ঢাকা ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্রি-২৮ জাতের ধান কেন বাতিলের চেষ্টা চলছে

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ০১:২৫:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩
  • ১১২ বার

বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওর এলাকার কৃষক কয়েস মিয়াসহ স্থানীয় কয়েকজন কৃষক এ বছর ১২ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করেন।

ধান যখন পাকতে শুরু করছে তখন তারা লক্ষ্য করেন ব্লাস্ট রোগ বা চিটা পড়ে ৯০ শতাংশ দানা নষ্ট হয়ে গেেেছ।

এতে লাভ তো দূরের কথা, ধানের আবাদের খরচ তোলা নিয়েই তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাকি ভালো ধানগুলো কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ তোলার অবস্থাও নেই।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নষ্ট হওয়া ধানগুলো জমিতেই ফেলে রেখেছেন কৃষকরা। অনেকে গবাদি পশুকে খাওয়াতে কেটে নিচ্ছেন।

‘আমি ঋণ করে চাষ করেছি। চোখের সামনে সব নষ্ট হয়ে গেল। ধানের ভেতরে কোনও চাল নেই, এখন আমি ঋণ শোধ করবো কীভাবে, খরচ তুলব কীভাবে, খাব কী। ধান কাটার টাকাও নাই। আমরা তো পথে বসে গেলাম,’ আক্ষেপ করেন কয়েস মিয়া।

ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করে একই ধরনের বিপাকে পড়েছেন দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কৃষক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, ব্রি-২৮ আবাদ করা জমিতে চিটা পড়ায় মোট ফসলের ৪০% থেকে ৯০% শতাংশ ধানের শীষে কোন চাল পাওয়া যায়নি।

ফলনে এমন বিপর্যয়ের কারণে বড় লোকসানের দুশ্চিন্তায় এখন মাথায় হাত কৃষকদের।

এর কারণ হিসেবে ধান গবেষকরা বলছেন, ব্রি-২৮ জাত একসময় বেশ জনপ্রিয় হলেও এখন এই ধানের বয়স প্রায় ৩০ বছর হয়ে যাওয়ায় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর আগের অবস্থায় নেই।

এ কারণে এটি অল্পতেই রোগ বালাইয়ের আক্রমণের মুখে পড়ছে। সেইসাথে ফলনও কমে গিয়েছে।

এমন অবস্থায় এই ধানটি চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে বিকল্প আধুনিক জাতের ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।

এর মধ্যে রয়েছে, ব্রি-৬৭, ব্রি-৭৪, ব্রি-৮৪, ব্রি-৮৬, ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৯৬ এবং বঙ্গবন্ধু-১০০।

এসব নতুন জাতের ধানের ফলন ভালো হবে এবং কৃষকরাও লাভবান হবেন, বলছেন কৃষি গবেষকরা।

এদিকে ব্লাস্টে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি মূল উৎপাদনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক।

এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার কোনো ঝুঁকি নেই বলে তিনি মনে করেন।

ব্রি-২৮ কেন ব্লাস্টে আক্রান্ত
ব্লাস্টে আক্রান্ত ধানের চারাগুলো ছবিতে দেখতে পাকা ধানের মতো মনে হলেও বাস্তবে অধিকাংশ ধান সম্পূর্ণ শুকিয়ে চিটা হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু জমিতে ধানের শিষ ভেঙে যায়।

ব্লাস্ট হল ধানের শিষ ও পাতায় এক ধরণের ছত্রাকজনিত রোগ। এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে পুরনো জাতের ধানগুলো।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী ব্রি-২৮ হলো বোরো মৌসুমের একটি আগাম জাতের ধান। যা চাষাবাদের অনুমোদন পায় ১৯৯৪ সালে।

ইতোমধ্যে ধানটির বয়স ২৯ বছর হয়ে যাওয়ায় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর আগের মতো নেই, ফলে ব্লাস্টের জীবাণু এই পুরনো জাতকে দ্রুত আক্রান্ত করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল লতিফ

তিনি বলেন, ‘কোন ধান পুরনো হয়ে গেলে এর আগের বৈশিষ্ট্য আর থাকে না, ক্ষয় হতে থাকে। মাটির বিভিন্ন রোগ ফসলটিকে চিনে ফেলায় সহজেই আক্রমণ করে ফেলে। ব্লাস্ট জীবাণু এতদিনে ব্রি-২৮ জাতের রোগ প্রতিরোধী জিনকে চিনে ফেলেছে। এ কারণে স্পর্শকাতর এই জাতে রোগবালাই বেশি দেখা দেয়।’

অথচ এই ধানের জাতটি আগের যেকোনো জাতের তুলনায় অল্প সময়ে অধিক ফলন এবং আগাম উৎপাদনের কারণে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, এই ধানটির জীবনকাল ১৪০ দিন এবং স্বাভাবিক ফলন হেক্টর প্রতি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টন।

আগাম ফলানো যায় বলে বন্যা-প্রবণ এলাকায় যেখানে পাকা ধান পানিতে তলিয়ে থাকে সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি বিশেষভাবে উপযোগী।

এ ছাড়া অসচ্ছল কৃষক যারা আগাম ফসল কাটতে চান তারাও ব্যাপক ব্রি-২৮ রোপণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই সাথে চাল মাঝারি, চিকন হওয়ায় ভাত সাদা, ঝর ঝরে ও খেতে সুস্বাদু হয়।

তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় সেইসাথে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ব্রি-২৮ জাতে রোগটি বেশি হারে ছড়িয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের।

প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাব
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল লতিফের মতে, ব্রি-২৮ এর জন্য অনুকূল তাপমাত্রা হল ২৬ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। এছাড়া আর্দ্রতা ৮০% বা এর আশেপাশে থাকলে ভালো।

এর তারতম্য হলে ব্লাস্টের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

লতিফ বলেন, ‘অতিরিক্ত রোদ-গরম, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, দিনে ও রাতে তাপমাত্রার তারতম্য বেশি হলে, আর্দ্রতার ভারসাম্যহীনতা, ধানে শীষ আসার সময় অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টি হলে এমনকি অতিরিক্ত শিশিরপাতের কারণে ব্লাস্ট দেখা দিতে পারে। কারণ বৃষ্টি বা শিশির বাতাসে ভাসতে থাকা ব্লাস্টের স্পোরগুলোকে নিচে নামিয়ে আনে।’

অনেক কৃষক আগাম ফলনের আশায় এই ধানটি মৌসুমের আগেই বিশেষ করে ঠান্ডার মৌসুমে চাষাবাদ করেছে যা ব্লাস্ট হওয়ার আরেকটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘অনেকে যদি বেশি আগে ধান লাগিয়ে ফেলে যেমন নভেম্বরের দিকে। তখন এর ফলন হয় ঠান্ডার সময়, এতে চিটা পড়ে যায়। এবারে আগাম ফলনের সময় তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। এর কারণেও কিছু চিটা হতে পারে।’

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পুরনো জাতের ধানে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

অন্যান্য যে কারণ
এই ধানের ফলন আগের চাইতে অনেক কমে গেলেও হাওর এলাকাসহ কিছু কিছু অঞ্চলের কৃষকরা এখনও তাদের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে থাকে।

পুরনো জাতের বীজগুলো ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় বীজেই জীবাণু বাসা বাধার ঝুঁকি তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন লতিফ।

তিনি বলেন, ‘সঠিক সময়মতো সঠিক উপায় বীজ সংরক্ষণ না করলে এসব বীজে ব্লাস্টের জীবাণু প্রবেশ করে, আর্দ্রতা ১২% এর চেয়ে বেড়ে যায়। ফলে সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে বলে তিনি জানান।’

সেই সাথে পটাশিয়ামের পরিবর্তে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করাও এই রোগের বড় কারণ।

একবার এই রোগ হলে প্রতিকারের কোন উপায় থাকে না তাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তারা কৃষকদের বার বার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ নিলেও তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি বলে দাবি করেন লতিফ।

