হাওরে এবার মাছের মড়ক

ধান গেছে অকাল বন্যায়। দেনার দায় মেটাতে গেছে গোয়ালের গরু। শেষ ভরসা ছিল হাওরের মাছ। হাওরাঞ্চলের কৃষক যখন মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করার স্বপ্ন দেখছেন, তখন সেই মাছেও মড়ক লেগেছে। পানিতে ভেসে ওঠা ছোট-বড় মাছ অসহায় কৃষকের স্বপ্নকে যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত করছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডুবে যাওয়া ধানে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সার পানিতে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করেছে, আধাপাকা ধান ও ধান গাছ পচে পানির গুণাগুণ নষ্ট করেছে। পানিতে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গেছে। ফলে হাওরাঞ্চলের সর্বত্র মাছ মরে গিয়ে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে।

সোমবার দুপুরে ধর্মপাশা উপজেলার সদর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া গ্রামের বকুল হাওলাদার বাড়ির সামনে হাওরের পানিতে নেমেছিলেন গোসল করতে। পানিতে নেমে কুলি করার জন্য পানি মুখে দিয়ে টের পেলেন ভীষণ দুর্গন্ধ। পানি থেকে উঠে আসার পর শরীরে চুলকানি শুরু হয়ে যায় তার।

ধর্মপাশা উপজেলার ধারাম, ধানকুনিয়া, টগা, জয়ধনা, শাসকা, সোনমড়লসহ বিভিন্ন হাওরে বোয়াল, পাবদা, টেংরা, বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির ছোট-বড় মাছ রোববার থেকেই মরে পানিতে ভেসে উঠছে। স্থানীয় লোকজন সেই মাছ পানি থেকে জাল দিয়ে সংগ্রহ করছেন।

ধর্মপাশার সুখাইড় রাজাপুর উত্তর ইউনিয়নের ইসলামপুর গ্রামের কৃষক গোলাম মোস্তফা জানান, সোমবার সকালে বাড়ির পাশের ধানকুনিয়ার হাওর থেকে বিভিন্ন জাতের প্রায় ১০ কেজি মরা মাছ সংগ্রহ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি তো কম মাছ পাইছি। যারার (যাদের) নাও (নৌকা) আছে তারা আরও বেশি মাছ হাইছে (পাইছে)।’ সংগৃহীত মাছ কেউ কেউ বিক্রি করছেন, আবার কেউ নিজেদের প্রয়োজনে রাখছেন। বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হওয়ার ফলে এসব মরা মাছ খাওয়ায় হাওরপাড়ের মানুষের ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বর্ষায় এ অঞ্চলের মানুষ গোসল থেকে ঘর-গৃহস্থালির কাজেও হাওরের পানি ব্যবহার করেন। দুর্গন্ধযুক্ত দূষিত পানি ব্যবহারের ফলে পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে হাওরপাড়ের মানুষের।

সমকালের মোহনগঞ্জ (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি আল মামুন তালুকদার, জগন্নাথপুর (সুনামগঞ্জ) প্রতিনিধি তাজউদ্দিন আহমদ, বড়লেখা (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি গোপাল দত্ত ও কুলাউড়া (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি এম. শাকিল রশীদ চৌধুরীর পাঠানো খবরেও হাওরের সর্বত্র মাছের মড়ক লাগার বিষয়টি জানা গেছে।

জগন্নাথপুর উপজেলা হাওর উন্নয়ন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নলুয়ার হাওরপাড়ের ভুরাখালি গ্রামের বাসিন্দা সিদ্দেকুর রহমান বলেন, এখানকার মানুষ বোরো ফসল ও হাওরের মাছের ওপর নির্ভরশীল। এবারে কৃষকের ঘরে নেই ফসল। তাদের জীবন-জীবিকার একমাত্র অবলম্বল ছিল হাওরের মাছ। এবার মাছও গেল মরে। তার ওপর কালবৈশাখী। সব মিলে হাওরে যেন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।

ধর্মপাশা মধ্যনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান প্রবীর বিজয় তালুকদারের বর্ণনায় হাওরের মাছের মড়ক লাগার চিত্রটি পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, ‘রোববার বোয়ালা হাওর হয়ে নৌকায় করে আরিফপুর গ্রামে যাচ্ছিলাম। কিন্তু হাওরের পানিতে এত দুর্গন্ধ যে নৌকায় বসে থাকা যাচ্ছিল না।’

বড়লেখা উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মৎস্য কর্মকর্তা আবু ইউসুফ হাকালুকি হাওরের বড়লেখা অংশে মাছ মারা যাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, ‘সোমবার সরেজমিন হাওর ঘুরে ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে মাছ মারা যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। হাওরের পানিতে ভীষণ গন্ধ। পানির রঙ বদলে গেছে। যেখানে পানি গভীর সেখানে বাদামি রঙ এবং যেখানে কম সেখানকার রঙ লাল ও কালচে হয়ে গেছে। ধারণা করা যাচ্ছে, হাকালুকির বড়লেখা অংশেই বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় ১৫-২০ টন মাছ মারা গেছে।’

ধর্মপাশা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘হাওরের পানিতে ফসলডুবির ঘটনায় কাঁচা ধান গাছ থেকে অ্যামোনিয়া গ্যাস সৃষ্টি হয়ে অক্সিজেনের অভাবে মাছের মৃত্যু হচ্ছে। উপজেলার ধারাম, ধানকুনিয়া, টগাসহ বিভিন্ন হাওরের মাছ মরে পানিতে ভেসে উঠছে। যে সব মাছের মৃত্যু হচ্ছে, সেগুলোর বেশির ভাগই ডিমওয়ালা। কারণ ডিমওয়ালা মাছ অন্য মাছের তুলনায় দুর্বল থাকে এবং ডিমওয়ালা মাছের মড়ক লাগায় এবার হাওরে মাছের পরিমাণ হ্রাস পাবে।’

তিনি জানান, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে সবচেয়ে বেশি সমস্যাগ্রস্ত হাওর এলাকায় চুন ছিটিয়ে পানির স্বাভাবিকতা রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।’

সুনামগঞ্জ জেলা মৎস্য কর্মকর্তা শঙ্কর রঞ্জন দাশ বলেন, ‘হাওরের জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশকের ক্ষতিকর প্রভাবে পানিতে বিষক্রিয়া হয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, ধর্মপাশা ও জগন্নাথপুর উপজেলার বিভিন্ন হাওরে এর প্রভাব খুব বেশি। তাই এসব মাছ না ধরা ও খাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে মাইকিং করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব উপজেলার আক্রান্ত হাওরে চুন ছিটানোর জন্য ৫০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শহিদুল হক বলেন, ‘হাওর এলাকা আয়তনে অনেক বড়। পানির বর্তমান অবস্থা কী সেটা না দেখে বলতে পারছি না। অকাল বন্যার সময় পানিতে ভেসে যাওয়া ধান গাছ পচে গেছে। কৃষি কাজে ব্যবহৃত কীটনাশক ও সার পানিতে মিশে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে, অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে মাছ মরে যাচ্ছে এবং পানিতে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হচ্ছে। বিশাল হাওরে এ থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। পর্যাপ্ত বৃষ্টি হয়ে হাওরের পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগ পেলে এ অবস্থা থেকে রেহাই পাওয়া যেতে পারে।’

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর