মাত্র ৯ মাসের যুদ্ধেই বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধে নতি স্বীকার করে। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সেনারা ছিল। কিন্তু চমকে দেওয়া পাঁচটি ঘটনায় পাক বাহিনী অনেকটা অসহায় হয়ে পড়ে।
ঘটনা-১
১৯৭১সালের ১১ ডিসেম্বর।
দুপুর। রাতে ভাল ঘুম হয়নি। একিটু ক্লান্তিভাব ছিল জেনারেল নিয়াজীর মধ্যে। সেই ক্লান্তিভাব চলে গেল যখনই আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন ঝাঁকে ঝাঁকে যুদ্ধ বিমান উড়ছে। উল্টোদিকে বসা অন্য পাক অফিসারকে তখন সামনের টেবিলে পড়ে থাকা ‘লন্ডন টাইমস’ নিউজ পেপারের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে বলেন,‘ ঘটনা তবে সত্যি হতে যাচ্ছে? আত্মসমর্পণ করাটাই ভাল। ’
বিভিন্ন পত্রিকায় আগেই প্যারাবিগ্রেড নামানোর ছবিটা প্রকাশিত হয়েছিল। গোটা আকাশ জুড়ে শয়ে শয়ে প্যারাসুট নেমে আসছে।
মেজর জেনারেল সুখওয়ন্ত সিং তাঁর বই ‘ইন্ডিয়াজ ওয়ারস সিন্স ইন্ডিডিপেন্ডেন্স’-এ লিখেছেন, ‘ সেই অন্য পাক অফিসার মোহাম্মদ জামসেদ আমাকে ৭৭ সালে এ কথা জানান। অথচ এ ছবিগুলো আমি আগেই তুলেছিলাম পাকবাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে। সেই ছবি বিভিন্ন মিডিয়ায়ও পাঠানো হয়েছিল। আসলে সেদিন টাঙ্গাইলের মাটিতে মাত্র ৫৪০ জন ভারতীয় সেনা নেমেছিল ‘।
ইন্ডিয়া স্ট্র্যাটেজিক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি লেখায় গুলশন লুথরা জানান, “১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের মাটিতে নেমেছিল মাত্র ৫৪০ জন ভারতীয় সেনা। কিন্তু নিয়াজি এমন ছবি দেখে ভয় পান।
ঘটনা-২
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর। সময় আনুমানিক সকাল নয়টা। ঢাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানের ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করছিলেন। সে সময় একটি চিরকুট এলো। বৈঠকে ছিলেন লেফট্যানেন্ট জেনারেল একে নিয়াজী, মেজর জেনারেল জামশেদ, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, রিয়ার এডমিরাল শরিফ, ব্রিগেডিয়ার বকর সিদ্দিকী, সিদ্দিক সালিক এবং আরো কয়েকজন।
সেই চিরকুটে লেখা ছিল, ” প্রিয় আবদুল্লাহ, আমি এখন মিরপুর ব্রিজে। আপনার প্রতিনিধি পাঠান। “
এখানে ‘আব্দুল্লাহ’ বলতে জেনারেল নিয়াজীকে বোঝানো হয়েছিল।
নিয়াজীর পুরো নাম আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, যিনি একে নিয়াজি হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
এ চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল গন্দর্ভ সিং নাগরা।
সকাল আটটা নাগাদ ঢাকার মিরপুর ব্রিজের কাছে মেজর জেনারেল নাগরাকে বহনকারী একটি সামরিক জিপ এসে থামে। জেনারেল নাগরা কিভাবে ঢাকার প্রবেশ-মুখে এসে পৌঁছলেন সেটি সবাইকে অবাক করেছিল।
রাও ফরমান আলী তখন নিয়াজির কাছে এ চিরকুট যুদ্ধবিরতির ঘোষণা সম্পর্কিত কিনা জানতে চাইলে নিয়াজি নিশ্চুপ থাকেন।
এ তথ্য পাওয়া যায় সেই বেঠকে উপস্থিত থাকা সিদ্দিক সালিকের লেখা ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইতে।
ঘটনা-৩
মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর “হাউ পাকিস্তান গট ডিভাইডেড” বইয়ে রয়েছে, ” আমি নিয়াজিকে প্রশ্ন করলাম, আপনার প্রতিরক্ষা শক্তি কতটুকু আছে? কিন্তু মি. নিয়াজি সে প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে নীরব থাকলেন। ”
এ প্রসঙ্গে এডমিরাল শরিফ পাঞ্জাবি ভাষায় জেনারেল নিয়াজিকে প্রশ্ন করলেন, “আপনার কি কিছু রয়েছে?”
এরপর নিয়াজী মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন। জেনারেল জামশেদের দায়িত্ব ছিল ঢাকা রক্ষা করা।
জেনারেল নিয়াজী যখন মেজর জেনারেল জামশেদের দিকে তাকালেন তখন তিনি মাথা ঘুরিয়ে ‘না’ সূচক জবাব দিলেন।
‘এরপর জেনারেল নাগরাকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠানো হলো।
একই সাথে মিরপুর ব্রিজের কাছে অবস্থানরত পাকিস্তানী সৈন্যদের বলা হলো তারা যেন যুদ্ধবিরতি মেনে চলে এবং জেনারেল নাগরাকে নিরাপদে শহরে ঢুকতে দেয়।
ঘটনা-৪
রাও ফরমান আলী খান তার বইতে জানিয়েছেন, ” জেনারেল নিয়াজি তার চেয়ারে বসে আছেন, তার সামনে জেনারেল নাগরা রয়েছেন এবং একজন জেনারেলের পোশাকে রয়েছেন মুক্তিবাহিনীর টাইগার সিদ্দিকীও (কাদের সিদ্দিকী)। শুনলাম নিয়াজি নাগরাকে জিজ্ঞেস করছেন তিনি উর্দু কবিতা বোঝেন কিনা। জবাবে নাগরা জানালেন যে তিনি লাহোর সরকারি কলেজ থেকে ফার্সিতে এম.এ পাশ করেছেন। নাগরা যেহেতু নিয়াজির চেয়ে বেশি শিক্ষিত ছিলেন, নিয়াজি তাই পাঞ্জাবিতে রসিকতা শুরু করলেন। নিয়াজী তার আগের চরিত্রে ফিরে গেলেন। ”
ঘটনা-৫
জে আর জ্যাকবের বইয়ের নাম, ‘সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব এ নেশন’’। এ বইয়ের সূত্রে জানা যায়, ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের জেনারেল জে আর জ্যাকব ঢাকায় অবতরণ করেছেন। তিনি সাথে এনেছেন আত্মসমর্পণের দলিল। দলিলে বলা ছিল “ভারতীয় যৌথ কমান্ড এবং বাংলাদেশ বাহিনীর” কাছে আত্মসমর্পণ করছে পাকিস্তান বাহিনী।
বাংলাদেশ শব্দটি রাখতে চায়নি পাকিস্তানী বাহিনী। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব বললেন, ” দিল্লী থেকে বিষয়টি এভাবেই এসেছে। ”
তখন জেনারেল জ্যাকবের পাশে দাঁড়ানো ছিলেন ভারতীয় সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্নেল খেরা।
জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণের শর্তযুক্ত কাগজটি একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন, কিন্তু কোন কথা বললেন না।
দুপুরের পর জেনারেল নিয়াজি ঢাকা বিমানবন্দরে গেলেন ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার জগজিৎ সিং অরোরাকে অভ্যর্থনা জানাতে। মি: অরোরা তখন তাঁর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে এসেছিলেন। ততক্ষণে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছিল।