প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ফোনালাপ ফাঁস হয় ২০১৩ সালে। কিছুদিন পর ফাঁস হয় তারেক রহমানের ফোনালাপ।
ফাঁসের কাতারে যোগ হয় বিএনপির স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্যসহ তৃণমূলের নেতাকর্মীর আলাপ। ছাত্রদল বা যুবদলের নেতাদের ব্যক্তিগত আলাপচারিতাও ফাঁস হওয়া থেকে বাদ যাচ্ছে না।
আন্দোলনে গতিহারিয়ে এমনিতেই সঙ্গিন অবস্থা বিরাজ করছে বিএনপিতে। তার ওপর ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ফাঁস হওয়ার ঘটনা বিএনপি নেতাদেরকে বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।
এ নিয়ে দলের মধ্যে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হচ্ছে। ফোনালাপ নিয়ে দলের মধ্যে অনেকে সরব হয়ে ওঠায় মাঝে মধ্যে অন্য নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়তে হচ্ছে তাদেরকে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে-ফাঁস হওয়া ফোনালাপে দলের ভেতরকার অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসায় এগুলো এখন টক অব দ্য বিএনপিতে পরিণত হয়েছে।কিন্তু একের পর এক ফাঁসের ঘটনায় দলে নিজের অবস্থান দুর্বল হওয়ার শঙ্কায় অন্যদের মাঝে আতঙ্ক চেপে বসেছে।দলের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে মনে হয়েছে অনেকেই অতঙ্কে রয়েছেন। বলছেন ভাই কখন কার কোন ফোনালাপটি ফাঁস হয়ে যায়-এই ভয়ে আছি।
এদিকে বিএনপি নেতাদের একের পর এক ফোনালাপ ফাঁসে বিপাকে পড়েছেন গণমাধ্যমকর্মীরা। কারণ নেতাদের অনেকেই টেলিফোনে কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করছেন। টেলিফোন করলে অনেকে বাসায় যাওয়ার আমন্ত্রন জানাচ্ছেন।
তবে দলের বিরুদ্ধে বেফাঁস মন্তব্যকারীদের ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনায় অনেকে চাপের মধ্যে রয়েছে। বলা হচ্ছে, সিনিয়র নেতাদের বেফাঁস বক্তব্যে দল ইমেজ সংকটে পড়ছে।
কেন্দ্রীয় বিএনপির একজন সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকাটাইমসকে বলেন, “দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দলের বিরুদ্ধে কথা বলাটা শৃঙ্খলা পরিপন্থি। যারা আইন পরিপন্থি কথা বলছেন তারা ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে আতঙ্কে আছেন। আমরা আতঙ্কে নাই।” কেউ আবার দলের বিরুদ্ধে কথা বলায় দায়ীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ারও কথা বলছেন।
বিএনপি নেতাদের ফোনালাপ ফাঁসের শুরু বর্তমান সরকারের আগের মেয়াদের শেষদিকে। সংলাপের আহ্বান জানিয়ে ২০১৩ সালে ২৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ফোন করেন। তাদের মাঝে কথা হয় প্রায় ৩৭ মিনিট। ওই ফোনালাপটি তখন ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’ তে পরিণত হয়।
কিন্তু ফোনালাপের একদিন পর একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে ওই কথোপকথন প্রচার করা হয়। এতে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়।
এর কিছুদিন পর খালেদা জিয়ার আর একটি অডিও ফাঁস হয়। যাতে ছিল ২০১১ সালের ১৮ ডিসেম্বর রাজধানীতে মুক্তিযোদ্ধা সমাবেশের প্রস্তুতি হিসেবে শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতাকে দেয়া নির্দেশনামূলক বক্তব্য।
পুরনো ওই ফোনালাপের কয়েকখণ্ড অডিও দীর্ঘদিন পর ফাঁস হয় বাংলালিক নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলে।
এর কিছুদিন পর খবরের শিরোনাম হয় তারেক রহমান ও শমসের মবিন চৌধুরীর ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে লন্ডনে অবস্থানরত তারেক রহমান ফোন করেন শমসের মবিনকে। তাদের মধ্যে কথা হয় প্রায় ১০ মিনিট।
এতে আন্দোলনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলার পাশাপাশি বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের ভূমিকার সমালোচনা করেছিলেন তারেক রহমান। আলাপের কিছুদিন পর তাদের এই ফোনালাপ ফাঁস করে বাংলালিক।
তবে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝিতে। ওই সময় যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসাধীন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার সঙ্গে কথা বলেন ডাকসুর সাবেক ভিপি এবং নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। ফোনালাপে সরকার বিরোধী আন্দোলন, নাগরিক ঐক্যকে বিএনপির সহযোগিতা দেয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রায় ২৩ মিনিট কথা হয়।
একই সময় মান্না আরো একজন ব্যক্তির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। ফোনালাপে তৎকালীন সরকারবিরোধী আন্দোলন ও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেন তারা।ওই ফোনালাপে সেনাবাহিনীকে উসকানি দেয়ার অভিযোগ এনে গত ২৫শে ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করা হয় মান্নাকে।ওই মামলায় এখনো কারাগারে মান্না।
বিএনপি নেতাদের ফোনালাপ ফাঁসের পরের ঘটনা ঘটে ২৮ এপ্রিলের সিটি নির্বাচন বর্জনের সময়। ফাঁস হয় ঢাকা উত্তরের নির্বাচন সমন্বয়ক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাসের ফোনালাপ।
এরকিছুদিন পর ফাঁস হয় মওদুদ আহমদের আর একটি ফোনালাপ।গত ৮ মে দুপুরে তিনি ছাত্রদলের সাবেক সিনিয়র সহ-সভাপতি বজলুল করিম চৌধুরী আবেদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলেন। দুই মিনিট ৮ সেকেন্ডের কথোপকথনে বিএনপির বর্তমান পরিস্থিতি, খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব, জামায়াতের সঙ্গে জোটের সম্পর্কসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয়।
ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার পর বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন মওদুদ। দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তাকে নিয়ে শুরু হয় সমালোচনা। যদিও ওই ঘটনার পর এ নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি মওদুদ আহমদ।
এরপর ফাঁস হয় যুবদলের একজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমানের ফোনালাপ।গত ৩রা জুন যুবদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রইসউদ্দিনের সঙ্গে প্রায় ২২ মিনিট দলের সফলতা-ব্যর্থতা নিয়ে খোলামেলা কথা বলেন সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা।৫ই জুন তাদের ওই কথোপকথন ফাঁস করে দেয় বাংলালিক ইউটিউব চ্যানেল।
সবশেষ একজন থানা পর্যায়ের বিএনপি নেতার সঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খানের ফোনালাপ ফাঁস হয়। অডিওর কণ্ঠটি মঈন খানের কিনা তা নিশ্চিত না হওয়া গেলেও বিষয়টি নিয়ে সর্বত্র আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার দলের মধ্যে ভাঙন এবং নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করতে ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করা হচ্ছে। এজন্য তারা সরকারের একটি সংস্থার দিকে আঙুল তুলছেন।
আবার দলে থেকে সমালোচনাকারীদের কঠোর সমালোচনা করেছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, “দলের সমালোচনা করলে দলীয় ফোরামে করতে হবে। দলের বাইরে প্রকাশ্যে সমালোচনা করলে তাদের দল ছেড়ে করতে হবে।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য (যিনি প্রবীণ আইনজীবীও) ঢাকাটাইমসকে বলেন, “একটি গণতান্ত্রিক দেশে এমনটা করা আইনসিদ্ধ নয়।আর যারা দলের বিরুদ্ধে কথা বলছেন তাদেরও এইভাবে কথা বলা ঠিক না। কারণ টেলিফোন রেকর্ডকারীরা সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।পছন্দমতো কথা হলেই তা লুফে নিচ্ছে।”
শীর্ষ পদে থেকে দলের বিরুদ্ধে কথা বলায় ইমেজ সংকট হচ্ছে এমন দাবি করে তিনি বলেন, “এই ধরণের কথাবার্তায় নেতাকর্মীদের মনে হতাশার জন্ম দেয়।ইমেজ ক্ষুন্ন হয়।আমি মনে করি দল চাইলে এর জন্য দায়ি যারা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পারে।নেয়া উচিতও।”