আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় যত কাছে আসছে, জাতীয় পার্টির (জাপা) অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব তত ঘনীভূত হচ্ছে। নির্বাচনের জন্য চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় দলটিতে দ্বন্দ্ব আরও বেশি দৃশ্যমান হচ্ছে। কার সইয়ে জাপার মনোনয়নপত্র জমা দেওয়া হবে এবং জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা- এ বিষয়ে গতকাল শনিবার দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ এবং দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ঘনিষ্ঠ মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্ন আলাদাভাবে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, চিঠিতে দুই পক্ষের ভিন্ন অবস্থানের কারণে সামনের দিনগুলোতে দলের অভ্যন্তরীণ জটিলতা আরও বাড়তে পারে।
অন্যদিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় পার্টিকে ১০০ আসন, ১০ জন মন্ত্রী এবং দলের দুর্গখ্যাত রংপুরের ২২টি আসন ছেড়ে দিতে হবে বলে শর্ত জুড়ে দিয়েছেন রংপুর সিটি করপোরেশন মেয়র ও জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। তিনি স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে বৈঠককালে এ কথা বলেন। দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের দাবির মুখে তিনি এ কথা বলেন। এ অবস্থায় দলটির নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিব্রত জাপার নেতারা।
জানা গেছে, গতকাল জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদের চিঠি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন কমিশনে জমা দেন বিরোধী দলীয় নেতার মুখপাত্র কাজী মামুনূর রশিদ। চিঠিতে রওশন এরশাদ বলেন, গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছে জাতীয় পার্টি। সেই ধারাবাহিকতায় আসন্ন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে দলটি। পার্টির নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা দলীয় সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবেন।
দলীয় প্রতীক লাঙল ছাড়াও ভোটে অংশ নেওয়ার কথা জানিয়ে রওশন এরশাদ আরও জানান, এই নির্বাচনে জাতীয় পার্টির মনোনীত প্রার্থীরা দলীয় প্রতীক ‘লাঙল’ কিংবা প্রার্থীর ইচ্ছানুসারে মহাজোটে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করতে পারবেন। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিইসির প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
অন্যদিকে একই দিন সিইসিকে লেখা আরেকটি চিঠিতে জাতীয় পার্টির ভোটে আসার বিষয়টি জানানো হয়েছে। দলটির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নুর সই করা চিঠিটি ই-মেইলে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বরাবর পাঠানো হয়। চিঠিতে চুন্নু উল্লেখ করেন, গত বৃহস্পতিবার ইসির উপসচিব মো. মাহবুব আলম শাহ স্বাক্ষরিত একটি ইমেইল পেয়েছি। সেই ইমেইলের আলোকে আপনাকে জানানো যাচ্ছে যে, জাতীয় পার্টির (নিবন্ধন নং-১২) পক্ষ থেকে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানের ক্ষেত্রে আরওপিও অনুযায়ী সংসদ সদস্য পদে রাজনৈতিক দলের মনোনীত প্রার্থী নির্বাচনে জাতীয় পার্টির ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি হিসেবে দলের প্রার্থী মনোনয়ন ও প্রতীক বরাদ্দ করবেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি।
এর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে নানা সমীকরণ তৈরির প্রেক্ষাপটে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ নির্বাচন বর্জন করেন। অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টির একটি অংশ নির্বাচনে অংশ নেয় এবং জাপা থেকে ৩৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হন রওশন এরশাদ। উপনেতা হন জিএম কাদের। ওই নির্বাচনের আগে এরশাদের রহস্যজনক অসুস্থতা ও সিএমএইচে ভর্তি থাকা নিয়ে সারাদেশে আলোচনার সৃষ্টি হয়। পরে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে যান শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
২০১৮ সালের নির্বাচন সামনে রেখে ২০১৬ সালে জিএম কাদেরকে কো- চেয়ারম্যান করা নিয়ে বেশ সংকটে পড়ে জাতীয় পার্টি। একপর্যায়ে রওশনকে সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান করে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এরশাদ। পরে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা হন হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। উপনেতা বানান ছোট ভাই জিএম কাদেরকে। এর কিছুদিন পরই জিএম কাদেরকে সরিয়ে পুনরায় উপনেতা বানান স্ত্রী রওশন এরশাদকে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর জিএম কাদের দলের চেয়ারম্যান হন; কিন্তু রওশনের সঙ্গে তার বিরোধ মেটেনি।
পরে ২০২২ সালের ৩১ আগস্ট হঠাৎ করেই এক চিঠিতে দলের কাউন্সিল আহ্বান করেন রওশন। তখন জিএম কাদেরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই পদক্ষেপ ‘অবৈধ’, কারণ, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিল আহ্বানের ক্ষমতা আছে কেবল চেয়ারম্যানের। এর পর জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে আদালতেও মামলা করা হয়। দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের মধ্যে ২০২২ সালের ১৩ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির দুই নেতা একসঙ্গে গিয়ে দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। ওই সময় দুই পক্ষের মধ্যে সমঝোতার কথাও জানা যায়। এ ছাড়া গত বছরের ১ সেপ্টেম্বরে রওশনকে বাদ দিয়ে জিএম কাদেরকে সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা করা নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
দলটির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু আমাদের সময়কে বলেন, ‘নির্বাচনে কে যাবে কে যাবে না- এনিয়ে সিদ্ধান্ত জানতে অনেক নেতাকর্মী আমাদের অফিসে দিনভর আসছে। একটা উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করছে।’ ইসিতে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হলে সেটা উপনির্বাচনও যদি হয় তা হলে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলকে জানাতে হয় কীভাবে কোন প্রতীকে নির্বাচন করব, কার স্বাক্ষরে মনোনয়ন হবে। তবে এখনো নির্বাচনে যাওয়া ও না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেইনি। আমরা নির্বাচনের প্রাথমিক কাজগুলো করে রাখছিমাত্র।’
তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের যে পরিবেশ থাকা দরকার তা আমরা দেখছি না। আমরা আশা করেছিলাম একটা আলোচনা হবে। বিএনপি তফসিল প্রত্যাখান করেছে। আওয়ামী লীগ আলোচনা হবে না বলে দিয়েছে। তবু আমরা মনে করি আলোচনার সময় আছে এবং হবে। কারণ রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের জোটে বা মহাজোটে যাওয়ার পরিকল্পনা নেই। এ বিষয়ে কোনো চিঠিও দেইনি।’