, ঘর,সম্পত্তি হারিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাকড়াইল রামচন্দ্রপুর ও নওখোলা গ্রামে কূল ঘেঁষে বয়ে চলা মধুমতি নদীতে পানি কম, ঢেউ নেই, তবুও নদীর ভাঙন থামছে না। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেওয়া বালুর বস্তাগুলো কিছু কিছু জায়গায় সরে গেছে। আবার কোথাও নষ্ট হয়ে গেছে। অধিকাংশ বালু বস্তা নদীতে তলিয়ে গেছে। যার ফলে পুরোনো বাঁধ ভেঙে গিয়ে নতুন করে নদীর তীর ভাঙছে। শুধু বাড়ি ঘর নয় মাকড়াইল গ্রামের নদীর তীরবর্তী ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি ও রয়েছে ঝুঁকিতে।
তাছাড়া আশপাশের আরও তিনটি স্কুল, মসজিদ, আশ্রয় প্রকল্পগুলো নদী ভাঙনের কবলে পড়েছে। প্রাচীন এই স্কুলটির কুল ঘেঁষে সামনে যেতেই চোখে পড়ে বৃদ্ধা শামসুন্নাহার বেগম (৬৫)। তার বাড়ির সামনে মধুমতী নদী থেকে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করা হয়। সেই বালু স্তূপ করে রাখা হয় শামসুন্নাহারের বাড়ির পেছনে। বালু উত্তোলন করায় বাড়ির সামনে থাকা বাঁধের বস্তা নেমে চলে যায় নদীর মাঝে। আর স্তূপ করে রাখা বালুর পানির টানে নদীগর্ভে গেছে শামসুন্নাহারের ভিটে-মাটি। শুধু তাই নয়, বাতাস শুরু হলেই বালুর স্তূপ থেকে বালু উড়ে ঘর ভরে যায় শামসুন্নাহারের।
এসময় শামসুন্নাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, বালু উঠানোর কারণে আমার বাড়ি ভাঙছে। আমি গরিব-অসহায়। অন্য কোথাও যে বাড়ি করব, আমার এক ফোঁটা জমি নেই। আমার স্বামী নাই, একটা ছেলে নাই, আছে চারটা মেয়ে। এখন আমি কোন উপায়ে কি করব? বৃষ্টি এলেই একেবারে সব ভেঙে চলে যাবে৷ এখন আমার যাওয়ারও কোনো জায়গা নাই।
স্থানীয়রা বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে বর্ষা মৌসুমে মধুমতী নদী ভাঙলে পানি উন্নয়ন বোর্ড গত কয়েক বছর কিছু স্থানে বালুর বস্তা ফেলে বাঁধ দেওয়ায় ভাঙন কিছুটা কমেছিল। কিন্তু ড্রেজার মেশিন বসিয়ে ইজারাকৃত এবং ইজারা বহির্ভূত বিভিন্ন স্থান থেকে বালু উত্তোলন করায় বাঁধের অনেকাংশ ভেঙে পানিতে নেমে গেছে। যার কারণে এ বছর অসময়ে ভাঙন শুরু হয়েছে।
মাকড়াইল গ্রামের লিপি বেগম বলেন, আমার এ গ্রামে বিয়ে হয়েছে ২৫ বছর। ২৫ বছরে তিন বার বাড়ি ভেঙেছে। তিনবার বাড়ি পাল্টাইছি। মধুমতি নদীর তীরে শ্বশুরের ৩ ফাঁকি জমি নদী গর্ভে চলে গেছে। এখনও আমরা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছি। আর আমাদের থাকা আর সম্ভব না। শেষ সম্বলটুকু ভেসে গেছে নদীতে।
কাশিপুর গ্রামের স্থানীয় দোকানদার পলাশ মোল্যা ঢাকা পোস্টকে বলেন, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের নিকট অভিযোগ দিলে ইজারা বহির্ভূত এলাকায় প্রশাসন বালু উত্তোলন বন্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া নতুন বছরে ওই এলাকার বালুমহলের ইজারাও বন্ধ করে দিয়েছে প্রশাসন। তবে আমরা চাই, এটি যেন স্থায়ী হয়। আর কোনোভাবেই যেন কেউ বালু উত্তোলন করে তাদের ক্ষতি করতে না পারে। বালু উত্তোলন বন্ধ হলেও, ভাঙন থেমে নেই। তাই ভাঙনকবলিত স্থানে স্থায়ী সমাধানের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণের ব্যবস্থা করা হোক।
এ বিষয়ে জানতে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী হিমায়েত হোসেন মোবাইল ফোনে বলেন, আমি ইজারা নিয়ে বালু কাটি। যে জায়গা থেকে বালু কাটি না, সেই জায়গাও তো নদী ভাঙন হচ্ছে। অহেতুক আমাকে দোষারোপ করা হচ্ছে।
নড়াইল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী অভিজিৎ কুমার সাহা বলেন, নিয়ম না মেনে বালু উত্তোলন করার কারণে নদী তীরে করা আমাদের প্রতিরক্ষা বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে নিয়ম বহির্ভূতভাবে বালু উত্তোলন ও ওই এলাকার বালুমহলগুলোর ইজারা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।