ভালো নেই হাওরের মানুষ

নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের কাশিপুর গ্রামের সচ্ছল কৃষক তাকি হোসেন (৫৫)। সাড়ে ৬ একর জমিতে বোরো করেছিলেন তিনি। কিন্তু আগাম বন্যায় তার পুরো জমিই তলিয়ে গেছে। এক ছটাক ধানও ঘরে আনতে পারেননি। গত বছরের খোরাকি থেকে ৫ মণ চাল বেঁচেছিল তার। কয়েকদিনের মধ্যেই নতুন ধান কাটবেন, এই আশায় হাত খরচ মেটাতে চৈত্র মাসে ঘরে থাকা পুরো ৫ মণ চালই বিক্রি করে দেন তিনি। কিন্তু জমি তলিয়ে যাওয়ায় ঘরের হাঁস-মুরগি বিক্রি করে চাল কিনতে হয় তাকে। সেই চালে ১৫ দিনের মতো গেলেও এখন ঘরে কিছুই নেই তাঁর। ৮জনের সংসারে এখন শুধুই অভাব। ছোট ছেলে-মেয়েদের ক্ষুধার্ত মুখের দিকে তাকাতে পারছেন না তিনি। পাশের ভাটি ভরাটিয়া গ্রামের পরিচিত অহিদ মিয়ার কাছ থেকে ৫০ টাকা ধার নিয়ে এক কেজি মুড়ি কিনে এনেছিলেন। শনিবার দুপুরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে সেই মুড়িই চিবুচ্ছিলেন তিনি। বললেন, ‘আইজকা খাইনাই। ঘরে কিছতা নাই। খুউব কষ্টের মইধ্যে আছি। ঘরঅ চাউল না থাহনে সংসারের হগলে মিইল্যা মুড়ি খাইতাছি।’ একই গ্রামের কৃষক আক্কাছ মিয়া ৪ একর জমি করেছিলেন। তার জমিও তলিয়ে গেছে আগাম বন্যার পানিতে। গ্রামের পাশের হাওরে ভেসে থাকা খড় কুড়াচ্ছিলেন তিনি। বললেন, ‘আমরার ৬ জনের ঘর। আমরাতো উপাস আছি-ই, ঘরের ৪টা গরুও উপাস। সামনের আটঅ গরু বেইচ্যা দেঅন ছাড়া আর কোনঅ উপায় দেখতাছি না।’ কাশিপুর গ্রামেরই রুহুল আমিন ৫ একর জমিতে বোরো করেছিলেন। এ জন্যে ব্যাংক থেকে ৫৩ হাজার টাকা ঋণও নিয়েছিলেন। চারশ’ মণ ধান পাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু আগাম বন্যায় হাওর তলিয়ে যাওয়ায় জমির কাছেই কাঁচি নিয়ে যেতে পারেননি তিনি। এখন সাতজনের সংসারের খরচ নিয়ে পড়েছেন অকুলপাথারে। ঘরে কয়েকদিনের খাবার থাকলেও সপ্তাহখানেক পরেই তা ফুরিয়ে যাবে। সারা বছর কিভাবে চলবে, এই দুশ্চিন্তায় উদ্বেগ রুহুল আমিনের কণ্ঠে। একই গ্রামের রহিমা খাতুন কাঁদতে কাঁদতে জানান, দুই একর জমি ছিল তার স্বামীর। বানের জলে সব তলিয়ে গেছে। হাওর থেকে আনা পচে যাওয়া কাদা মিশ্রিত কিছু ধান কুলায় করে ঝাড়ছিলেন এই বৃদ্ধা। সেই ধান থেকে যদি খাবার উপযোগি খুদ-কুড়া কিছু মিলে! বললেন, ‘বাবা আমরা নিঃস্ব অইয়্যা গেছি। ঘরে খাঅন নাই। নাতি-নাতকররা কান্তাছে। এদের ফেডঅ দুই দিন ধইর‌্যা কিছতা দিতাম ফারতাছি না। অহন নিজে কীতা কইরা বাঁচাম, আর এরারেই কীতা কইরা বাঁচায়াম।’ হাওরের মধ্যে ভাঙনকবলিত এই কাশিপুর গ্রামে এখন কেবলই এমন অভাবী মুখের ছবি। গত ২৫ দিন আগে এলাকার কয়েকটি বাঁধ ভেঙে কাশিপুরের সামনের নেওড়া ও ফালিয়া বিলসহ আশপাশের সব হাওর ডুবে যায়। এতে এ গ্রামের অন্তত সাড়ে চার শ’ কৃষকের দুই হাজার একর ফসলি জমির ধান তলিয়ে যায়। তাদের মধ্যে গুটিকয়েক কৃষক হাওরের উঁচু জায়গা থেকে কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। পরে এগুলোও আর বৃষ্টির কারণে শুকাতে পারেননি। ধান ডোবানোর পর থেকে কাশিপুরের মানুষ অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাচ্ছেন। গ্রামের মোটামুটি সচ্ছল কৃষক হিসেবে পরিচিত মো. ফরিদ মিয়া। সোয়া ছয় একর জমিতে তিনি এবার বোরো ধান করেছিলেন। এক আঁটি ধানও কাটতে পারেননি। দুই ছেলে, তিন মেয়ে নিয়ে তার ৭ জনের সংসারে এখন টানাপড়েন। ফরিদ মিয়া বলেন, ‘এহদদিন আমার ঘরঅ ৫ কেজি কইরা চাউল লাগে। সাত দিন ধইরা দুই কেজি কইরা চাউলে দিন পার করতাছি। কী আর করাম, ঘরে চাউল কিনার টেহা নাই, হের লাগি বাধ্য অইয়্যা কম খাঅন লাগতাছে। অইলো, পোলাপানরে তো আর কম খাওয়াইয়্যা রাহন যায় না, ভাত কম দিলে হেরা কান্দে।’ ফরিদ মিয়ার সাথে কথা বলার সময় পাশে দাঁড়ানো ছিল তার বড় মেয়ে মবিনুর। নিষ্পাপ মায়ারি চেহারা। জানা গেল, দুই বছর ধরে মেরুদণ্ডের হাড় বাঁকা রোগে ভুগছে সে। গত অগ্রাহায়ণ মাসে মেরুদণ্ডে অস্ত্রোপচার হয়েছে তার। ফরিদ মিয়ার কথা শেষ হলে সে একটু গোছানো কণ্ঠে বলার চেষ্টা করলো, ‘আমার চিকিৎসা করাইতে গিয়ে আব্বার এক লাখ টাকা ঋণ হইছে। আমরা ৫ ভাই-বোনের সবাই পড়ালেখা করতেছি। আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। প্রতিদিন আমার ওষুধ খাওন লাগে। এক সপ্তাহ ধইরা আমার ওষুধ নাই। ওষুধ না খাইলে পিঠের ব্যথা বাড়ে। ধান ডুবায়া নেওয়ায় আব্বার হাতও টাকা নাই। এখন আমরা খুব কষ্টে আছি।’ গ্রামের বিধবা কিষাণি আলমনিশা (৫০) গার্মেন্টকর্মী মেয়ের টাকায় ২৫ শতাংশ জমি করেছিলন। তার জমিটুকুও পানিতে তলিয়ে গেছে। এক সপ্তাহ আগে তার ঘরের চাল শেষ হয়েছে। ছোট দুই নাতিকে নিয়ে তিনি এখন চরম বিপদে। আলমনিশা বলেন, ‘নির্বাচন আইলে কত নেতা আত-ফাও ধইরা ভোট নিতো আইয়ে, অহন এতো বিফদের সময় কেউ তো আইয়ে না।’ কথা হয় গ্রামের কৃষক মো. এলু মিয়ার (৪৫) সঙ্গে। এলাকার ফালিয়াবিল হাওরে দেড় একর জমি ছিল তাঁর। এ হাওরের পুরো জমির ধান মধ্য এপ্রিলের দিকে তলিয়ে যায়। এলু মিয়া জানান, ফলন দেখে ধারণা করেছিলেন, এবার তার জমিতে ১৫০ মণের মতো ধান হবে। সবেমাত্র পাকতে শুরু করেছিল ধান। এর মধ্যেই সব শেষ! এলু মিয়া বলেন ‘ধান হারায়া আমরা এহন পথের ফহির। সামনের দিনগুলোতে কিভাবে চলবো, আর খাবই বা কী। এই চিন্তাতেই আছি।’ গ্রামের উমর সিদ্দিক বাড়ির সামনের হাওর থেকে ধানের পচা ‘নাড়া’ সংগ্রহ করছিলেন। কথা হয় তার সাথে। জানালেন, তিনি এবার দেড় একর জমি করেছিলেন। ধানে সবেমাত্র থোর হয়েছিল। এর মধ্যেই বাঁধ ভেঙে সব জমি তলিয়ে যায়। জমি থেকে এক ছটাক ধানও আনতে পারেননি। বললেন, ‘ঘরে চাউল আছিন না সিংপুর বাজার থো বাকিতে ২০ কেজি চাউল আনছি। দুইডা গরু উবাস, গরুর লাগি নেড়া কাটতাছি।’ কাশিপুরে স্বামী সন্তান নিয়ে বসবাস করেন মুলেকা বানু (৪৫)। বৈশাখ মাস এলে অন্যের ঘরে ধান মাড়াই-ঝাড়াইয়ের কাজ করেন। স্বামী ধান কাটেন। বন্যায় ধান তলিয়ে যাওয়ায় এবার কোনো কাজ করতে পারেননি তারা। ২০ দিন ধরে তার ঘরে কোনো খাবার নেই। মুলেকা বললেন, ‘কিমুন কষ্টে আছি ভাই দেইখ্যা যান। ৫ সন্তান নিয়া এক সপ্তা ধইরা আলু খায়া বাঁইছ্‌ছা আছি। পেডের খিদা আর সহ্য হচ্ছে না ’ বলে ঘর থেকে কয়েকটি আলু এনে দেখালেন। ছবি তুলতে গেলেই তিনি আবেগে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। এ রকম অবস্থা শুধু কাশিপুর গ্রামের ফসলহারা এসব মানুষই নয়, ফসল হারিয়ে এমন নিঃস্ব অবস্থা, এ রকম কষ্ট কিশোরগঞ্জের হাওরের প্রায় প্রতিটি পরিবারেই। কৃষকেরা জানান, জেলার ৯৩টি হাওরের সবকটিই আগাম বন্যায় আক্রান্ত হয়েছে। এসব হাওরে অক্ষত বলতে কোন জমি নেই। উজান এলাকার কয়েকটি হাওর ছাড়া সিংহভাগ হাওরেরই বোরো ফসল ঘরে তোলার অনুপযুক্ত। এর মধ্যে ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার সবকটি হাওরই এখন পানির নিচে। এই তিন উপজেলার মোট ৬৮ হাজার ১৭৭ হেক্টর আবাদী জমির অন্তত ৫৫ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান পানির নিচে পঁচছে। জলমগ্ন কিছু হাওরের ফসল নৌকা আর দুর্মূল্যের শ্রমিক দিয়ে কাটার চেষ্টা করছেন কোন কোন এলাকার কৃষক। সর্বনাশা এই আগাম বন্যায় কিশোরগঞ্জে অন্তত দুই লাখ কৃষক সর্বশান্ত হয়ে পড়েছেন। এদিকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাগাভাগি নিয়ে দরকষাকষির মধ্যেই রোববার থেকে জেলায় বিশেষ ভিজিএফ হিসেবে পরিবার প্রতি মাসিক ৩০ কেজি করে চাল ও ৫শ’ করে টাকা বিতরণ শুরু হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. আজিমুদ্দিন বিশ্বাস জানান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের মধ্যে অগ্রাধিকারভিত্তিতে জেলার ৫০ হাজার কৃষককে বিশেষ ভিজিএফ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। জুলাই পর্যন্ত মোট ৪ হাজার ৯শ’ টন চাল এবং সাড়ে ৭ কোটি টাকা তাদের মধ্যে বিতরণ করা হবে। জেলা প্রশাসন থেকে এই বিশেষ ভিজিএফ বিতরণ নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে বলেও জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর