পানির জন্য জীবনযুদ্ধ

হাওর বার্তা ডেস্কঃ বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। মেরু অঞ্চলে গলতে থাকা বরফ সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে, ফলে এসব এলাকার মিঠা পানির উৎসগুলো লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড় জলোচ্ছ্বাস তো আছেই। যার ফলে এসব উপকূলীয় এলাকায় সুপেও পানি পাওয়া দিন দিন দুষ্কর হয়ে পড়েছে। নদীনালা, খালবিল এমনকি নলকূপের পানিও লবণাক্ত হয়ে গেছে অনেক এলাকায়।

অবস্থা এমন হয়েছে যে, কাপ মেপে পানি পান করেন উপকূলীয় এলাকার অনেক অধিবাসী। ঘরে মেহমান আসলেও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় কীভাবে তাকে আপ্যায়ন করবেন। কারণ রান্না-খাওয়াসহ সব কাজের জন্য বাড়তি পানি তাদের কাছে যুদ্ধের নামান্তর।

খুলনা কয়রার কলাপোতা গ্রামের মিতা সর্দার (৩৫) বলেন, আমরা ঘরের সদস্যরা খুব হিসাব করে পানি পান করি। বলতে পারেন, চায়ের কাপ মেপে পানি পান করি আমরা। ঘরে এক জন মেহমান আসলে আমরা শঙ্কিত হই। কীভাবে তাকে আপ্যায়ন করব? তার জন্য বাড়তি রান্না, এমন কি খাওয়ার পর তার সুপেয় পানি কীভাবে ব্যবস্থা করব। তিনি আরো বলেন, আমাদের চারদিকে কত পানি কিন্তু একফোঁটাও খাওয়ার উপায় নেই। আমাদের এখানে খাওয়ার পানির বড়ই অভাব।

এলাকার মানুষ জানান, বারবার বড় বড় সব ঝড়, সাইক্লোনে বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের লোনা পানি মিঠা পানির উৎসকে লবণাক্ত করে ফেলে। ফলে এই পানিতে আগের চেয়ে লবণাক্ততা বেড়েছে। জানা যায়, লবণাক্ততার কারণে গত কয়েক দশকে এখানকার ফসলের উৎপাদন ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে এলাকার মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার ঘটেছে চরম অবনতি। কলাপোতা গ্রামের একজন অধিবাসী বিদেশ কুমার সরদার (৩৮) বলেন, সেভাবে ফসল উৎপন্ন হয় না বলে এলাকার অনেক পুরুষ নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাড়ি জমিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, খেলার চক, শ্রীফল তলা, মাদারবাড়িয়া, বেপারীর চকসহ আরো অনেক গ্রামে এ চিত্র দেখা যায়।

একই গ্রামের তপতী সরকার জানান, উপায় না পেয়ে যখন বাড়ির কাছের কোনো পুকুরে আমরা গোসল করি, তখন চামড়ায় ফুঁসকড়ি পড়ে। চুলকাতে চুলকাতে ঘা হয়ে যায়। এলাকার অনেকেরই চর্মরোগ আছে। অথচ বছর ১৫ আগেও আমাদের মিঠা পানির এত অভাব ছিল না। সুচিত্রা রানী সর্দার বলেন, ‘আমার এক মেয়ে অনন্যা সর্দার (৭) আমাকে পানি আনতে সাহায্য করত। আমাদের শেখ হাসিনা সরকার যদি আমাদের গ্রামে অন্তত একটা মিঠা পানির নলকূপও দিত তা হলে গ্রামের মানুষগুলো বাঁচত। এলাকার নারীরাই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে সুপেয় পানি আনেন। এ কাজে ছোট মেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরাও যুক্ত। তারা প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটে বামিয়া সরকারি স্কুলের পুকুরে যান পানি আনতে। এ পথটি ভাঙাচোরা ও অমসৃণ। কোনো ধরনের যানবাহন এই রাস্তায় চলতে পারে না, এমন কি বাইসাইকেলও নয়। ফলে উঁচু-নিচু পথটি মাথায়, কাঁখে কলসি বহন করে পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে তারা নানা রকম ব্যথায় ভোগেন। কলাপোতা গ্রামের সুচিত্রা রানী সর্দার (৩৫) বলেন, এভাবে প্রতিদিন দুইবার পানি আনতে হয়। এই তো কয়দিন আগে মাথায় করে পানি আনতে গিয়ে আহত হয় আমার মেয়ে। তাই এখন আর ওকে নেই না। তাছাড়াও লবণাক্ত পানির প্রভাবে নানান রকম রোগসহ নারীরা নানা প্রজনন স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন বলে জানা যায়। কলাপাতা গ্রামের পল্লিচিকিৎসক পরেশ সর্দার মনে করেন অনতিবিলম্বে বাঁধ নির্মাণ, গ্রামে গ্রামে গভীর নলকূপ স্থাপন এবং জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা না হলে এলাকার জীবন চরম বিপর্যয়ের দিকে যাবে এবং স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়বে।কলাপোতা থেকে বামিয়া স্কুলের পুকুরপাড়ের প্রধান সড়ক পর্যন্ত প্রায় চার কিলোমিটারের ভাঙা রাস্তাটি সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে এলাকার চেয়ারম্যান সামাদ গাজী বলেন, আসছে শীত মৌসুমের মধ্যে

রাস্তাটি সম্পূর্ণ ঠিক করে দেওয়া হবে। তখন রিকশাভ্যানসহ সব যানবাহন চলতে পারবে। মানুষের পানি বহন করা সহজ হবে। এলাকায় মিঠা পানির ব্যবস্থা করা যায় কি?—জানতে চাইলে সামাদ গাজী বলেন, আমরা কলাপোতা বাগালী ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে নলকূপ বসানের চেষ্টা করেছি কিন্তু খুব একটা ফল হয়নি। প্রায় ১ হাজার ২০০ ফুট পর্যন্ত খনন করেও মিঠা পানির সন্ধান পাইনি। তিনি আরো বলেন, মানুষ যেন অন্তত দুই-চার মাস বৃষ্টির পানি ধরে রেখে ব্যবহার করতে পারে সেজন্য বাড়ি বাড়ি বড় পানির ট্যাংক সরবরাহ করা শুরু করেছি।

Print Friendly, PDF & Email

     এ ক্যাটাগরীর আরো খবর