তিনি বলেন, ‘একবার ধানে ব্লাস্ট দেখা দিলে করার কিছু থাকে না। এজন্য আমরা বারবার অনুরোধ করেছি তাঁরা যেন ব্রি-২৮ জাতের ধানবীজ রোপণ না করেন। তারপরও অনেক কৃষক ফলনের আশায় রোপণ করেছেন। আমরা কৃষকদের ধানের শীষ বের হওয়ার সময় দুই রাউন্ডে ছত্রাকনাশক দিতে বলেছি। সেটাও শোনেনি। পটাশিয়ামের বদলে বেশি করে ইউরিয়া সার দিয়েছে। তাদের নিজেদের ভুলেই ব্লাস্ট রোগ হয়েছে।

চলতি বছরের আবহাওয়া ব্লাস্টের জন্য অনুকূল ছিল। এজন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে ৬৪টি জেলার উপ পরিচালকদের লিখিতভাবে সতর্ক করা হলেও কৃষকরা তা শোনেনি বলে জানিয়েছেন লতিফ।

কৃষদের এই না শোনার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, প্রত্যেক বছর তো আর ব্লাস্ট হয় না। এ কারণে তারা ঝুঁকি নিতে চায়।

তার মতে, আবাহাওয়া ভালো থাকলে এর ফলন এখনও ভালো হয়। এজন্য কৃষকরা বারবার ঝুঁকি নেয়।

এদিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্রি-২৮ এর ফলনে কয়েক দফায় পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, কয়েক দফায় কীটনাশক প্রয়োগ, মাটির শুষ্কতা, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফলনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে

ব্রি-২৮ জাতকে প্রতিস্থাপন
কৃষকরা যাতে চিটা হয়ে পড়ার ঝুকিতে পড়া ব্রি-২৮ ধান আর চাষ না করে এ জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এই ধান দ্রুত তুলে নিয়ে চাষিদের অন্য জাতের ধান চাষ করতে বলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।

রোববার সচিবালয়ে বোরো ধান নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘সব জাতই দীর্ঘদিন চাষ করলে গুণাগুণ কমে যায়, বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় আক্রমণ প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনেক জায়গায়ই চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত ব্রি-২৮ মাঠ থেকে তুলে নিতে। কৃষকরা যাতে এ ধান আর চাষ না করেন, সে জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করছি। তাদের অন্য জাত চাষ করতে বলছি। নতুন জাতগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। কৃষকের কাছে যাওয়া দরকার।’

ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে আধুনিক বালাই সহিষ্ণু ধানগুলোর প্রচলন ঘটানোর কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ক্রপস উইং এর পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ।

গত পাঁচ বছর ধরে এ সংক্রান্ত প্রচারণা চলছে বলে তিনি জানান।

‘আমরা এখন আধুনিক জাতগুলো প্রদর্শনী ও প্রচারণার মাধ্যমে এবং কৃষকদের দিয়ে দিয়ে এর সম্প্রসারণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এভাবে ধীরে ধীরে ব্রি-২৮ অপসারণ করা হবে।’

তিনি জানান, ব্লাস্ট প্রতিবছর কম-বেশি হলেও নতুন জাতে এই রোগ এতো সহজে ছড়াতে পারে না।

তবে কৃষকদের কাছে এখনও এই ধানের বীজ সংরক্ষিত থাকায় বার বার নিষেধ করেও এর চাষ ঠেকানো যাবে কিনা সেটা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলাদেশের জনপ্রিয় ব্রি-২৮ জাতের ধান কেন বাতিলের চেষ্টা চলছে

আপডেট টাইম : ০১:২৫:৪০ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৪ মে ২০২৩

বাংলাদেশের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওর এলাকার কৃষক কয়েস মিয়াসহ স্থানীয় কয়েকজন কৃষক এ বছর ১২ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করেন।

ধান যখন পাকতে শুরু করছে তখন তারা লক্ষ্য করেন ব্লাস্ট রোগ বা চিটা পড়ে ৯০ শতাংশ দানা নষ্ট হয়ে গেেেছ।

এতে লাভ তো দূরের কথা, ধানের আবাদের খরচ তোলা নিয়েই তারা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। বাকি ভালো ধানগুলো কাটা ও মাড়াইয়ের খরচ তোলার অবস্থাও নেই।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নষ্ট হওয়া ধানগুলো জমিতেই ফেলে রেখেছেন কৃষকরা। অনেকে গবাদি পশুকে খাওয়াতে কেটে নিচ্ছেন।

‘আমি ঋণ করে চাষ করেছি। চোখের সামনে সব নষ্ট হয়ে গেল। ধানের ভেতরে কোনও চাল নেই, এখন আমি ঋণ শোধ করবো কীভাবে, খরচ তুলব কীভাবে, খাব কী। ধান কাটার টাকাও নাই। আমরা তো পথে বসে গেলাম,’ আক্ষেপ করেন কয়েস মিয়া।

ব্রি-২৮ জাতের ধান চাষ করে একই ধরনের বিপাকে পড়েছেন দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কৃষক।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর বলছে, ব্রি-২৮ আবাদ করা জমিতে চিটা পড়ায় মোট ফসলের ৪০% থেকে ৯০% শতাংশ ধানের শীষে কোন চাল পাওয়া যায়নি।

ফলনে এমন বিপর্যয়ের কারণে বড় লোকসানের দুশ্চিন্তায় এখন মাথায় হাত কৃষকদের।

এর কারণ হিসেবে ধান গবেষকরা বলছেন, ব্রি-২৮ জাত একসময় বেশ জনপ্রিয় হলেও এখন এই ধানের বয়স প্রায় ৩০ বছর হয়ে যাওয়ায় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর আগের অবস্থায় নেই।

এ কারণে এটি অল্পতেই রোগ বালাইয়ের আক্রমণের মুখে পড়ছে। সেইসাথে ফলনও কমে গিয়েছে।

এমন অবস্থায় এই ধানটি চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করে বিকল্প আধুনিক জাতের ধান চাষের পরামর্শ দিয়েছেন গবেষকরা।

এর মধ্যে রয়েছে, ব্রি-৬৭, ব্রি-৭৪, ব্রি-৮৪, ব্রি-৮৬, ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯, ব্রি-৯২, ব্রি-৯৬ এবং বঙ্গবন্ধু-১০০।

এসব নতুন জাতের ধানের ফলন ভালো হবে এবং কৃষকরাও লাভবান হবেন, বলছেন কৃষি গবেষকরা।

এদিকে ব্লাস্টে যে পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটি মূল উৎপাদনে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে না বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক।

এ কারণে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ার কোনো ঝুঁকি নেই বলে তিনি মনে করেন।

ব্রি-২৮ কেন ব্লাস্টে আক্রান্ত
ব্লাস্টে আক্রান্ত ধানের চারাগুলো ছবিতে দেখতে পাকা ধানের মতো মনে হলেও বাস্তবে অধিকাংশ ধান সম্পূর্ণ শুকিয়ে চিটা হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু জমিতে ধানের শিষ ভেঙে যায়।

ব্লাস্ট হল ধানের শিষ ও পাতায় এক ধরণের ছত্রাকজনিত রোগ। এই রোগে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে পুরনো জাতের ধানগুলো।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী ব্রি-২৮ হলো বোরো মৌসুমের একটি আগাম জাতের ধান। যা চাষাবাদের অনুমোদন পায় ১৯৯৪ সালে।

ইতোমধ্যে ধানটির বয়স ২৯ বছর হয়ে যাওয়ায় এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা আর আগের মতো নেই, ফলে ব্লাস্টের জীবাণু এই পুরনো জাতকে দ্রুত আক্রান্ত করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল লতিফ

তিনি বলেন, ‘কোন ধান পুরনো হয়ে গেলে এর আগের বৈশিষ্ট্য আর থাকে না, ক্ষয় হতে থাকে। মাটির বিভিন্ন রোগ ফসলটিকে চিনে ফেলায় সহজেই আক্রমণ করে ফেলে। ব্লাস্ট জীবাণু এতদিনে ব্রি-২৮ জাতের রোগ প্রতিরোধী জিনকে চিনে ফেলেছে। এ কারণে স্পর্শকাতর এই জাতে রোগবালাই বেশি দেখা দেয়।’

