কক্সবাজারের চকরিয়ায় ফসলি জমিতে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু হয়েছে। এ তামাক চাষের আওতা থেকে বাদ পড়েনি একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙ্গিনাও। প্রতি বছর মৌসুমের শুরু থেকে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের পক্ষ থেকে কৃষকদের তামাক আবাদে নিরুৎসাহিত করতে মাঠ পর্যায়ের চাষিদের নিয়ে সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম পরিচালনা করা হলেও সে উদ্যোগ কোন কাজেই আসছেনা। তামাক কোম্পানিগুলোর লোভনীয় ফাঁদে পড়ে অন্যান্য বছরের ন্যায় এবছরও রেকর্ড পরিমাণ ফসলি জমিতে তামাক আবাদ করেছেন চাষিরা।
অভিযোগ উঠেছে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো, জাপান টোবাকো, আবুল খায়ের টোবাকো ও রাঙ্গুনিয়া সমিতিসহ অসংখ্য তামাক কোম্পানি চাষীদের তামাক পোড়ানোর সরঞ্জাম সরবরাহ ও অগ্রিম টাকা দিয়ে প্রলোভনে ফেলে পরিবেশ বিধ্বংসী এ তামাক চাষে নামিয়ে দিয়েছেন। কৃষি জমিতে তামাক আবাদের ফলে চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদ ও রবিশস্য উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে,উপজেলার বরইতলী ইউনিয়নের দক্ষিণ বরইতলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আঙ্গিনার চারপাশ ঘিরেই করা হয়েছে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাকের চাষ। তবে এ ক্ষেতের তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য এখনো চুল্লি নির্মাণ করা হয়নি। বিদ্যালয়ের চারিদিক ঘিরে তামাক আবাদের কারণে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটার পাশাপাশি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হারুণ রশীদ বলেন, বর্তমানে তাঁর বিদ্যালয়ে ৭জন শিক্ষক ও ১২০জন শিক্ষার্থী রয়েছেন। কিছুদিন আগে প্রধান শিক্ষক অবসরে যাওয়ায় বর্তমানে তিনি ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন। তিনি আরও বলেন, এ বছর বিদ্যালয়ের চর্তুরপাশেই তামাক চাষ হয়েছে। তবে এখনো তামাক পোড়ানোর জন্য চুল্লি নির্মাণ করা হয়নি। তামাক পাতায় বিষ ছিটানোর ফলে তার গন্ধ বিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। যেকারনে অনেক সময় শিক্ষার্থীদের পাঠদানকালে বিষাক্ত গন্ধ থেকে বাঁচতে বিদ্যালয়ের দরজা জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়। একারনে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের স্বাস্থ্যঝুঁকির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পরবর্তীতে তামাক পাতা পোড়ানোর জন্য চুল্লি নির্মিত হলে সে চুল্লি থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাস ও ধোঁয়ার কারণে পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে। বিদ্যালয় ঘিরে তামাক চাষের ব্যাপারে প্রশাসনিকভাবে এখনো কাউকে অবহিত করা হয়নি বলেও জানান ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হারুণ রশীদ। এছাড়া উপজেলার অন্তত ১০টি ইউনিয়নের ৫ হাজার একর জমিতে তামাকের আবাদ হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় প্রায় ২২ হাজার ২৩০ হেক্টর আবাদি জমি রয়েছে। এসব জমিতে বোরো আবাদ, রবিশস্য, রকমারি শাক-সবজির উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া চকরিয়ায় কিছুকিছু ইউনিয়নে তামাকের আবাদের কথা বলা হলেও ঠিক কি পরিমাণ জমিতে তামাকের চাষ করা হয়েছে সে ব্যাপারে কৃষি বিভাগ অবগত নয়।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক এম আর মাহমুদ বলেন, অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও চকরিয়ায় তামাকের ভয়াবহ আগ্রাসন শুরু হয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন বিপুল পরিমাণ ফসলি জমির পাশাপাশি মাতামুহুরী নদীর দুই তীর ও সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ভেতর আবাদি জমিতেও ব্যাপকহারে তামাকের আবাদ হয়েছে। পাশাপাশি এ তামাকগুলো পোড়ানোর জন্য সংরক্ষিত বনাঞ্চল উজাড় ও ব্যক্তিমালিকানাধীন সামাজিক গাছ নিধন হবে দেদারসে। এই মুহূর্তেই যদি প্রশাসনিকভাবে অভিযান চালিয়ে তা ধ্বংস করা না হয় তাহলে পরিবেশের যে বারোটা বাজবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। তিনি আরও বলেন,তামাক চাষের কারণে ফসলি জমির জমির উর্বরতা কমে যেমন যাচ্ছে, তেমনি চাষি এবং পরিবারের সদস্যসহ আশপাশের মানুষ প্রতিবছর নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম নাছিম হোসেন বলেন, ‘সরকারিভাবে তামাক চাষ বন্ধের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোন ধরনের দিক-নির্দেশনা নেই। এরপরেও তামাকের ভয়াবহতা অনুভব করে আমরা চেষ্টা করেছি নানা কর্মসূচি পালনের মাধ্যমে তামাক চাষীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে। তিনি আরও বলেন, এক্ষেত্রে তামাক চাষিদেরই বেশি সচেতন হতে হবে। মূলত: চাষীরা সচেতন হলে বিকল্প চাষের প্রতি তাদের আগ্রহ বাড়বে। অন্যথায় আবাদি জমি কমে গেলে নিরাপদ খাদ্য ভাণ্ডার নিশ্চিতে বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দিবে।