ঢাকা ০৩:২৫ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৩ মার্চ ২০২৫, ৮ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রংপুরের বদরগঞ্জ ২০০ বছরের মাঠ কেটে পুকুর, উজাড় গাছও

  • Reporter Name
  • আপডেট টাইম : ১২:০৮:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫
  • ১২ বার

রংপুরের বদরগঞ্জে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পশু মেলার মাঠ ধ্বংস করে দুটি পুকুর খননের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সম্প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের দাবি, মৎস্যজীবীদের মাছ চাষ ও স্থানীয়দের গোসলের সুবিধার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ প্রকল্প থেকে কোনো সুফলই পাবেন না তাঁরা। মূলত প্রকল্পের টাকা লুটপাট করতে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের। এদিকে পুকুর খননের নামে সেখান থেকে সংখ্যালঘু দুই পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির ৭০-৮০টি গাছ কেটে নিয়েছেন বিএনপির নেতা মিঠু।

বদরগঞ্জ ভূমি কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের যমুনেশ্বরী নদী ঘেঁষে পশু মেলার মাঠ। ব্রিটিশ আমলে এক জমিদার এই মেলার নামে ২৬ একর জমি দান করেন। প্রশাসনের তদারকির অভাব ও গাফিলতির কারণে মেলার অধিকাংশ জায়গা অন্যরা দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন। দখলে নেওয়া মেলার জমি অনেকের নামে রেকর্ডও হয়ে গেছে। বর্তমানে ১৬ একর জমি থাকলেও তাও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র টুটুল চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে হাটের নামে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে স্থাপনা গড়ে তোলেন। পরে মাঠ ভরাটের জন্য পাশেই দুটি খাল কেটে মাটি নেওয়া হয়। সেই দুটি খালই এখন খনন করে পুকুর করা হচ্ছে।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির অধীনে সারা দেশে পুকুর ও খাল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি অর্থায়নে ওই মেলার মাঠে ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক দুটি পুকুর খনন ও ঘাট নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫০৪ টাকায় একটির খননকাজ পায় রংপুর মাহিগঞ্জের কবিরস ইনোভেশন এন্টারপ্রাইজ। আর ২৭ লাখ ৮৫ হাজার ২৫৩ টাকায় অন্যটি পায় রংপুরের নজিরের হাটের মেসার্স আয়েশা এন্টারপ্রাইজ।

স্থানীয়রা জানান, খননপ্রক্রিয়া শুরুর আগে একটি খাল সাবেক মেয়র টুটুল চৌধুরীর ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফিন্দিউল হাসান চৌধুরী ওরফে শান্তু চৌধুরী এবং আরেকটি খাল সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুসের দখলে ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খাল দুটি দখলে নেন স্থানীয় বিএনপির নেতা মিঠুসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই ঠিকাদার কাজ পেলেও তাঁরা খননকাজ করছেন না। আহসানুল হক মিঠু নামের স্থানীয় এক বিএনপির নেতাকে কাজ তদারকি করতে দেখা গেছে। খননকাজে একটিতে বসানো হয়েছে এক্সস্কাভেটর মেশিন (ভেকু) ও আরেকটিতে ড্রেজার মেশিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, ‘খননযন্ত্র বসিয়ে গভীর করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। মূলত পুকুর খননের নামে ওই নেতার বালু বিক্রির ব্যবসাও ভালোই হবে।’

জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমি এই উপজেলায় আসার আগে সেখানে টেন্ডারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ওই সময় আমি থাকলে সেখানে প্রকল্প হাতে নিতাম না।’ তবে দুই পরিবারকে উচ্ছেদসহ গাছপালা কর্তনের বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানান।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মলিহা খানম বলেন, ‘মেলার মাঠে পুকুর খননের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ বদরগঞ্জের ইউএনও মিজানুর রহমান বলেন, ‘সেখানে সরকারিভাবে পুকুর খনন ও ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। মেলার মাঠের জায়গার বিষয়টি আমার জানা নেই।’

রংপুর এলজিইডি কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী আখতারুজ্জামান বলেন, খনন ও ঘাট নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মৎস্যজীবীরা মাছ চাষ করে লাভবান হবেন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা গোসলের সুবিধা পাবেন। তবে স্থানীয়রা জানান, ওই খাল দুটি কখনো মৎস্যজীবীরা ভোগ করেননি। সামান্য বন্যা হলেই খাল দুটি ডুবে যায়। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি মাছ চাষ হবে না। এ ছাড়া হাটের শত শত গবাদিপশু গোসল করানো হয়, সেখানে মানুষ গোসল করতে পারে না।

এ বিষয়ে প্রকৌশলী আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এটা তো আমি সার্ভে করিনি, ঢাকা থেকে টিম এসেছিল। তাঁরা কী দেখে করেছেন, জানি না।’ সংখ্যালঘুর বাড়ি উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি জায়গায় কেউ বসবাস করলে তাকে উঠে যেতে হবেই।

Tag :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

Haor Barta24

রংপুরের বদরগঞ্জ ২০০ বছরের মাঠ কেটে পুকুর, উজাড় গাছও

আপডেট টাইম : ১২:০৮:৩২ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫

রংপুরের বদরগঞ্জে ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী পশু মেলার মাঠ ধ্বংস করে দুটি পুকুর খননের অভিযোগ উঠেছে উপজেলা প্রকৌশল অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সম্প্রতি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

কর্তৃপক্ষের দাবি, মৎস্যজীবীদের মাছ চাষ ও স্থানীয়দের গোসলের সুবিধার জন্য এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, এ প্রকল্প থেকে কোনো সুফলই পাবেন না তাঁরা। মূলত প্রকল্পের টাকা লুটপাট করতে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের। এদিকে পুকুর খননের নামে সেখান থেকে সংখ্যালঘু দুই পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রজাতির ৭০-৮০টি গাছ কেটে নিয়েছেন বিএনপির নেতা মিঠু।

বদরগঞ্জ ভূমি কার্যালয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পৌর শহরের যমুনেশ্বরী নদী ঘেঁষে পশু মেলার মাঠ। ব্রিটিশ আমলে এক জমিদার এই মেলার নামে ২৬ একর জমি দান করেন। প্রশাসনের তদারকির অভাব ও গাফিলতির কারণে মেলার অধিকাংশ জায়গা অন্যরা দখলে নিয়ে চাষাবাদ করছেন। দখলে নেওয়া মেলার জমি অনেকের নামে রেকর্ডও হয়ে গেছে। বর্তমানে ১৬ একর জমি থাকলেও তাও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র টুটুল চৌধুরী প্রভাব খাটিয়ে হাটের নামে স্থায়ী ও অস্থায়ীভাবে স্থাপনা গড়ে তোলেন। পরে মাঠ ভরাটের জন্য পাশেই দুটি খাল কেটে মাটি নেওয়া হয়। সেই দুটি খালই এখন খনন করে পুকুর করা হচ্ছে।

উপজেলা প্রকৌশলীর কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এলজিইডির অধীনে সারা দেশে পুকুর ও খাল উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় সরকারি অর্থায়নে ওই মেলার মাঠে ৬৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পৃথক দুটি পুকুর খনন ও ঘাট নির্মাণ প্রকল্প নেওয়া হয়। ৩৯ লাখ ২২ হাজার ৫০৪ টাকায় একটির খননকাজ পায় রংপুর মাহিগঞ্জের কবিরস ইনোভেশন এন্টারপ্রাইজ। আর ২৭ লাখ ৮৫ হাজার ২৫৩ টাকায় অন্যটি পায় রংপুরের নজিরের হাটের মেসার্স আয়েশা এন্টারপ্রাইজ।

স্থানীয়রা জানান, খননপ্রক্রিয়া শুরুর আগে একটি খাল সাবেক মেয়র টুটুল চৌধুরীর ছোট ভাই উপজেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক ফিন্দিউল হাসান চৌধুরী ওরফে শান্তু চৌধুরী এবং আরেকটি খাল সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুসের দখলে ছিল। তবে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর খাল দুটি দখলে নেন স্থানীয় বিএনপির নেতা মিঠুসহ কয়েকজন নেতা-কর্মী।

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, দুই ঠিকাদার কাজ পেলেও তাঁরা খননকাজ করছেন না। আহসানুল হক মিঠু নামের স্থানীয় এক বিএনপির নেতাকে কাজ তদারকি করতে দেখা গেছে। খননকাজে একটিতে বসানো হয়েছে এক্সস্কাভেটর মেশিন (ভেকু) ও আরেকটিতে ড্রেজার মেশিন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এক শিক্ষক বলেন, ‘খননযন্ত্র বসিয়ে গভীর করে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। মূলত পুকুর খননের নামে ওই নেতার বালু বিক্রির ব্যবসাও ভালোই হবে।’

জানতে চাইলে উপজেলা প্রকৌশলী হারুন অর রশীদ বলেন, ‘আমি এই উপজেলায় আসার আগে সেখানে টেন্ডারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে। ওই সময় আমি থাকলে সেখানে প্রকল্প হাতে নিতাম না।’ তবে দুই পরিবারকে উচ্ছেদসহ গাছপালা কর্তনের বিষয়টি তিনি জানেন না বলে জানান।

উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মলিহা খানম বলেন, ‘মেলার মাঠে পুকুর খননের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।’ বদরগঞ্জের ইউএনও মিজানুর রহমান বলেন, ‘সেখানে সরকারিভাবে পুকুর খনন ও ঘাট নির্মাণ করা হচ্ছে। মেলার মাঠের জায়গার বিষয়টি আমার জানা নেই।’

রংপুর এলজিইডি কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী প্রকৌশলী আখতারুজ্জামান বলেন, খনন ও ঘাট নির্মাণের উদ্দেশ্য হচ্ছে মৎস্যজীবীরা মাছ চাষ করে লাভবান হবেন এবং স্থানীয় বাসিন্দারা গোসলের সুবিধা পাবেন। তবে স্থানীয়রা জানান, ওই খাল দুটি কখনো মৎস্যজীবীরা ভোগ করেননি। সামান্য বন্যা হলেই খাল দুটি ডুবে যায়। সেখানে দীর্ঘমেয়াদি মাছ চাষ হবে না। এ ছাড়া হাটের শত শত গবাদিপশু গোসল করানো হয়, সেখানে মানুষ গোসল করতে পারে না।

এ বিষয়ে প্রকৌশলী আখতারুজ্জামান বলেন, ‘এটা তো আমি সার্ভে করিনি, ঢাকা থেকে টিম এসেছিল। তাঁরা কী দেখে করেছেন, জানি না।’ সংখ্যালঘুর বাড়ি উচ্ছেদের বিষয়ে তিনি বলেন, সরকারি জায়গায় কেউ বসবাস করলে তাকে উঠে যেতে হবেই।