অথচ এই ধানের জাতটি আগের যেকোনো জাতের তুলনায় অল্প সময়ে অধিক ফলন এবং আগাম উৎপাদনের কারণে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।

কৃষি তথ্য সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, এই ধানটির জীবনকাল ১৪০ দিন এবং স্বাভাবিক ফলন হেক্টর প্রতি সাড়ে পাঁচ থেকে ছয় টন।

আগাম ফলানো যায় বলে বন্যা-প্রবণ এলাকায় যেখানে পাকা ধান পানিতে তলিয়ে থাকে সেসব এলাকার জন্য এ জাতটি বিশেষভাবে উপযোগী।

এ ছাড়া অসচ্ছল কৃষক যারা আগাম ফসল কাটতে চান তারাও ব্যাপক ব্রি-২৮ রোপণের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সেই সাথে চাল মাঝারি, চিকন হওয়ায় ভাত সাদা, ঝর ঝরে ও খেতে সুস্বাদু হয়।

তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় সেইসাথে প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ব্রি-২৮ জাতে রোগটি বেশি হারে ছড়িয়েছে বলে ধারণা গবেষকদের।

প্রতিকূল আবহাওয়ার প্রভাব
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আবদুল লতিফের মতে, ব্রি-২৮ এর জন্য অনুকূল তাপমাত্রা হল ২৬ থেকে ৩২ ডিগ্রী সেলসিয়াসের মধ্যে। এছাড়া আর্দ্রতা ৮০% বা এর আশেপাশে থাকলে ভালো।

এর তারতম্য হলে ব্লাস্টের ঝুঁকি বেড়ে যায়।

লতিফ বলেন, ‘অতিরিক্ত রোদ-গরম, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা, দিনে ও রাতে তাপমাত্রার তারতম্য বেশি হলে, আর্দ্রতার ভারসাম্যহীনতা, ধানে শীষ আসার সময় অর্থাৎ এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বৃষ্টি হলে এমনকি অতিরিক্ত শিশিরপাতের কারণে ব্লাস্ট দেখা দিতে পারে। কারণ বৃষ্টি বা শিশির বাতাসে ভাসতে থাকা ব্লাস্টের স্পোরগুলোকে নিচে নামিয়ে আনে।’

অনেক কৃষক আগাম ফলনের আশায় এই ধানটি মৌসুমের আগেই বিশেষ করে ঠান্ডার মৌসুমে চাষাবাদ করেছে যা ব্লাস্ট হওয়ার আরেকটি বড় কারণ বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, ‘অনেকে যদি বেশি আগে ধান লাগিয়ে ফেলে যেমন নভেম্বরের দিকে। তখন এর ফলন হয় ঠান্ডার সময়, এতে চিটা পড়ে যায়। এবারে আগাম ফলনের সময় তাপমাত্রা অনেক বেশি ছিল। এর কারণেও কিছু চিটা হতে পারে।’

আবার জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে পুরনো জাতের ধানে কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি জানিয়েছেন।

অন্যান্য যে কারণ
এই ধানের ফলন আগের চাইতে অনেক কমে গেলেও হাওর এলাকাসহ কিছু কিছু অঞ্চলের কৃষকরা এখনও তাদের সংরক্ষিত বীজ দিয়ে চাষাবাদ করে থাকে।

পুরনো জাতের বীজগুলো ঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় বীজেই জীবাণু বাসা বাধার ঝুঁকি তৈরি হয় বলে জানিয়েছেন লতিফ।

তিনি বলেন, ‘সঠিক সময়মতো সঠিক উপায় বীজ সংরক্ষণ না করলে এসব বীজে ব্লাস্টের জীবাণু প্রবেশ করে, আর্দ্রতা ১২% এর চেয়ে বেড়ে যায়। ফলে সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে বলে তিনি জানান।’

সেই সাথে পটাশিয়ামের পরিবর্তে বেশি বেশি ইউরিয়া সার ব্যবহার করাও এই রোগের বড় কারণ।

একবার এই রোগ হলে প্রতিকারের কোন উপায় থাকে না তাই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে তারা কৃষকদের বার বার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়ার পরামর্শ নিলেও তারা ভ্রুক্ষেপ করেনি বলে দাবি করেন লতিফ।

তিনি বলেন, ‘একবার ধানে ব্লাস্ট দেখা দিলে করার কিছু থাকে না। এজন্য আমরা বারবার অনুরোধ করেছি তাঁরা যেন ব্রি-২৮ জাতের ধানবীজ রোপণ না করেন। তারপরও অনেক কৃষক ফলনের আশায় রোপণ করেছেন। আমরা কৃষকদের ধানের শীষ বের হওয়ার সময় দুই রাউন্ডে ছত্রাকনাশক দিতে বলেছি। সেটাও শোনেনি। পটাশিয়ামের বদলে বেশি করে ইউরিয়া সার দিয়েছে। তাদের নিজেদের ভুলেই ব্লাস্ট রোগ হয়েছে।

চলতি বছরের আবহাওয়া ব্লাস্টের জন্য অনুকূল ছিল। এজন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউটের পক্ষ থেকে ৬৪টি জেলার উপ পরিচালকদের লিখিতভাবে সতর্ক করা হলেও কৃষকরা তা শোনেনি বলে জানিয়েছেন লতিফ।

কৃষদের এই না শোনার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, প্রত্যেক বছর তো আর ব্লাস্ট হয় না। এ কারণে তারা ঝুঁকি নিতে চায়।

তার মতে, আবাহাওয়া ভালো থাকলে এর ফলন এখনও ভালো হয়। এজন্য কৃষকরা বারবার ঝুঁকি নেয়।

এদিকে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের দাবি, মৌসুমের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ব্রি-২৮ এর ফলনে কয়েক দফায় পোকা-মাকড়ের আক্রমণ, কয়েক দফায় কীটনাশক প্রয়োগ, মাটির শুষ্কতা, প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে ফলনে এমন বিপর্যয় ঘটেছে

ব্রি-২৮ জাতকে প্রতিস্থাপন
কৃষকরা যাতে চিটা হয়ে পড়ার ঝুকিতে পড়া ব্রি-২৮ ধান আর চাষ না করে এ জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে এবং এই ধান দ্রুত তুলে নিয়ে চাষিদের অন্য জাতের ধান চাষ করতে বলা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী মো. আব্দুর রাজ্জাক।

রোববার সচিবালয়ে বোরো ধান নিয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা জানান।

তিনি বলেন, ‘সব জাতই দীর্ঘদিন চাষ করলে গুণাগুণ কমে যায়, বিভিন্ন রোগ ও পোকামাকড় আক্রমণ প্রতিরোধের সক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। অনেক জায়গায়ই চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আমরা চাচ্ছি খুব দ্রুত ব্রি-২৮ মাঠ থেকে তুলে নিতে। কৃষকরা যাতে এ ধান আর চাষ না করেন, সে জন্য তাদের নিরুৎসাহিত করছি। তাদের অন্য জাত চাষ করতে বলছি। নতুন জাতগুলো দ্রুত সম্প্রসারিত হওয়া দরকার। কৃষকের কাছে যাওয়া দরকার।’

ব্লাস্টের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে আধুনিক বালাই সহিষ্ণু ধানগুলোর প্রচলন ঘটানোর কথা জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের ক্রপস উইং এর পরিচালক স্বপন কুমার খাঁ।

গত পাঁচ বছর ধরে এ সংক্রান্ত প্রচারণা চলছে বলে তিনি জানান।

‘আমরা এখন আধুনিক জাতগুলো প্রদর্শনী ও প্রচারণার মাধ্যমে এবং কৃষকদের দিয়ে দিয়ে এর সম্প্রসারণ বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এভাবে ধীরে ধীরে ব্রি-২৮ অপসারণ করা হবে।’

তিনি জানান, ব্লাস্ট প্রতিবছর কম-বেশি হলেও নতুন জাতে এই রোগ এতো সহজে ছড়াতে পারে না।

তবে কৃষকদের কাছে এখনও এই ধানের বীজ সংরক্ষিত থাকায় বার বার নিষেধ করেও এর চাষ ঠেকানো যাবে কিনা সেটা নিয়ে তিনি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন গবেষকরা।